Naya Diganta

সরকারি দলের আগ্রাসনে প্রতিবন্ধী প্রতিষ্ঠান

সরকারি দলের আগ্রাসনে প্রতিবন্ধী প্রতিষ্ঠান।

প্রবাদ রয়েছে ‘চোখ বুজে থাকলে কি প্রলয় বন্ধ হবে?’ সরকারি ঘরানার একশ্রেণীর সুবিধাবাদী চক্র ছাড়া গোটা জাতি আজ দুর্বিষহ সময় পার করছে। দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন অনিয়ন্ত্রিত থাকা ছাড়াও বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে দ্রব্যমূল্যের চেয়েও আরো দ্রুত গতিতে। প্রফেসর পারভেজ প্রণীত এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, বর্তমান বিশ্বের ১% মানুষ বিশ্বের প্রায় ৩৫% সম্পত্তির মালিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১% মানুষের হাতে ৪৩% সম্পদ।

বাংলাদেশের সরকারি ঘরানার ১% মানুষ এর চেয়ে বেশি সম্পদের মালিকানা ভোগ করছে। পাকিস্তানের ২২ পরিবারের স্থলে বাঙালি ২২ হাজার পরিবারের জন্ম হয়েছে। সরকার বলছে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু ক্ষুধার্ত মানুষের বা ভিক্ষুকের সংখ্যা তো কমেনি। এখনো পাঁচ কোটির বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। রঙ-বেরঙের রাষ্ট্রীয় বিলাসিতার চেয়ে মানুষের পেটে ভাত দেওয়া জরুরি। রাজধানীর ফুটপাথে ঘুমানো মানুষের বাসস্থান বা মাথাগোঁজার ঠাঁই কোথায়?

রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা জাতিকে আজ শোষক ও শোষিত এই দু’ভাগে বিভক্ত করেছে। সরকারি দলীয়করণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ভুক্তভোগী অধিকারবঞ্চিত জনগণ নিজেদের মনে করে ‘স্বাধীন দেশের পরাধীন নাগরিক’। নাগরিক স্বাধীনতা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা একেবারেই স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। পাকিস্তানিরা বৈষম্য করত কিছু রাখঢাক করে। এখন বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে রাজকীয় ভাবে, অর্থাৎ রাজার দল বনাম সাধারণ জনগণ। মানি লন্ডারিং এ রাজ ঘরানার ঘনিষ্ঠদের নামই ইথারা ভেসে আসছে। দুবাই এ সম্প্রতি উদ্বোধন করা রাজকীয় সোনার দোকোনের আর্থিক যোগানদাতা হিসাবে সাবেক পুলিশ প্রধানের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে সামাজিক মিডিয়ায় চলে এসেছে, যিনি শুধু পুলিশ প্রধান নয় বরং দেশী বিদেশী মদ বিক্রিয় দোকানের নামান্তরে ঢাকা বোট ক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন বলে পত্রিকাতে দেখেছি। সোনার দোকানের মালিকানার প্রমাণ তদন্তসাপেক্ষে, তবে রাজা বা রাজাধিরাজদের পরিবারদের বিরুদ্ধে তদন্ত করায় সংস্কৃতি বাংলাদেশে নেই। দুদক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্ত করে ক্ষমতাহীনদের বিরুদ্ধে। সত্য প্রকাশিত হওয়ার জন্য তবে কি ক্ষমতাচ্যুত হওয়া পর্যন্ত জাতিকে অপেক্ষা করতে হবে? কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে তিনি আমেরিকার সেনশন পেয়েছেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের যোগ্যতা আছে বলেই কি বেনামে স্বর্ণ ব্যবসারী হতে পেরেছেন। স্বাক্ষ্য আইন অনুযায়ী বিষয়টি প্রমাণের জন্য সরকারের সদিচ্ছা না থাকলে গোপন গোপনই থেকে যাবে।

সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য জনগণের অর্থে লালিত আমলা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সরকারের করায়ত্ত হওয়ার ফলে জনগণকে নিষ্পেষিত করতে সরকারকে কোথাও বিন্দুমাত্র চিন্তা ভাবনা করতে হচ্ছে না। জি, হুজুর, জাঁহাপনার নীতি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে কোনো আদর্শ নয় বরং নৈতিক/অনৈতিকের বালাই নেই, বরং আমলারা একটি আদেশ পেলেই হলো, তবে এর সাথে যদি জড়িত হয় পদোন্নতি ও লোভনীয় পোস্টিং-এর ইঙ্গিত প্রকাশ্যে বা আকার ইঙ্গিতে এবং যদি চাকুরিচ্যুতি বা ডিমোশনের কোনো সম্ভাবনা থাকে, তা ছাড়া নগদ অর্থসহ অন্যান্য সুবিধা তো রয়েছে। ব্রিটিশ আমলে আমলারা ভারতীয়দের ওপর, পাকিস্তানি আমলারা যে পদ্ধতি অনুসরণ করে পূর্ব-পাকিস্তানিদের ওপর নির্যাতন করত, হালে বাঙালি আমলারা অনুরূপভাবে কোনো প্রকার রাগঢাক না রেখেই নগ্নভাবে বাঙালিদের সাংবিধানিক অধিকার ছিনিয়ে নেয়, জিজ্ঞাসা করলে বলে ‘উপরের নির্দেশ’।

