Naya Diganta
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সঙ্কট

দশ দফা প্রতিরোধের পথরেখা

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সঙ্কট
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সঙ্কট।

গণতন্ত্র গোটা পৃথিবী অনুসৃত, সমাদৃত ও গৃহীত শাসনব্যবস্থা। অবশ্য গণতন্ত্র শুধু একটি শাসনব্যবস্থা (Governance) নয়- এটি একটি আদর্শ; একটি জীবনব্যবস্থা (A Way of Life)। তাই গণতন্ত্রের কার্যকারিতা এই দুটোর সমন্বয়ের ওপর নির্ভরশীল। ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও নেতৃত্ব যদি গণতন্ত্রকে জীবনবোধ হিসেবে গ্রহণ না করে তাহলে, গণতন্ত্রের লেবাসে এটি স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হয়। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে, দেশে দেশে এই গণতন্ত্রের সমীক্ষা, প্রয়োগ ও ব্যবহার নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই। অতিসাম্প্রতিক একটি বৈশ্বিক গবেষণার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে। এটি সুইডেনভিত্তিক Varieties বা V-Dem পরিচালিত একটি গবেষণা কার্যক্রম। এটি আমাদের কাছে প্রতিপাদ্য হয়েছে এই কারণে যে বাংলাদেশে ক্রমহ্রাসমান গণতন্ত্র সম্পর্কে প্রামাণ্য গবেষণা উপস্থাপিত হয়েছে।

উল্লেখ্য, V-Dem একটি অনন্য বা টহরয়ব প্রতিষ্ঠান। পৃথিবীব্যাপী গণতন্ত্রের বৈচিত্র্যময় অবস্থান এর দ্রষ্টব্য। তারা গণতন্ত্রকে দেখেন বহুমাত্রিকতায়, প্রকারভেদে, রাষ্ট্রিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন প্রাসঙ্গিকতায়। গণতন্ত্র সম্পর্কে সবচেয়ে সমৃদ্ধ তথ্য ও পরিসংখ্যান দাবি করছেন তারা। এর বিস্তৃতি ২২২টি দেশে। ১৭৮৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত বিশাল সময়ান্তরে তাদের বিচরণ। ২২২টি দেশে তাদের ব্যাপ্তি। বাংলাদেশে ক্ষয়িষ্ণু গণতন্ত্র সম্পর্কে তাদের প্রতিবেদনটি ২০২২ সালের তথ্য ও পরিসংখ্যান নির্ভর। তাদের প্রতিবেদনটি Democracy Report 2023 নামে প্রচারিত। এর শিরোনাম হচ্ছে Defiance in the Face of Autocratization. এটি পৃথক পৃথক প্রতিপাদ্যে পরিচালিত একটি নির্ভরযোগ্য গবেষণা। এগুলো হলো -
ক. ২০২২ সালে পৃথিবীব্যাপী গণতন্ত্রের অবস্থা।
খ. গণতন্ত্রচারী বনাম স্বৈরাচারী প্রবণতা।
গ. প্রধান প্রধান স্বৈরাচার।
ঘ. গণতন্ত্রায়ণের প্রয়াস।
ঙ. কর্তৃত্ব পরায়ণতা, ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রতিবন্ধক।

পৃথিবীর ২২২টি রাষ্ট্র ওই প্রকার ভেদে বিভিন্নভাবে আলোচ্য বিশ্লেষণের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এতে বাংলাদেশের অবস্থান গণতন্ত্রের প্রান্তিক পর্যায়ে। গণতন্ত্র থেকে স্বৈরাচারে উত্তরণের অধ্যায়ে। এই সময়ে পৃথিবীর ৪২টি দেশে গণতন্ত্র থেকে স্বৈরাচারী প্রবণতা দৃশ্যমান। নিবন্ধের ২০ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, nine countries have declined substantially: Afghanistan, Bangladesh, Combodia, Hongkong, India, Indonesia, Myanmar, The Philippines and Thailand. এখানে দেখা যায় পৃথিবীর এই অঞ্চলেÑ দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় গণতন্ত্র থেকে স্বৈরতন্ত্রে উত্তরণে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। শুধুমাত্র তালেবান শাসিত আফগানিস্তানই নেতিবাচকভাবে আমাদের আগে রয়েছে। প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে এই এলাকায় গণতন্ত্রের অবনয়নকে ‘নাটকীয়’ তথা অস্বাভাবিক বলা হয়েছে। ভি- ডেম-এর মতে এরা ফিরে গেছে ১৯৭৮ এর প্রেক্ষাপটে। উদার গণতন্ত্রের যে সুযোগ-সুবিধা তথা অধিকার নাগরিক সাধারণ যেভাবে ভোগ করতেন ১৯৭৮ সালে, সে অবস্থায় ফিরে গেছে এই অঞ্চল। চীনে স্বৈরতন্ত্র বহাল ছিল। ভারতে মিসেস গান্ধী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। ভি-ডেমের ভাষ্যে গণতন্ত্রায়নে ৪৫ বছর পিছিয়েছে বাংলাদেশসহ উল্লেখিত দেশগুলো। গণতন্ত্র থেকে ক্রমশ স্বৈরতন্ত্রে আরোহণ করেছে বাংলাদেশ। তাদের ব্যাখ্যায় ২০১২ থেকে ২০২২ সময়কাল পর্যন্ত এই অধোগতিটি ঘটেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে This highlights the sereous consequences of the current wave of Autocratization.

