Naya Diganta

স্বাগত মাহে রমজান-স্বাগতম রমজানের রোজা

স্বাগত মাহে রমজান-স্বাগতম রমজানের রোজা।

ইসলামী জীবন বিধানের অন্যতম গুরুত্ববহ বিধান হলো ‘সিয়াম’ বা ‘রমজানের রোজা’। ‘সিয়াম’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ রোজা, উপবাস, খাদ্য-পানীয় পরিহার প্রভৃতি। আরবি ‘রমজান’ একটি মাসের নাম হলেও ‘রমজ’ ধাতু থেকে আসা রমজান মাস- আর এই ‘রমজ’ শব্দের অর্থ হলো দাহকরণ বা পোড়ানো। এই যে দাহন, এর স্বরূপটি হলো, মানব জীবনে কুপ্রবৃত্তি ও ভোগলিপ্সার দাহন। রোজা দেহকে নীরোগ রাখে; আত্মা প্রশান্তি ও পুষ্টি সঞ্চয় করে। পৃথিবীর অন্যান্য ধর্ম বিধানেও রোজার সমজাতীয় সংযমের বিধান রয়েছে। খ্রিষ্টান ও ইহুদিরাও তাদের বিধান ও ধর্মীয় আচার মোতাবেক সংযমের সুনির্দিষ্ট কানুন পালন করে থাকে। তবে উপবাসের সাথে রমজানের রোজা বা সিয়ামের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সিয়াম কেবল পানাহার থেকেই বিরত থাকার বিধান নয়; সর্ব প্রকার লোভ, কামনা-বাসনা, পাপাচার, অশ্লীলতা বা রিপুর তাড়না থেকে বিরত থাকার বিধান। রোজা তাই ইন্দ্রিয় শাসন ও প্রবৃত্তি দমনের সুযোগ এনে দেয়। রোজা দেহের তাড়নার ঊর্ধ্বে আত্মার পরিশোধনের এক অমোঘ ‘ডিটারজেন্ট’। প্রবৃত্তির আনুগত্য বা বশ্যতা যেখানে এক বিরাট শিরক, তখন সেই শিরক থেকে আমাদের আত্মরক্ষার দৈহিক ও মানসিক ঢাল হলো এই পবিত্র মাস, রমজানের ফরজ রোজা। প্রবৃত্তির দৌরাত্ম্য সব সময়ই প্রবল হয়ে দাগা দেয় আমাদের দেহ ও মনকে। সেই অপ্রতিরোধযোগ্য প্রবৃত্তি দমন ও শাসনের শক্ত কাজটি করে থাকে রোজার রক্ষাব্যুহ বা শিরোস্ত্রাণ।

রোজার মাস পবিত্র রমজান সম্পর্কে পবিত্র মহাগ্রন্থ আল কুরআনে বলা হয়েছে- ‘রমজান মাস। এই মাসে কুরআন নাজিল হয়েছে যা মানুষের জন্য হেদায়েত, সৎ পথের স্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে এই মাস পাবে সে যেন এই মাসে রোজা রাখে। তবে কেউ অসুস্থ হলে বা সফরে থাকলে সে অন্য সময়ে রোজার সংখ্যা পূরণ করে দেবে। আল্লাহ চান তোমাদের জন্য সহজ করতে, তিনি এমন কিছু চান না যা তোমাদের জন্য কষ্টকর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ করো ও তোমাদের সৎপথে পরিচালিত করার জন্য আল্লাহর মহিমা বর্ণনা করো এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো।’ (সূরা বাকারা-১৮৫)

শুধু পারস্যের অগ্নি উপাসক যরাথুষ্টবাদীরা ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সব ক’টি বড় ও প্রতিষ্ঠিত ধর্মেই কোনো না কোনো ধরনে এবং রীতিতে রোজা পালনের বিধান রয়েছে। প্রাচীন গ্রিস, পেরু ও আমেরিকার আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যেও বছরে একটি নির্ধারিত সময়ে উপবাস পালনের রীতি ছিল। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন সম্প্রতি গবেষণা করে দেখিয়েছেন, তুরস্কে ২৬ জন ডাক্তার তাদের রোগীদের ওপর জরিপ করে দেখতে পান, ২২ শতাংশ রোগী রোজার কারণে ডায়াবেটিস রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করেছেন।

