Naya Diganta
স্মৃ তি ক থা

‘পথ চলিতে যদি চকিতে কভু দেখা হয়’

স্মৃ তি ক থা


ফেসবুকের কল্যাণে এখন আর পথ চলতে চলতে দেখা হওয়ার চেয়ে ফেবুতেই দেখা হচ্ছে বেশি। এই যান্ত্রিক যুগে পথ চলতে চলতে দেখা হওয়ার সুযোগ কই? তাই বলে কবি নজরুল ইসলাম যে সময়ে লিখেছিলেন অমন হৃদয়গ্রাহী কথাগুলো তা যে আজো ঘটছে না তা কিন্তু নয়। প্রেম যেমন শাশ্বত তার রূপও শাশ্বত। ভেদাভেদ শুধু পাত্রে বা ক্ষেত্রে। তাই তো বলছি ওই পথ চলতে চকিত চমকে অবশ্যই ঘটছে দেখা; হয়তো রেস্তোরাঁয়, নতুবা শপিংয়ে, না হয় তো কোনো এ্যালামনাইতে কিংবা কোনো সমাবেশে অথবা প্রাণের মেলা বইমেলাতে। আর এটিই স্বতঃসিদ্ধ।
বাঙালির ঐতিহ্যবাহী এ মেলা শুধু বইয়ের মেলাই নয়, একটি মিলনমেলাও বটে। আর সে দেখা হতে পারে কোনো ঘনিষ্ঠজনের সাথে বা পুরোনো বন্ধুর সাথে কিংবা ব্যর্থ প্রেমিক-প্রেমিকাতেও। দেখা হবেই- চিরন্তন সত্য। কারণ পৃথিবীটা গোল। ছোট্ট এ পৃথিবী চক্রাকারে ঘোরার পরিক্রমায় আমরা প্রতিনিয়তই পাড়ি দিচ্ছি যে পথ- তা ঘুরে ফিরে আবারো সামনে আসবেই। তেমনিই বোধ হয় এসেছিল আমার সামনেও তবে তা ফেসবুকের কল্যাণে। যদিও ঘটেছিল তা মেলা প্রাঙ্গণে।
বছরের এ মেলাতে এক দিনের জন্য হলেও একটা ‘ঢুঁ’ মারা আমাদের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সঙ্গী বরাবরের মতোই আমার স্বামী। আমার ভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়ে বইমেলা হতো ‘বাংলা একাডেমি’ প্রাঙ্গণে ছোট্ট পরিসরে। এখন পরিধি বেড়েছে। সারা দিন ঘুরেও বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী- দুই অঙ্গন শেষ করা দুরূহ। তাই আজ আমরা সারা দিন মেলায় ঘুরব, বাইরে খাবো এমনি পরিকল্পনায় এসেছি মেলা প্রাঙ্গণে। এবার আমার প্রকাশিত বই নেই। তাই ইচ্ছেমতো প্রিয় লেখকদের বেশ কিছু বই কিনে ফেললাম ঘুরে ঘুরে। এর মধ্যে অন্যতম আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ভাইয়ের অনুবাদকৃত বই : আই এম নট এন আইল্যান্ড (প্রখ্যাত ভারতীয় সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার খাজা আহমদ আব্বাসের আত্মজীবনী, আলী আহমাদ মাবরুরের অনূদিত সালমান আল আওদাহের বই ‘ইগো’, ফরিদী নোমানের পাঠক প্রিয় পাখির বই, সেলিনা হোসেনের কিশোর গল্প। এ ছাড়াও বাংলা একাডেমি কর্তৃক সম্পাদিত বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতির দুখানি বই আমার শ্বশুরালয়ের শেরপুর জেলা আর পিত্রালয়ের চাঁদপুর জেলা, আর কবিতার বই তো আছেই। এ সময়ের প্রিয় কবিদের কবিতার বই যেমন কবি মোশাররফ হোসেন খান, হাসান আলীম, জাকির আবু জাফর, রেজাউদ্দীন স্টালিন, সোহেল রশিদ প্রমুখ। তবে খুঁজে পাইনি প্রিয় কথক তিন বাংলার প্রতিষ্ঠাতা সালেম সুলেরী ও লালটুপির আব্দুল হাই শিকদার ভাইয়ের কোনো বই। হয়তো আছে আমিই দেখিনি! নাতনিদের জন্য নিলাম কিছু বই তার মধ্যে আবু তাহির মুস্তাকিমের ‘গ্রেটা থুনবার্গ’ অন্যতম। আহমদ মতিউর রহমান এর বইও নেয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু ভুলে গিয়ে মিস করেছিলাম।