বাংলাদেশ প্রতিবেদন
ভি-ডেমের বাংলাদেশ প্রতিনিধি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনের একটি সারসংক্ষেপ গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। এতে বাংলাদেশই মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। এতে বলা হয়-
১. বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্রম অবনতি ঘটছে। দুটো পর্যায়ে এই অবনতি দৃশ্যমান: ক. গণতান্ত্রিক অধিকার ও খ. নির্বাচনী গণতন্ত্র।
২. উদার গণতন্ত্র নির্ধারকে (LDI) বাংলাদেশ পরীক্ষিত ১৭৯ দেশের মধ্যে ১৪৭তম অবস্থানে রয়েছে। এটি স্বৈরতন্ত্রের কাছাকাছি। এর সূচক ০.১১। গত বছরের তুলনায় ০.০২ পয়েন্ট হ্রাস পেয়েছে। এই হ্রাসমান অবস্থান নির্বাচনী নির্ধারক (EDI) ক্ষেত্রেও দৃশ্যমান। এখন নির্বাচনী সূচক ০.২৮। আগের বছরের তুলনায় এটি ০.০৩ কমেছে।
৩. উদার গণতান্ত্রিক সূচক (LCI) অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থানও নিম্ন গামী -১৫৫। সমতার নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থানও অবনতিশীল-১৬৫। অংশগ্রহণমূলক নির্ধারকেও একই অবস্থা। -১৪২। নাগরিক তুষ্টিতে অবস্থান -১৪৫।
৪. প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে ‘নির্বাচনী স্বৈরাচার’ (Electoral Autocracies) এর পর্যায়ভুক্ত প্রমাণ করা হয়েছে। বিশ্বের ৫৫টি দেশে এই প্রবণতা বিরাজমান। এদের মধ্যে রয়েছে- ভারত, পাকিস্তান, রাশিয়া এবং তুরস্ক। উল্লেখ্য, ২০২১ সালেও বাংলাদেশের অবস্থান একই রকম ছিল।
৫. বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবস্থান অধিকতর অবনতিশীল। একই অবস্থান ভারতের। উদার গণতান্ত্রিক নীতিমালায় ভারতের অবস্থান ৯৭।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসেবে নন্দিত হয়েছে-ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, এস্তোনিয়া এবং নিউজিল্যান্ড। নিন্দিতের তালিকায় রয়েছে ইরান, চীন, মিয়ানমার এবং উত্তর কোরিয়া। প্রতিবেদন মোতাবেক ৫৮টি দেশে নির্বাচনী সমস্যা রয়েছে। উত্তর কোরিয়ার অবস্থা সবচেয়ে নিকৃষ্ট। ভি-ডেম রিপোর্টে আরো বলা হয় ২০২২ সালে ৩৫টি দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতার অবনতি হয়েছে। বাংলাদেশের নাম এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ৩৭টি দেশের সরকার নাগরিকদের নিপীড়ন-নির্যাতন করছে। যথারীতি বাংলাদেশের নাম সেখানেও রয়েছে। সব নেতিবাচক নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান নিম্নতম। প্রতিবেদন আরো প্রকাশ করছে যে, বিশ্বের বাহাত্তর ভাগ মানুষ স্বৈরাচারী শাসনে ভুগছে। এদের সংখ্যা হচ্ছে, ৫.৭ বিলিয়ন। অথচ ২০১২ সালে ৪৮ ভাগ মানুষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একীভূত ছিল। বাংলাদেশ ২০০৯ থেকে ক্রম অবনতিশীল অবস্থায় ‘স্বৈরাচার’ ( (Autocracy) ধাপে উপনীত হয়েছে।