ভাত ও ভোটের অধিকারের আন্দোলন থেকেই স্বাধিকার আন্দোলন যার যবনীকা হয় রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। কিন্তু স্বাধীন দেশের সাধারণ মানুষ এখন ভোট ও ভাতের অধিকার থেকে বঞ্চিত। ২০১৪, ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচন জনগণের অংশ গ্রহণে হয়নি, যা সম্পন্ন হয়েছে আমলা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং বিচার বিভাগ কর্তৃক সরকারের সব অনৈতিক ও অসংবিধানিক কর্মকাণ্ডের প্রতিকারের পরিবর্তে নীরব সাক্ষী হিসাবে নিজেদের সমর্পণের মধ্য দিয়ে।

আগামী ২০২৩-২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে রিহারসেল সরকার শুরু করে দিয়েছে। ক্ষমতাসীনদের চরিত্র বাংলাদেশে একই চরিত্রের যার খেসারত এ দেশবাসী প্রতিনিয়তই দিচ্ছে। কিন্তু এখন সরকারের একনায়কতন্ত্রের কারণে জনগণের লাইফ, লির্বারটি ও প্রপারটি ছিনতাই হচ্ছে। সর্বক্ষেত্রেই চলছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মানুষের অধিকার ছিনতাই, লুট আর ডাকাতি। সরকারি দল শুধু জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জনগণের ভোটাধিকার ছিনতাই করে নাই, বরং পেশাজীবী সংগঠন ছাড়াও স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, হাট বাজার কমিটি, এমনকি প্রতিবন্ধী সংগঠনের কর্তৃত্ব নেয়ার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংগঠনগুলোর ওপরও হানা দিচ্ছে। এর একটি ঘটনা আজকের আর্টিকেলে তুলে ধরছি। চলতি সালের (২০২৩ ইং) ২২/২৩ ফেব্রæয়ারি ঢাকা আইনজীবী সমিতি ও ১৫/১৬ মার্চ সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি নির্বাচনে পুলিশ প্রহরায় ভোট ডাকাতির কার্যক্রমে জনগণ অবলোকন করেছে, কিন্তু ১৮ মার্চ অনুষ্ঠিত একটি প্রতিবন্ধী সংগঠনের ভোট ডাকাতি মিডিয়াতে প্রকাশিত হয় নাই, যা একজন ভুক্তভোগী হিসাবে অত্র আর্টিকেলে তুলে ধরা হলো।

বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জাতীয় সংগঠন ‘বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থার’ (বিজয়নগর, ঢাকা) কার্য নির্বাহী পরিষদ ২০২৩ গঠন করার জন্য সমাজসেবা অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক (সামাজিক নিরাপত্তা-৩)’কে প্রধান নির্বাচন কমিশনার মনোনীত করে অধিদফতরের আরো দু’জন কর্মকর্তা সমন্বয়ে তিন সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। উক্ত কমিশন প্রধান তাহার স্বারক নং- ৪১.০১.০০০০.০৪৯.৯৯.০১২.২২.২৪, তাং ০৮/০১/২০২৩ ইং তারিখে প্রদত্ত এক চিঠিতে নির্বাচনী ব্যয় বাবদ সংস্থার নিকট ৪ লাখ ১৭ হাজার টাকা (অন্তে ৪,৩৩,০০০/-) দাবি করেন। সংস্থা তন্মধ্যে অগ্রিম তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা প্রাথমিকভাবে পরিশোধ করে। নির্বাচন কমিশন সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে ১৮ মার্চ সকাল ৯টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণের তফসিল ঘোষণা করে। ওইদিন বেলা ১২টা পর্যন্ত আনন্দমুখর পরিবেশে ঢাকা বধির হাই স্কুলে নির্বাচন চলছিল। এমনি সময় সরকার সমর্থিত স্থানীয় দু’জন ওয়ার্ড কমিশনার ১৫-২০ জন বহিরাগত দলবলসহ ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করে এবং ২৫-৩০ মি. অবস্থানের পর চলে যায়। অতঃপর বেলা ১টার দিকে স্থানীয় যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা পুলিশের সহায়তায় কেন্দ্রে প্রবেশ করে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেয় এবং ব্যালট পেপারে সরকারি দলের আশীর্বাদপুষ্ট (কেন্দ্রীয় নেতার আত্মীয়) প্রার্থীর পক্ষে পল্টন থানার পুলিশ বেষ্টনিতে থেকে নিরাপদে সিল মারতে থাকে। এ দৃশ্য বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীরা দেখার পর তারা প্রতিবাদের জন্য কেন্দ্রে প্রবেশ করতে চাইলে পুলিশ বাধা দিলে বধির প্রতিবন্ধীরা ওয়াল টপকে বহিরাগতদের নিকট থেকে সিল মারা ব্যালট নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে। কিন্তু ন্যক্কারজনক ঘটনা এই যে, ওয়ার্ড কাউন্সিলরা কেন্দ্র থেকে চলে যাওয়ার পর কেন্দ্রকে অরক্ষিত রেখে কমিশনের তিনজনই কেন্দ্র ছেড়ে চলে যায়, যাকে বলা যায় নীরব আত্মসমর্পণ। দায়িত্বরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. রোকনুজ্জামান সাক্ষী গোপাল হয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে তিনি নিজেও দু’টার দিকে কেন্দ্র ছেড়ে চলে যান, যাওয়ার সময় বলে গেলেন যে, ‘এ পরিস্থিতিতে ভোট গ্রহণ সম্ভব নহে।’ কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট ব্যালট ছিনতাইয়ের কোনো প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করেননি। অথবা ছিনতাইকারীদের গ্রেফতার করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেন নাই।

