Naya Diganta

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সন্নিহিত এলাকা অপহরণ বাণিজ্যের ‘হটস্পট’

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সন্নিহিত এলাকা অপহরণ বাণিজ্যের ‘হটস্পট’।

টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলায় অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর আশপাশে চলছে বেপরোয়া অপহরণ বাণিজ্য। লাখ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করছে দুর্বৃত্তরা। এ দুই উপজেলার সাধারণ মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে আতঙ্ক ও হতাশা। এসব এলাকায় মুক্তভাবে চলাফেরা করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ক্যাম্পগুলোর অভ্যন্তরে অস্থিরতা, খুনাখুনি, মারামারি ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশ, র‌্যাব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চেষ্টা করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। সন্ত্রাসীরা আগে যাত্রী, পথিক ও স্থানীয়দের ডাকাতি করে, নগদ অর্থ ও মোবাইল কেড়ে নিত। এখন ছোট শিশু থেকে, যুবক ও বয়স্কদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মোটা অঙ্কের মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দিচ্ছে। কাক্সিক্ষত অর্থ না পেলে মেরে ফেলছে। টাকার বিনিময়ে মুক্তি পাওয়া অনেকে হয়রানির ভয়ে পুলিশের কাছে রিপোর্ট পর্যন্ত করছেন না। অতীতে উল্টো অনেকে পুলিশি হয়রানির শিকার হয়েছেন, এমন অভিযোগ জনগণের মুখে মুখে। এর ফলে আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অবস্থার উন্নতি না ঘটলে স্থানীয়দের জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্থানীয় সন্ত্রাসী ও রোহিঙ্গা ডাকাতরা মিলে একটি দুর্বৃত্ত চক্র গড়ে তোলে এবং টেকনাফের গহিন পাহাড়ে আস্তানা গেড়ে অপহরণ বাণিজ্য পরিচালনা করে আসছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা গত এক বছরে ৫০ জনের বেশি মানুষকে ধরে নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করে। চাঁদা না পাওয়ায় ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি ওমর ফারুক ও স্থানীয় বাসিন্দা মুহাম্মদ হোসেনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, গত ১৮ ডিসেম্বর টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের আট কৃষককে অপহরণ করেছিল রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। চার দিন পর ছয় লাখ ৪০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান সবাই।

সম্প্রতি টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের বড় লেচুয়াপ্রাং এলাকা থেকে চার কৃষককে অপহরণ করে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। তারা হলেন- লেচুয়াপ্রাং গ্রামের আবদুস সালাম, আবদুর রহমান এবং দুই ভাই মুহিব উল্লাহ ও আবদুল হাকিম। পরে অপহৃত এ চার কৃষকের মধ্যে তিনজনকে ছয় লাখ টাকার মুক্তিপণের বিনিময়ে ফিরে আসেন। গত ১০ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৮টার দিকে হ্নীলা পাহাড়ি এলাকা থেকে তারা ছাড়া পান। এর এক দিন পর বুধবার আবদুস সালাম মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দিয়ে সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি অবস্থা থেকে মুক্ত হন। আবদুস সালামের ছোট ভাই রফিক আহমদ জানান, রাতের বেলায় বন্যহাতির দল ভুট্টা ক্ষেতে নেমে পড়ে। পাহারার জন্য অপহৃত চারজন টঙঘরে ঘুমিয়েছিলেন। ভোররাত সাড়ে ৪টার দিকে অস্ত্রধারী ১৫-২০ জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ওই চারজনকে অপহরণ করে পাহাড়ের ভেতরে নিয়ে যায়। পরে তারা ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ফেরেন। এ ছাড়া গত ১৮ ডিসেম্বর টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের জাহাজপুরা এলাকার খালে মাছ ধরতে গিয়ে অপহরণের শিকার হন আট ব্যক্তি। তারা ছয় লাখ ৪০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসেন (ভোরের কাগজ, ২১ জানুয়ারি-২০২৩)। গত ১৫ জানুয়ারি কক্সবাজারের ঈদগাঁও-ঈদগড় সড়কের হিমছড়ির ঢালা থেকে গরু ব্যবসায়ীসহ দু’জনকে তুলে নিয়ে যায় ডাকাতরা। তারা হলেন আলীকদমের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শাহজাহান ও তার মোটরসাইকেল চালক। পরে তারাও মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছেন।

টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার বাহারছড়া, হ্নীলা, হোয়াইক্যং, শাপলাপুর, দমদমিয়া, লেচুয়াপ্রাং, জাদিমোড়া, লেদা, আলীখালী, রঙ্গিখালী, পানখালী, মরিচ্চাঘোনা এলাকার পরিবারগুলো অপহরণকারীদের ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি উখিয়ায় আশ্রয়শিবিরে অপহরণের ১৪ ঘণ্টা পর সামসুল আলম (৩৮) নামে এক রোহিঙ্গা ইমামের মৃতদেহ পালংখালী ইউনিয়নের ২০ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সীমানা এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়। তিনি রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের স্থানীয় একটি মসজিদের ইমাম ছিলেন। তিনি উখিয়া উপজেলার ১৭ নম্বর রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের সি-ব্লকের বাসিন্দা মৃত মিয়া চান এর ছেলে। সম্প্রতি রাত ৮টার দিকে সামসুল আলমকে নিজের ঘর থেকে অস্ত্রের মুখে মুখোশ পরিহিত একদল দুর্বৃত্ত অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে স্বজনরা বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখোঁজি করেও তার সন্ধান পাননি। সকাল ১০টার দিকে উখিয়া উপজেলার ২০ নম্বর রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের সীমানা এলাকায় এক ব্যক্তির মৃতদেহ দেখতে পেয়ে স্থানীয়রা এপিবিএন পুলিশকে খবর দেয়। নিহতের শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে বর্তমানে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ১০টি দুর্বৃত্ত দল বর্তমানে সক্রিয় রয়েছে বলে জানা গেছে। আধিপত্য বিস্তার, অস্ত্র কারবার, মাদক ব্যবসা ও স্বর্ণ চোরাচালানের জন্য তারা একে অপরকে খুন করতে দ্বিধা করে না। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা বড্ড নিষ্ঠুর। তাদের অন্তরে মায়া দয়ার লেশমাত্র নেই। গত পাঁচ বছরে উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরগুলোতে ১২৩ জন খুন হন। এর মধ্যে ৯১ জনকে হত্যার ঘটনায় করা ৮১ মামলায় আসামি করা হয়েছে ৩৮৪ জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে। অবশিষ্ট ৩২ জন খুন হয়েছেন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের একাধিক বাহিনীর গোলাগুলোতে এবং অপহরণের পর খুন-গুমের ঘটনায়।

মুক্তিপণের জন্য গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন ক্যাম্প থেকেই অপহরণ করা হয়েছে ২০৭ রোহিঙ্গাকে। পুলিশের দেয়া তথ্যমতে, ২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় পাঁচ বছর তিন মাসে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন অপরাধে পাঁচ হাজার ২২৯ জন রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে দুই হাজার ৪২৫টি। সবচেয়ে বেশি মাদক মামলা এক হাজার ৫৬৪টিতে আসামি করা হয়েছে দুই হাজার ৩৮৫ জন রোহিঙ্গাকে। একই সময়ে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে উদ্ধার হয় ১৭৬টি অস্ত্র। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির এক প্রতিবেদন বলা হয়েছে, ২০২১ ও ২০২২ সালে সংঘটিত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিশ্লেষণে দেখা যায়- এ সময়ে বেড়েছে হত্যাকাণ্ড। ২০২১ সালে যেখানে ২২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, ২০২২ সালে তা বেড়ে হয় ৩২টি। জানুয়ারি ২০২১ থেকে ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত ২২২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৯৯টি দুর্ঘটনাজনিত। ৬০টি নাশকতামূলক ও ৬৩টির কারণ জানা যায়নি (বাংলা ট্রিবিউন, ১৮ ফেব্রæয়ারি, ভোরের কাগজ, ২১ জানুয়ারি-২০২৩)।

মিয়ানমার ও রোহিঙ্গাবিষয়ক গবেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) হাসান মো: শামসুদ্দীন মনে করেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক বেশির ভাগ সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিদের যোগাযোগ রয়েছে বলে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তথ্য রয়েছে। ক্যাম্পের পরিস্থিতি অশান্ত করার জন্য সন্ত্রাসী গ্রুপকে কোটি কোটি টাকার ইয়াবা সরবরাহ করছে মিয়ানমার। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এসব সঙ্ঘাত ও খুনোখুনির ঘটনাগুলোর মাধ্যমে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে বোঝাতে চাচ্ছে যে, রোহিঙ্গারা উগ্র প্রকৃতির ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী। অথচ অনেকের মতে তাদেরই পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় ক্যাম্পগুলো সঙ্ঘাতপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ক্যাম্পগুলোতে সক্রিয় সন্ত্রাসী গ্রুপ ও উপগ্রুপগুলো মিয়ানমার থেকে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়। এসব সন্ত্রাসী গ্রুপের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠেছে মিয়ানমার সরকার। মিয়ানমার চায় না যে, রোহিঙ্গারা সঙ্ঘবদ্ধ হোক, কারণ এর ফলে প্রত্যাবাসনের জন্য চাপ তৈরি হবে ও রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে চাইবে। বিশ্বের দরবারে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসেবে তুলে ধরা, আন্তর্জাতিক আদালতে চলমান রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়াকে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করা এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বাধাগ্রস্ত করতে চায় মিয়ানমার। মিয়ানমারে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে অপরাধ ও মানবপাচারের ঘটনা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য হুমকিতে পরিণত হচ্ছে। মিয়ানমার ও বাংলাদেশের উপক‚ল থেকে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ায় রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশীদের মানবপাচার এখন একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে উঠেছে। মিয়ানমার থেকে অন্যান্য প্রতিবেশী দেশে অবৈধভাবে ইয়াবা পাচার উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। মিয়ানমারে স্থিতিশীলতা ফিরে না আসলে সংগঠিত অপরাধ দেশের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়বে এবং ক্রমবর্ধমানভাবে বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা হুমকির সৃষ্টি করবে (বার্তা২৪ ডট কম, ১১ মার্চ-২০২৩)।