ক্রম অবনতিশীল গণতন্ত্র (২০০৯-২৩)
ভি-ডেমের বাস্তব প্রতিবেদনের পর ফিরে যেতে চাই বর্তমান এবং নিকট অতীতে। আমরা দেখব কিভাবে গণতন্ত্রের অবক্ষয় ঘটেছে। কিভাবে গণতান্ত্রিক প্রথা-প্রতিষ্ঠান একের পর এক ধ্বংস করা হয়েছে।
ক. এক এগারো : দেশজ, প্রতিবেশী ও বৈশ্বিক ষড়যন্ত্রের সম্মিলিত ফসল হিসেবে এক এগারোর ঘটনাবলি ঘটে। দেশের সংবিধানের অপব্যাখ্যা এবং গণতান্ত্রিক বিধি বিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সেনা সমর্থিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। দু’বছরের অবৈধ সরকার বি-রাজনীতিকরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। দৃশ্যত মাইনাস টু ফর্মুলা প্রচার করে অদৃশ্যত প্লাস ওয়ান ফর্মুলা গ্রহণ করে। পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক ‘অভিনব সরকার’ ও ব্যতিক্রমী নির্বাচনের মাধ্যমে ‘প্যাকেজ ডিল’ এর সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
খ. তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ : জন বিচ্ছিন্ন সরকার অনুধাবন করে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার মাধ্যমে তারা কখনো জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবে না। তাই তারা জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ওই ব্যবস্থা বাতিল করে। যে বিচারিক রায়ের অজুহাতে এ ব্যবস্থা নেয়া হয় সেখানেও সুপারিশ ছিল, অন্তত দু’বার এই ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্বাচন করা। সংবিধান সংশোধন কমিটির সুপারিশ অগ্রাহ্য করে ‘এক নেতা এক দেশ’ ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়।
গ. ভোটারবিহীন নির্বাচন : ২০১৪ সালে বিরোধী দল সূচিত গণআন্দোলনের মুখে নির্বাচনব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়ে। ক্ষমতাসীন সরকার এক নজিরবিহীন ভোটারবিহীন কাগুজে নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদ গঠন করে। সংখ্যায় ১৫৩ জন কার্যত ৩০০ আসনেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। ‘সাংবিধানিক বিধি-বিধান রক্ষায়’ এ নির্বাচন, পরে আরেকটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে- এমন প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরেও তা রক্ষা করা হয়নি।
ঘ. নিপীড়ন-নির্যাতন : সরকারবিরোধী যেকোনো তৎপরতাকে রাষ্ট্রবিরোধী তথা সন্ত্রাসী কার্যক্রম বলে অভিহিত করা হয়। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের দোহাই দিয়ে বিরোধী শক্তির উপর নিপীড়ন, নির্যাতন চালানো হয়।
ঙ. খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড : ২০১৮ সালের প্রথম দিকে ক্ষমতাসীন সরকারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে অপসারণের ষড়যন্ত্রে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা রুজু করা হয়। এ বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। তথাকথিত দুর্নীতির মামলাটি ছিল অসত্য তথ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আদালতকে ব্যবহার করা হয়। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সারা দেশে প্রতিবাদী আন্দোলন সূচিত হয়। অনেক নাটকীয়তার পর তাকে নিজ বাসগৃহে অন্তরীণ রাখা হয়। গত সপ্তাহে তার রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে কয়েকজন মন্ত্রী অনর্থক বিতর্কের সূচনা করেন।চ. তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা : ক্ষমতাসীন সরকার বিরোধী রাজনৈতিক উত্তরাধিকারকেও নিঃশেষ করে দিতে চায়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার বেঁচে থাকা একমাত্র সন্তান, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তারেক রহমানকে মিথ্যে মামলায় সাজা দিয়ে রাখা হয়েছে। তাকে এক মামলায় যে বিচারক বেকসুর খালাস দিয়েছে তাকে দেশ ছাড়া করা হয়েছে। এসবই হচ্ছে ক্ষমতাসীন সরকারের চরম প্রতিহিংসামূলক রাজনীতির নমুনা।
ছ. হামলা-মামলা-গুম-খুন : গত দেড় দশক ধরে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিরোধীদলীয় নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে অনবরত নিপীড়ন নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। বিনা বিচারে হত্যা করা হচ্ছে মানুষকে। গুম, খ্নু, হামলা-মামলা ও নানা ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছে তারা।