বহু-ধর্মীয় সমাজে আত্মসংযমধর্মী উপবাসের বিধানের পটভূমি থেকে বলা হয়েছে, আরো অনেক ধর্মে রোজা পালনের অনুশাসন ও এটি মেনে চলার পরও ইসলামে প্রতিষ্ঠান বা প্রথা হিসাবে রোজা প্রকৃত পূর্ণাঙ্গতা পেয়েছে। ইসলামে পবিত্র রমজান মাসের ফরজ রোজাকে বলা হয়েছে, এই মাসব্যাপী সংযম সুখ, সুস্থতা ও মহান স্র্রষ্টার আজ্ঞা পালনের সন্তুষ্টিকে সমন্বিত করা হয়েছে। অন্য অনেক ধর্মেই উপবাস প্রথা ছিল সমাজের উচ্চ পর্যায়ের একটি অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু ইসলামে রোজাকে দেয়া হয়েছে সর্বজনীনতা, যা সব সামাজিক গোষ্ঠী, গোত্র বা শ্রেণী ও জেন্ডারভিত্তিক বিন্যাসে সব বিশ্বাসীর জন্য সমান ও সর্বজনীনভাবে পালনীয়।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কী অপারমহিমা! যতই দিন যাচ্ছে ততই অবাক বিস্ময়ে বিজ্ঞান বিশ্ব অবলোকন করছে এবং প্রমাণ পাচ্ছে, রোজা মানবদেহের জন্য কতখানি আশীর্বাদ হিসেবে এসেছে। সারা মাসের রোজায় মানুষের হরমোন, কোষ (cell) ও Genes-এর কার্যকরণে শুভ ও কল্যাণী পরিবর্তন নিয়ে আসে। মানুষ যখন বেশ কয়েক ঘণ্টা খাদ্য ও পানীয় গ্রহণে বিরত থাকে তখন দেহের ‘হরমোন’ মাত্রায় পরিবর্তন আসে যাতে দেহের শর্করা (Fat) গলতে থাকে ও কোষ মেরামতের (cellular repair) কাজ শুরু হয়ে যায়। রোজা থাকা অবস্থায় রক্তে ‘ইনসুলিন’-এর মাত্রা কমে যায়। ফলে দেহ চর্বি গলার মাত্রা দ্রুত হয় এবং দেহকোষের বর্জ্য বস্তু (Waste material) অপসারণের কাজ শুরু হয়। একেই বলে কোষ মেরামত। এর পাশাপাশি দেহের আয়ুবর্ধক Gene ও Molecule, যা রোগ-বিমারি ঠেকায়, তাদেরকে নতুনভাবে শক্তিশালী করে তোলে। রোজায় দেহের ওজন (body weight) কমে। যারা রমজানের এক মাস রোজা ছাড়াও বছরের বিভিন্ন সময়ে রোজা রাখেন তাদের ‘এভারেজ বডি ওয়েট’ স্থূলদেহীদের থেকে তুলনামূলকভাবে কম থাকে। রোজা ভাঙার পর অন্যান্য আহারে যদি আপনি খুব বেশি কিছু না খান, তাহলে আপনার ‘ফুড ইনটেক’ কম হচ্ছে; ক্যালরি গ্রহণও হচ্ছে কম। তা ছাড়া ঘন ঘন রোজা রাখলে দেহের ‘হরমোন’ কার্যকারিতা বেড়ে যায়। এটিও ওজন কমাতে সহায়ক হয়। শুধু দেহ ওজনই কমায় না, রোজা দেহের Visceral Fat-ও কমায়, ক্যালরি ভারসাম্য এনে অন্য সময়ের চেয়ে দ্রুত এবং বেশি ক্যালরি দহনে সহায়ক হয় এবং দেহের হজম-প্রক্রিয়ার হার (circumference) কমায়, পেটের ক্ষত (Abdominal Cavity) উপশম করে।