২০১৭ সালে আরাকান থেকে বিতাড়িত রাষ্ট্রবিহীন সাড়ে সাত লাখ নারী, পুরুষ, শিশু, যুবা, বৃদ্ধ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার মানুষরা যে মানবিকতা, উদারতা ও সহৃদয়তার পরিচয় দিয়েছেন তা নজিরবিহীন। আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে ৬০ শতাংশ শিশু থাকায় স্থানীয়দের অন্তরে করুণার উদ্রেক হয়। স্থানীয় জনগণ তাদের জমি জমা ও পশুচারণভূমি শরণার্থীদের অনুক‚লে ছেড়ে দেন। টেকনাফ-উখিয়ায় ৩৮টি রোহিঙ্গা শিবির স্থাপিত হয়। প্রথম প্রথম মিয়ানমার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আসা বিধ্বস্ত শরণার্থীদের খাবার রান্না করে পরিবেশনের ব্যবস্থা করা হয় স্থানীয়দের ব্যবস্থাপনায়। দুই বছরের ব্যবধানে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া প্রলম্বিত হওয়ায় এবং দু’বার প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় স্থানীয়দের সাথে রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে চিড় ধরেছে। তৈরি হয়েছে ক্ষোভ, আস্থাহীনতা ও সন্দেহ। কিছু রোহিঙ্গার বেপরোয়া আচরণ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড স্থানীয় জনগণের মনে আতঙ্ক জন্ম দিয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়ে মানবিক আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এই দেশের নিরাপত্তার জন্য ক্রমেই হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। স্থানীয় জনগণের কাছে এখন রোহিঙ্গা মানে ‘বিষফোঁড়া’।

কুতুপালং, বালুখালি, ময়লার ঘোনা ও কেরণতলি এলাকার বন ও পাহাড় কেটে রোহিঙ্গাদের বসতি গড়ে তোলায় কক্সবাজার দক্ষিণ বিভাগের ছয় হাজার একর এলাকা ধ্বংস হয়ে গেছে। টাকার হিসেবে ক্ষতি হয়েছে দ্ইু হাজার কোটি টাকা। বন উজাড় হয়েছে ৪৫৬ কোটি টাকা আর জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা। নতুন ও পুরনো মিলিয়ে টেকনাফ ও উখিয়ায় ১১ লাখ ১৯ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। একটি ছোট্ট আয়তনে এতগুলো মানুষের অবস্থানের কারণে পরিবেশ ও প্রতিবেশ বিপন্ন হওয়ার উপক্রম। এই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে বন বিভাগ সাত বছরের একটি বনায়ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ১৩ হাজার একর জমি ও পাহাড় এই প্রকল্পের আওতায় এনে নতুন বন সৃজন করা হবে। নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানীয়রা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন। ৩০ হাজার রোহিঙ্গা সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে কাজ করে কম রেটে। যা পাওয়া যায় তা তাদের লাভ। এতে স্থানীয় শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত থাকছে।