জ. কালো আইন : আইন প্রয়োগের অপব্যবহার করে কতিপয় কালো আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট-২০১৮ এমন একটি আইন। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনটি ব্যবহার করা হচ্ছে। কারো বিরুদ্ধে কথা বললেই এই আইনটি প্রয়োগ করা হয়।
ঝ. রাষ্ট্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংসকরণ : রাষ্ট্রিক প্রতিষ্ঠান আইন বিভাগকে একদলীয় করা হয়েছে। বিচার বিভাগকে অধীনস্থ করা হয়েছে। নির্বাহী বিভাগকে দলীয়করণ করা হয়েছে।

গণতন্ত্রায়ণের প্রয়াস ও প্রতিরোধ
বাংলাদেশ সম্পর্কে ভি-ডেমের প্রতিবেদনের পর অভ্যন্তরীণ অবস্থার একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় দৃশ্যমান হলো যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চা, আন্দোলন পরিচালনা ও নির্বাচনব্যবস্থা বিপজ্জনক পথ অতিক্রম করছে। এতদসত্তে¡ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত গণতন্ত্রের সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। সরকারি নির্যাতনকে উপেক্ষা করে গণতন্ত্রের জন্য নেতাকর্মীরা জীবনকে বাজি রেখেছে। নির্মম শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে আন্দোলনকে প্রতিহত করা হয়েছে। প্রাথমিক আন্দোলনগুলোকে সরকার ভায়োলেন্স এর বদনাম দিয়ে দমন করেছে। পরে চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিএনপি অনেকটা পথ সফলভাবে অতিক্রম করে। ২০১৭ সালে বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির পক্ষ থেকে ভিশন ২০৩০ ঘোষণা করেন। এই ঘোষণা রাজনৈতিক মহলে সমাদৃত হয়। ২০২০ সালের পর আন্দোলন নতুন দ্যোতনা লাভ করে।

২০২২ সালের গণ-আন্দোলন নতুন মাত্রা অর্জন করেছে। বিভাগীয় জনসভাগুলো জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। সরকারের নিকৃষ্ট ও নির্মম বাধা অতিক্রম করে জনসাধারণ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে। ভবিষ্যৎ নির্বাচন ও সরকারের সুস্পষ্ট রূপরেখা বিএনপি ঘোষণা করেছে। ভবিষ্যৎ নির্বাচন-পরবর্তী সরকার হবে সকল দল ও মতের সমন্বিত জাতীয় সরকার। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক মহলে আলোড়ন তোলে। পরবর্তীকালে২০২২ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্র সংস্কারের নীতিমালা ঘোষিত হয়। এতে সংবিধান, রাজনীতি, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে বিএনপির লক্ষ ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করা হয়। রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য, সরকারের শাসনকাল ও নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়। রাজনৈতিক মহলে সুশাসনের প্রত্যয় হিসেবে এসব ঘোষণা সমাদৃত হয়। এসব লক্ষ্য পূরণের জন্য বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করে। ১০ দফা কর্মসূচি ঘোষণার মাধ্যমে বিএনপি নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় অভীষ্ঠ লক্ষ্য অর্জন করতে চায়।
বিএনপির ওই সব কর্মসূচি এবং চলমান দশদফা ভি-ডেম আলোচিত স্বৈরতন্ত্র বিরোধী আন্দোলনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। গবেষণাপত্রের একত্রিশ পৃষ্ঠায় পাঁচটি কার্যক্রমের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
ক. স্বৈরাচার বিরোধী বড় ধরনের গণ-আন্দোলন পরিচালনা।
খ. বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা।
গ. ঐক্যবদ্ধ বিরোধী আন্দোলনে সিভিল সোসাইটিকে সম্পৃক্ত করা।
ঘ. ক্ষমতা পরিবর্তনের জন্য নির্বাচন ও অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা।
ঙ. গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক শক্তির সমর্থন।

নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ
আগেই বলা হয়েছে ভি-ডেম গণতন্ত্রকে অধিকার ও নির্বাচন- এই দুটো পর্যায়ে ব্যাখ্যা করেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে মৌলিক মানবাধিকারের কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয়ত এই অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নির্বাচনব্যবস্থার অনিবার্যতার কথা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। প্রতিবেদনের একপর্যায়ে বলা হয়েছে, গণতন্ত্রের মৌলিক বিষয়গুলোর মধ্যে নির্বাচন হচ্ছে প্রথম ও প্রধান। এই প্রতিবেদনে শাসকগোষ্ঠীর প্রকারভেদ করতে গিয়ে ‘Closed and Electoral Autocracies’ অর্থাৎ নিরঙ্কুশ স্বৈরাচার এবং নির্বাচনী স্বৈরাচারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এই সময়ের বাংলাদেশ এই দুটো সত্যকেই ধারণ করছে। বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক বিরোধী দল বিএনপি ঘোষিত ২৭ দফা কর্মসূচিতে রাজনৈতিক গণতন্ত্র নিশ্চিত করার কর্মসূচি দেয়া হয়েছে। অপর দিকে সমাগত নির্বাচনকে নিরপেক্ষ, নির্ভেজাল ও নিরঙ্কুশ করবার জন্য বাস্তব ফর্মুলা হাজির করা হয়েছে। বিগত ১৫ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের সম্ভাবনা নাকচ করা হয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করে সরকারের পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে।

এই সরকারের অধীনে গৃহীত যেকোনো নির্বাচন- তৃণমূল থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত, যেহেতু নিরপেক্ষ হয়নি, সেজন্য দল নিরপেক্ষ একটি অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। এই সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশনসমূহ বশংবদ ভ‚মিকা পালন করার কারণে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি জানানো হয়েছে। সরকারের নিপীড়নের শিকার সর্বস্তরের জনসাধারণ। একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে জেলে আছেন খালেদা জিয়া। এভাবে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী, মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক এবং আলেম ওলামাগণ- সবাই জেল-জুলুম ও অন্যায়-অত্যাচারের শিকার হয়েছেন। স্বাধীন ও মুক্ত নির্বাচনের স্বার্থে সবার সাজা বাতিল, মিথ্যে মামলা প্রত্যাহার ও কারাবন্দীদের মুক্তি চেয়েছে বিএনপি। এই সরকার প্রথম থেকেই সভা-সমাবেশ ও মত প্রকাশে বাধার সৃষ্টি করে আসছে। সাম্প্রতিক কালে বিরোধীদলীয় বিশেষত বিএনপির গণসমাবেশ ঠেকাতে যে ন্যক্কারজনক পথ বেছে নিয়েছে তা অবশ্যই পরিহার্য। বিবিধ কালো আইনের মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বিবেক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা অস্বীকার করে আসছে বর্তমান সরকার। তাই বিএনপির ১০ দফায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সন্ত্রাস দমন আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ সকল কালা-কানুন বাতিল চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ঘোষিত ১০ দফায় জনসেবা খাত ও দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনার দাবি জানানো হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সব দুর্নীতি চিহ্নিত করতে কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে বিএনপি। সব বিচারবহির্ভূত হত্যা, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন ও সম্পত্তি দখলের মত অন্যায়ের প্রতিকার চেয়ে শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে বিএনপি। সবশেষে বিএনপি গুরুত্ব দিয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ও পেশাদারিত্বের ওপর। তাই বলা হয়েছে, সব ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। এসব দাবির মাধ্যমে গণতন্ত্রের জন্য প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের আন্দোলন অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছবে। ভি-ডেম প্রতিবেদনে ব্যাখ্যা করা হয়েছে গণতন্ত্রায়নের অর্থ। তাদের ভাষায়, Democratization menas that a country is making moves away from autocracy and towards democracy. Autocratization is the opposite. গণতন্ত্রীকরণ মানে, একটি দেশ স্বৈরাচার থেকে সরে গিয়ে গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। স্বৈরাচারীকরণ গণতন্ত্রের বিপরীত। গণতন্ত্র থেকে স্বৈরাচারের দিকে সরে যাওয়া একটি জাতির জনগণের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। যত শিগগিরই সম্ভব এই জাতির গণতন্ত্রের পথে একটি গণবিপ্লব প্রত্যাশিত।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com