রোজায় দুই ওয়াক্ত খাওয়া ও রোজা ছাড়া তিন ওয়াক্ত খাওয়ার মধ্যে সঙ্গত কারণেই অনেকটা বেশকম আছে। তবে আমাদের এটিও খেয়াল রাখতে হবে, ভরপেট ইফতারি কিংবা নৈশভোজে খাদ্য গ্রহণ যেন পরিমিত থাকে। উদরপূর্তি করে খাওয়ার রীতি তো চতুষ্পদ প্রাণীর; আমাদের নয়। বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন, রোজায় Insulin Resistance-এর পাশাপাশি Type-2 ধরনের ‘ডায়াবেটিস’-এর ঝুঁকি কমে। রোজার এক বড় নিয়ামত হলো দেহে রোগ-বিমারির অন্যতম হেতু দেহ-ক্ষার (Body Toxin) এই টক্সিসিটির মাত্রা কমে এবং এই একই কারণে বা বৈশিষ্ট্যে দেহের oxychloride Stress ও প্রদাহ (Inflamation) নিরাময়।

দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমন বহু প্রকাশ্য ও গোপন প্রদাহ নিত্যই ঘটে চলে, যার কতকটা আমরা ঠাহর করতে পারি; বেশির ভাগই পারি না। আন্দাজ পাই না যে প্রদাহগুলো ((Inflamation), সেগুলো দেহ রাজ্যের অন্যান্য জায়গায় স্বাভাবিক কার্যকারিতাকে অবশ্যই কোনো না কোনোভাবে বিঘ্নিত বা প্রভাবিত করে। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া বিষময় হতেও তো পারে! বিশেষ করে দেহানুভূতির ঊর্ধ্বে মনোজগতে মানসিক পর্যায়ে! আজ মানুষের মধ্যে গড় যে অস্থিরতা, উৎক্রান্তিকতা, ক্ষিপ্রতা বা মনোবিকৃতি, এর মূলে যে দেহ-ক্ষার (Toxicity) কাজ করছে না, তাই বা কে হলফ করে বলতে পারে?

বিস্ময়কর শোনাবে, তবে এটি Clinical Fact যে, রোজায় হৃৎপিণ্ড এবং এর কার্যক্রম সহজ হয়। হৃদরোগকে এখন বলা হচ্ছে বিশ্বের প্রধান ঘাতক। রোজা থাকলে এমন কতগুলো ঝুঁকি কমে আসে, যারা হৃদরোগের ভায়রাভাই। কারণটা বোঝা খুব খুবই সোজা। রোজায় রক্তচাপ কম থাকে, কোলেস্টেরলের মাত্রা কম থাকে বিশেষ করে HDL? রোজায় পরিপাকতন্ত্র ভদ্র মানুষের মতো আচরণ করে, ভঙ্গুর ও অকার্যকর প্রোটিন শাসনে থাকে, কোষগুলো নিয়মিত মেরামতে থাকে, এগুলো কি হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতার অনুকূলে নয়? রোজা রাখলে বাঁধভাঙা গতির কোষ সঞ্চার কমে যায়। ফলে ম্যালিগন্যান্সির (ক্যান্সার) ঝুঁকিও কমে যায়। রোজায় ক্যান্সার রোগীদের চলমান চিকিৎসার মধ্যে কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া লঘু হয়ে যায়। এমনকি বাত ও হাঁপানি রোগের কষ্টও লাঘব করে। রোজায় মস্তিষ্কের কার্যকরণের স্বীকৃত ক্লিনিক্যাল সীমাবদ্ধতারও উপশম (Neurotrophic factors) এবং পার্কিনসন, অ্যালঝেইমার রোগের দুর্ভোগ তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রায় সহনীয় হয়ে আসে। রোজাদার রোগীদের নিয়ে বড়ই নিশ্চিন্তে থাকে Clinical Nutritionist ও Dietician-রা। এগুলো জগৎব্যাপী পরিচালিত জরিপ ও ক্লিনিক্যাল গবেষণা থেকে পাওয়া।

তাই আমরা যারা এবারের পবিত্র রমজান মাসটা পেলাম বা পেতে যাচ্ছি, তারা কতই না সৌভাগ্যবান! আমাদের উচিত হবে, এই রোজার ফজিলতে কেবল দেহের Toxin-ই নয়, মনের Toxicity-গুলোকেও দূর করা। দেহের রোজা করার পাশাপাশি মনের রোজা করতে পারলে তবেই হবে রোজার পরিপূর্ণতা।