যাই হোক, মোটামুটি বেশ বড় একটি বইয়ের বোঝা সাহেবের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ইচ্ছেমতো ঘুরাঘুরি করলাম। এ বছরের মেলার বাহ্যিক পরিবর্তনও কিছুটা দেখলাম। অবশেষে আমরা ঢুকলাম যার যার মসজিদে। নামাজ শেষে খাবার ঘরে। হঠাৎ মেসেঞ্জারে একটি অচেনা নম্বর ভেসে উঠল। নাম এলো জবযধহধ শযধহ. আমি আগ্রহের সাথে রিসিভ করে সালাম বিনিময় করলাম। জানতে চাইলাম যোগসূত্রের মাধ্যম কীভাবে? প্রতিউত্তর এলো- ফেবুর সৌজন্যে, আমার লেখা পড়েন তিনি নিয়মিত। এক সময় বুঝতে পারেন আমিই সেই আমি। তাই আজ কল দিয়ে নিশ্চিত হচ্ছেন। আর তাই প্রশ্ন করে বসলেন; আপনি কি ‘অমুক খান’কে চেনেন? স্মৃতির সাগরে কিছুক্ষণ হাতড়েও যখন মনে করতে পারছিলাম না তখন তিনি বলেই ফেললেন, ‘অমুক খানের’ সাথে আপনি প্রথম মঞ্চনাটক করেছিলেন। শ্রদ্ধেয় হুমায়ূন ফরিদী ভাইয়ের নির্দেশনায় তারই নাটক ‘বেকার নিকেতনে’ ১৯৭৪ সালে। আমি তাঁর স্ত্রী। ওনার কাছেই আপনার গল্প শুনেছি। সাথে সাথেই মনে পড়ে গেল এ নাটকে তো কোনো নায়ক চরিত্র ছিল না! আর সে জন্যই পারিবারিক অনুমতিটা মিলেছিল! বড় ভাইতুল্য ফরিদী ভাই নিজেও একজন দরবেশের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। আমাদের হারিয়ে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়ের বন্ধু হিসেবে তিনি আমাদের পরিবারের একজন বড়ভাই হিসেবেই সমাদৃত ছিলেন।
নাটকের মূল চরিত্রে ‘মীনা’ নামে আমি এক মিলমালিকের মেয়ে ছিলাম। যে নাকি মুক্তিযুদ্ধে তার ভাই হারানোর বেদনাটুকু ফুটিয়ে তুলেছিল নিজ প্রতিভায়। নাটকের ঘটনাটি আমাদের পরিবারের সাথে এতটাই মিল ছিল যে, গল্প শুনেই আম্মা ফরিদী ভাইকে অনুমতি দিয়েছিলেন আমাকে নিতে। বাস্তবের পার্থক্য ছিল আমার বাবা মিলার নন; বরং ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। যিনি চাকরির স্বার্থে প্রতি মুহূর্তে পাকবাহিনীর আদেশ মেনে গিয়েছিলেন প্রচণ্ড ঘৃণাভরে। আর গল্পের ‘বাবা’ ছিলেন পাকবাহিনীর দোসর অথচ তারই সন্তান নিখোঁজ হয়ে যায় যুদ্ধকালীন সময়ে। আর সে সময়েই বাবার সাথে চলছিল আদরের কন্যার আদর্শিক লড়াই। এক সময়ে সেই মুক্তিযোদ্ধা ভাইটিকে অবশেষে পাওয়া গেছে তবে প্রাণহীন অবস্থায়।
কিন্তু বাস্তবের আমার ভাই চাঁদপুর জেলার প্রখ্যাত ফুটবল খেলোয়াড় বোরহানউদ্দীন খানকে আজো পাইনি আমরা। তাই একটু নড়েচড়েই বললাম- তো! নাটকে ওনার চরিত্রটি কী ছিল? মহিলা হেসে দিয়ে বললেন; উনি একটি মাসিক পত্রিকা বের করতেন, শুনেছি আপনি তার নিয়মিত লিখিয়ে ছিলেন। হঠাৎ মনে পড়ে গেল। হায় সুবহানআল্লাহ! উনিই তো ছিলেন আমার সেই নাটকের ‘বাবা’ চরিত্রের ভদ্রলোকটি! আমি যেন ঠিক দেখতে পাচ্ছি। ওনার চলন-বলন, ভদ্রোচিত আচরণ, ব্যক্তিত্ব। উনিই! এ যেন পথ চলতে দেখার মতোই। মনে পড়ল ওনার পত্রিকায় আমি লিখতাম বটে কিন্তু কোনোদিনও সামনাসামনি দেখা হয়নি। নাটক করতে গিয়েই জেনেছিলাম ‘তিনিই তিনি’ অর্থাৎ পত্রিকারও সম্পাদক। আর তিনি ফরিদী ভাইয়ের ‘বহুরূপী নাট্যগোষ্ঠীর’ও একজন প্রাক্তন সদস্য।