আমি নিজেও বিগত ৪০ বছর যাবৎ বিভিন্ন প্রতিবন্ধী সংগঠনের সাথে জড়িত। জাতীয় বধির সংস্থার সহ-সভাপতি ও দু’বার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করি। এবারও প্রার্থী ছিলাম। গত বছর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী ছিলাম। বর্তমান সরকার আমলের নির্বাচনী ব্যবস্থা অর্থাৎ ‘উপরে ফিট ফাট ভিতরে সদর ঘাট’ দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ দেখতে দেখতেও বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছি। তবে ঘৃণাভরে এ সব দৃশ্য আলোকন করা ছাড়া একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে আমাদের কি বা করার আছে? প্রবাদ রয়েছে ‘বেড়ায় যখন ক্ষেত খায়’ তখন প্রতিকারের কোনো সুযোগ থাকে না। কিন্তু একটাই চিন্তা করি যে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা কেমন দেশ-রাষ্ট্র রেখে যাচ্ছি? চক্ষু লজ্জা যেখানে উঠে গেছে সেখানে চিন্তাভাবনার পরিধি কতটুকু গতি পেতে পারে? তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস গোয়েন্দারা নিশ্চয় ঘটনাটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি অবগত করাবে। এখন দেখা যাক একটি প্রতিবন্ধী প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে এ ধরনের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী কোন দৃষ্টিতে দেখবেন, তিনি কি প্রতিকার করবেন, না কি, আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের মতই বিবেচনায় নিবেন।

কথা এখানেই শেষ হওয়ার নয়। একটি রাষ্ট্রে যখন কোন মতবাদ/দর্শন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন সে মতবাদের উদ্যোক্তা বা পৃষ্ঠপোষকের নামেই চালু হয়। যেমন- আমেরিকার হিলারি ক্লিনটন ক্ষমতা থাকাবস্থায় বলেছিলেন, ‘মহিলাদের পশ্চাতে রেখে সমাজের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।’ এই মতবাদটি এখন Doctrine of Hillari নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশে ভোটাধিকার ছিনতাই করে ক্ষমতায় থাকা (নিম্ন থেকে উচ্চ পর্যন্ত) যে মতবাদ/পদ্ধতি চালু হলো এ মতবাদটি কাহার বা কোন নেতার Doctorine হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবে? ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। ফলে এ Doctorine অন্য কোনো Doctorine আহ্বান করবে কিনা তাহাও দেখার অপেক্ষায়। তবে ইতিহাস পর্যালোচনায় এটাই প্রতিয়মান হয় যে, জাতি এখন একটি মহাপ্রলয়ের জন্য অপেক্ষমাণ। কোনো কিছু চরমে না উঠলে তা শেষ হয় না। ভোটাধিকার হরণ ও ব্যালট পেপার ছিনতাই বাংলাদেশে এখন চরম পর্যায়ে এবং প্রতিটি স্তরেই নিঃলজ্জের মতো এসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলা, ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশদের প্রতক্ষ্য মদদেই ভোটাধিকার ছিনতাই হচ্ছে। ফলে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য ‘প্রকৃতি’ থেকেই প্রতিরোধ সৃষ্টি হবে, ইনশাআল্লাহ্ যার জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার অনৈতিক আর্বজনা পরিষ্কারের নিমিত্তে একটি রাজনৈতিক মহাপ্রলয় এখন সময়ের দাবি।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail : taimuralamkhandaker@gmail.com