Naya Diganta

উত্তরাঞ্চলে ইফতার সামগ্রীতে মেশানো হচ্ছে রাসায়নিক ও টেক্সটাইল রঙ

রংপুরে ইফতারসামগ্রীতে মেশানো হচ্ছে ভেজাল। ছবিটি রংপুর মহানগর এলাকার একটি দোকান থেকে তোলা : নয়া দিগন্ত

রমজানের শুরুতেই ক্ষতিকর কার্সিনোজেনিক রাসায়নিক পদার্থ ও রঙ সংবলিত ইফতার সামগ্রীর ছড়াছড়ি উত্তরাঞ্চলের দুই মহানগরী, জেলা, উপজেলা, হাটবাজার, বন্দর, মোড়ে মোড়ে ছোট ছোট বেশির ভাগ হোটেল থেকে শুরু করে ফাস্টফুড, রেস্তোরাঁ, চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। এতে পবিত্র রমজান মাসের শুরুতেই এই অঞ্চলের ধর্মপ্রাণ রোজাদাররা স্বাস্থ্যঝুঁকির আতঙ্কে আছেন। বিষয়টি নিয়ে সর্বমহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ হাত গুটিয়ে বসে আছেন। নয়া দিগন্তের অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে সরেজমিন অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য মতে, একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী এই অঞ্চলে ইফতারের জন্য অপরিহার্য পাঁচটি সামগ্রী ছোলা, পেঁয়াজু, বেগুনি, মুড়ি ও জিলাপিতে নানাভাবে ভেজাল মিশাচ্ছেন। মুড়ি আকারে বড় ও সাদা করতে ব্যবহার করা হচ্ছে ট্যানারির বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ সোডিয়াম হাইড্রোসালফাইড। বিষাক্ত এই পদার্থটি মূলত চামড়া শোধনের জন্য ট্যানারি শিল্পে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়াও রাসায়নিক পদার্থটি কাপড়ের মিলে সাদা রঙ করতে ব্যবহার করা হয়। ব্যবসায়ীরা মুড়ি ভাজলে তা লাল হয়। লাল মুড়ি ক্রেতারা পছন্দ করেন না অজুহাতে এই রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হচ্ছে মুড়িতে। এই পদার্থটি স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এক শ্রেণীর অসাধু বিক্রেতা বেগুনি, পেঁয়াজু, চপ ও জিলাপিতে ব্যবহার করছেন কাপড়ে ব্যবহৃত রঙ টেক্সটাইল কালার। অনুসন্ধান বলছে, এক কেজি টেক্সটাইল কালারের বর্তমান বাজার মূল্য ৩০০ টাকা। সেখানে এক আউন্স অর্থাৎ কমবেশি ২৮ গ্রাম ফুড গ্রেড কালারের মূল্য ৩০০ টাকা। কেজির হিসেবে যা দাঁড়ায় ৮ হাজার ৪০০ টাকা। সে কারণে ব্যবসায়ীরা টেক্সটাইল কালার ব্যবহার করছেন। অনেক সময় যে তেলে এসব ভাজা হচ্ছে তাতে মেশানো হচ্ছে পোড়া মবিলও। ফলে খাবার মচমচে হচ্ছে। কম দামি এসব টেক্সটাইল রঙ কিডনির জন্য খুবই ক্ষতিকর। মবিলে ভাজা খাবার খেলে দীর্ঘস্থায়ীভাবে দেহের ক্ষতি হয়। এতে ক্যান্সারের আশঙ্কা থাকে এবং পরিপাকসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতি হয়। এ ছাড়াও জিলাপি দ্রুত তৈরি করতে জিলাপির খামিরে মেশানো হয় হাইড্রোজ। জিলাপিকে মচমচে করতে দেয়া হচ্ছে হয় পোড়া মবিল। এ ছাড়াও জিলাপির রঙ আকর্ষণীয় করে তুলতে লাল ও হলুদ কাপড়ের সিনথেটিক রঙও ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক অসাধু ব্যবসায়ী কালো ছোলা সাদা করতে হাইড্রোজ দিয়ে সেদ্ধ করছেন বলেও অনুসন্ধানে জানা গেছে।
আরো জানা গেছে, মিষ্টি জাতীয় দ্রব্য তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে ভেজাল চিনি। চিনির পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে স্নাইকোমেট নামের রাসায়নিক তরল পদার্থ। মিষ্টি জাতীয় দ্রব্যকে অধিকতর মিষ্টি করতে ব্যবহৃত হচ্ছে স্যাকারিন, সুকরালেসসহ বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ। মিষ্টিকে রঙিন করতে ব্যবহৃত হচ্ছে টেক্সটাইল কালার। ইফতারে শরবতের ওপর নির্ভর করাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিনি বা কৃত্রিম মিষ্টি, রঙ আর মাছে ব্যবহার করা বরফ দিয়ে শরবত বানিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। মসলায় ভেজাল আরো বেশি। বেসনের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে আটা। আটায় হলুদ রঙ ব্যবহার করায় তা বেসনের রঙ ধারণ করছে। এ ছাড়া রসনা বিলাসের চাহিদা মিটাতে আরো কিছু আইটেম থাকে। তাতে ভেজালও থাকে সমপরিমাণে। হালিমে গোশতের দেখা মিলে খুব কম। এতে মিশানো হচ্ছে আগের দিনে অবিক্রীত ডাল ও গোশতের উচ্ছিষ্ট।