যাই হোক রমনীয় হৃদয়! সব শঙ্কা মুক্ত করতে তড়িঘড়ি বললাম; ওনার সাথে আমার নাটকের সংলাপ আওড়ানো ছাড়া আর একটি বাক্যও বেশি বলা হয়নি। সামনেই স্বামী ব্যক্তিটি বসা। পরিবেশ সহজ করতে বললাম, এ জন্যই মনে পড়ছিল না। তা উনি কেমন আছেন? উনি ভালোই আছেন। হা হা করে হেসে দিয়ে মহিলাটি বললেন; কিন্তু তুমি তো আমাকেই চিনতে পারলে না সেটিই দুঃখ। মানে , আমি তোমার চলতে পথেরই একজন রেহানা খান।
কিছুতেই মাথায় আনতে পারছিলাম না, কে এই রেহেনা খান? ওপাশ থেকে ভেসে এলো কণ্ঠ- মনে করে দেখো, একবার কুমিল্লার ময়নামতি বার্ডের একটি অনুষ্ঠানে আমরা মুখোমুখি হয়েছিলাম নিজ নিজ পারফরম্যান্স নিয়ে। তুমি তখন কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী। অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় তোমার পারফরম্যান্সে আমি মুগ্ধ হয়ে প্রসংশাও করেছিলাম তখনই।। আমি ভিন্ন আরেকটি কলেজের ছাত্রী ছিলাম। এক সময় বই হয়ে তোমাদের শহরে আসি। তোমাকে মনে মনে অনেক খুঁজেছি। এখনো চোখে ভাসে তোমাকে। সেই তুমি আমার স্বপ্নের তুমি!
আবছা আবছা চোখে ভাসল অনুষ্ঠানের কথা কিন্তু এমন গুণগ্রাহীর চেহারা কিছুতেই এলোনা হৃদয় ক্যানভাসে। বললাম, ভিডিওটা অন করো তো! ভিডিও তে এসে ও বলল, ওয়াও!
তুমি যে আগের মতোই আছ। কিন্তু আমি যে ভীষণ এক অপারগতায় ভুগছি- কিছুতেই মনে আনতে পারছি না! আজ এতটা বছর পর এই চেহারাটা সেই কিশোরী বয়সে কেমন দেখাতে পারে! খুব চেষ্টা করলাম নিজ মনে আঁকতে। কিন্তু না! পাছে ও বুঝে ফেলে কষ্ট পাক তা ও আমার কাম্য নয় তাই হেসে দিয়ে বললাম, তুমিও। একটি তৃপ্তির হাসি ভেসে উঠল ওর চিবুকে।


যাক, একটা মানুষকে তো খুশি করতে পারলাম অন্তত। মানুষকে খুশি করাও নাকি সওয়াব। যদিও তা মিথ্যে অভিনয়ের সাথেই হোক। অতি আগ্রহ নিয়ে যোগাযোগ করা রেহানাকে আমি আনন্দ দিতে পেরেছি আজ এই ক্ষণে। ক্ষণটি ছিল একান্তই আমাদের দু’জনার। যে ক্ষণটাকে আমরা স্মৃতির জমিনে ধরে রাখতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম খুশি করতে শুধুই দু’জন দু’জনাকে।
মেলায় এসে দর্শক যেহেতু এমন দৃশ্য দেখেই অভ্যস্ত। হতে পারে তা প্রাক্তন প্রেমিক-প্রেমিকা, কিংবা অবৈধ প্রেমের যুগল! অথবা জীবন চলার পথের ক্ষণিক পথিক, বউ-বাচ্চাসমেত বা স্বামী-সন্তান জোড়া জোড়া। বুড়ো বয়সেও সেসব চোখের মদিরতা আর ভাবাবেগ বিনিময়ের পসরা কারো চোখই এড়িয়ে যায় না। এরা আসে- তবে বই নেই কারো হাতে, এরা ভিড় করে কিন্তু খাবারঘরে। মেলাটা যেন হয়ে উঠেছে প্রেমের আখড়া। যেন পুরনো প্রেমিক-প্রেমিকা খোঁজার মোক্ষম জায়গা! সিনো ফ্লেক্সের মতোই চলে ক্ষণিকের সেসব দৃশ্যের পর দৃশ্য!
কিন্তু না! আমরা ক্ষণিকের নই, চিরন্তন সঙ্গী, আমরা একে অপরের হৃদ-বাগানের স্নিগ্ধ সমীরণ, তিনি আমার ফুল-পাখিদের উত্তম অভিভাবক, আমার পৃথিবীর পথে হেঁটে চলার নিশ্চিন্ত বটচ্ছায়া! নির্ভরযোগ্য পথিক। আমার এগিয়ে চলার ধ্যান। আমি কেন গাইব; ‘চলিতে, যদি চকিতে!’ এ মুহূর্তে খুব মনে পড়ছে সে গানটি- ‘পথ চলিতে যদি চকিতে কভু দেখা হয়’- কিন্তু না ! এ দেখায় নেই কোনো পবিত্রতা, নেই প্রশান্তি! প্রশান্তি তখনি হবে যদি অনন্ত জীবনের পাথেয় নিয়ে এ ক্ষণিক জীবন পাড়ি দেয়া যায়। তাই তো আমি ভাবছি; আমরা আসব ফি বছর প্রাণের মেলা এই বইমেলায়। তবে ওরা যে যেভাবেই আসুক না কেন! আমরা আসব পবিত্র সম্পর্কের বাঁধনে বয়ে।