টেকনাফ-উখিয়ায় স্থানীয় জনগণের সংখ্যা সাড়ে পাঁচ লাখ। রোহিঙ্গা আগমনের কারণে তারা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়। সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিকেলবেলা ক্যাম্প থেকে কক্সবাজার ফিরে আসেন। পরদিন আবার ৯টায় কর্মস্থলে যোগ দেন। ফলে রাতের বেলা রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো থাকে অরক্ষিত। অপরাধ সংঘটিত হয় রাতের বেলা। কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করলেও সশস্ত্র গ্রুপ রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে কিন্তু সক্রিয়। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে কিছু জায়গা আছে ঘিঞ্জি, পথগুলো বেশ সরু ও সঙ্কীর্ণ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে ওখানে রাতের বেলা পৌঁছানো সম্ভব নয়; নিরাপদও নয়। প্রতিটি ক্যাম্পে এক লাখেরও অধিক কিশোর-কিশোরী রয়েছে যাদের বয়স ১২ থেকে ১৭। ঘুম থেকে উঠেই ঘুরে বেড়ানো ও আড্ডায় মেতে ওঠা ছাড়া এদের কোনো কাজ নেই। মাদরাসা ও স্কুল থাকলেও তারা পড়ালেখা করতে আগ্রহী নয়। বেকার থাকায় তারা যেকোনো সময় অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে। প্রশাসন এসব তরুণদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।

সব রোহিঙ্গা খারাপ, অপরাধী বা অকৃতজ্ঞ এ কথা ঠিক নয়। তাদের মধ্যে অনেক ভালো, ভদ্র, শালীন ও বিবেচনাবোধসম্পন্ন মানুষ আছেন। সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, দীক্ষা ও প্রশিক্ষণ না থাকায় অধিকাংশ রোহিঙ্গারই জীবনাচারে আইন না মানা ও ঔদ্ধত্যের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। দুনিয়ার খবরাখবর থেকে তারা বিচ্ছিন্ন। সংবাদপত্র পাঠ ও টিভির সংবাদ দেখারও ব্যবস্থা নেই। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগেই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। স্থানীয়দের সর্বোচ্চ ত্যাগ ও ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। উসকানির মুখে শান্ত থাকতে হবে। উপকার করতে গেলে কিছুটা ক্ষতি স্বীকার করতে হয়, এটি মানতে হবে। রোহিঙ্গারা আমাদের প্রতিবেশী দেশের রাখাইন সন্ত্রাসীদের অমানবিক নির্যাতনের শিকার। বাস্তুভিটা, সহায় সম্পদ ও আপনজন হারিয়ে তারা আমাদের দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের প্রতি আমাদের সহমর্মিতা অটুট থাকুক।

রাখাইন জনগোষ্ঠীর নির্মম নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞের (Ethninc Cleansing) হাত থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের রক্ষায় আরাকানে জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে বহুজাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা জরুরি। এ দাবিতে মুসলিম দেশগুলোকে সোচ্চার হতে হবে। ওআইসির মূলত কোনো ক্ষমতা নেই, কার্যকর উদ্যোগও নেই।

একমাত্র তুরস্ক ও মালয়েশিয়া রোহিঙ্গাদের নির্মূল অভিযান বন্ধ করাতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে, তবে তুরস্ক সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত অভ্যন্তরীণ ঘটনায় নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে ও আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশ সরকারেরও উদ্যোগ নেয়ার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ মিয়ানমারের প্রতিবেশী। মিয়ানমারের সাথে রয়েছে বাংলাদেশের ১৯৩ কিলোমিটার সীমান্ত। ১১ লাখের থেকেও বেশি রোহিঙ্গা নারী-শিশু সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আর্থসামাজিক, পরিবেশ ও প্রতিবেশগত কারণে শরণার্থীদের পাইকারে হারে গ্রহণের সুযোগ বাংলাদেশের নেই। এটি সমস্যার সমাধান নয়। মিয়ানমার সরকার সব সময় বলে আসছে, রোহিঙ্গারা বর্মি নয়, বাঙালি। অতএব তাদের সীমান্তের এপারে ঠেলে দিতে পারলেই তারা বাঁচে। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ আরাকানে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের নিশ্চয়তা দিতে মিয়ানমার সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে।

রোহিঙ্গা নির্যাতন, দমনপীড়ন বন্ধ ও বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী শরণার্থীদের রাখাইন রাজ্যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে মিয়ানমার সরকারকে বাধ্য করতে হবে। জাতিগত নিধন বন্ধে বিশ্ববিবেককে জাগ্রত হতে হবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক পন্থায় মিয়ানমারের ওপর জোরালো চাপ প্রয়োগ করতে হবে। মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশ সব সময় সৎপ্রতিবেশীসুলভ আচরণ করে আসছে এবং বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরো জোরদার করার পক্ষপাতী। বাংলাদেশ জানিয়ে দিয়েছে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বিচ্ছিন্নতাবাদী কোনো সদস্যকে বাংলাদেশ আশ্রয় দেবে না। বাংলাদেশের এ উদার মানসিকতাকে মিয়ানমার সরকার দুর্বলতা ভাবলে ভুল হবে। আমরা রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান কামনা করি।

লেখক : অধ্যাপক ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com