ইফতারের অন্যতম অনুষঙ্গ কলা, আম আনারসহসহ বিভিন্ন ফলফলাদি ও ফলের জুসে মেশানো হচ্ছে কার্বাইড। আর পচন রোধে বেশি দিন দোকানে ধরে রাখতে ব্যবহার করা হচ্ছে ফরমালিন। এ ছাড়াও দুধ ও মাছে মেশানো হচ্ছে ক্ষতিকর ফরমালিন। বিশেষ করে আম, মালটা, খেজুর, আপেল, আঙুর ও কমলায় এসব ব্যবহার করা হচ্ছে বেশি। তরল দুধেও মেশানো হচ্ছে এই এই ক্ষতিকর রাসায়নিক। কার্বাইড ও ফরমালিন মেশানোর কারণে ফলফলাদিতে আর স্বাদ পাওয়া যায় না। এ ছাড়াও বাজারে বিক্রি হওয়া বিভিন্ন ফলের জুসে ফলের রসের উপাদান থাকে না। সেখানেও নির্দিষ্ট ফলের রঙ, গন্ধ, চিনি ও পানি মিশিয়ে জুস হিসেবে তা প্যাকেট বা বোতলজাত করা হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই রোজায় রংপুর, রাজশাহী, বগুড়া, দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজসহ উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলা এবং ১২৬টি উপজেলার সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং সরকারি-বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে ডায়রিয়া আমাশয়সহ ভেজাল খাদ্যজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারিভাবে প্রতি জেলা ও উপজেলায় স্যানিটারি ইন্সúেক্টর থাকলেও তারা হোটেল রেস্তোরাঁ মালিকদের সাথে মোটা টাকার বিনিময়ে আঁতাত করায় মাঠে ভেজালবিরোধী অভিযান তেমন একটা দেখা যায় না। বারবার অভিযোগ দেয়ার পর ভেজালবিরোধী অভিযানে নামলে হালকা জরিমানা ও শাস্তির ব্যবস্থা করায় ব্যবসায়ীরা এ বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামান না। ফলে ভেজাল ইফতার সামগ্রীতে ছেয়ে গেছে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের অলিগলি।
রংপুর হোটেল রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক ফাল্গুনি হোটেল অ্যান্ড রেস্টেুরেন্টের স্বত্বাধিকারী ইব্রাহিম হক ব্যাপারি জানান, আমরা মিটিং করে ইফতার সামগ্রী বিক্রেতাদের বলে দিয়েছি ফুড গ্রেড কালার ছাড়া অন্য কোনো রঙ খাদ্যে ব্যবহার করা যাবে না। কেউ যদি করে সেটির দায় তাদের নিতে হবে।
রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদ হাসান মৃধা জানান, রমজান মাস উপলক্ষে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ও ফরমালিকমুক্ত ফল সরবরাহ নিশ্চিত করে খাদ্যদ্রব্য ভেজাল রোধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত থাকবে। কোনো ব্যবসায়ীর সরবরাহকৃত খাদ্যে ভেজাল থাকলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ ব্যাপারে রংপুর বিভাগীয় কমিশনার সাবিরুল ইসলাম বিপ্লব জানান, রংপুর বিভাগে প্রশাসন সজাগ রয়েছে। কেউ ইফতারে ভেজাল ও রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করলেও সাথে সাথেই আমরা অভিযান পরিচালনা করছি। কোনো দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যদি কোনো অনিয়ম করার অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা জানান, আমরা সর্বোচ্চ এলার্ট অবস্থায় আছি। কেউ ইফতারসামগ্রীতে ভেজাল ও রঙ মেশালে তাৎক্ষণিকভাবে আমরা সেখানে অভিযান পরিচালনা করব। করপোরেশনের ম্যাজিস্ট্রেট সার্বক্ষণিক এটা দেখভাল করেছ।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন রংপুর মহানগর সভাপতি অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম বেঞ্জু জানান, ভেজাল প্রতিরোধে প্রশাসনের উদ্যোগ আইওয়াশ। সরকারের জনগণের দিকে কোনো ভ্রƒক্ষেপই নেই। ফলে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরও হাত গুটিয়ে বসে আছেন। লোকবল সঙ্কটসহ বিভিন্ন অজুহাত তাদের। এতে অসাধু ব্যবসায়ীরা বেশি মুনাফার জন্য জনগণকে জীবন ও স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছেন।