Naya Diganta

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ হোক

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ হোক।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর পূর্ণ হয়েছে এরই মধ্যে। যুদ্ধ এখনো চলছে এবং বন্ধের আশু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে অনেক মানুষ মারা গেছে, আহত ও পঙ্গুত বরণ করেছে, হাজারো বাড়িঘর স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। এই যুদ্ধ কারো জন্য সুফল বয়ে আনেনি, ভবিষ্যতেও আনবে না। এই যুদ্ধে কেউ জিতবে না এবং যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়। তাই আলোচনার টেবিলে বসে সমস্যার সমাধান করা ও শান্তি প্রতিষ্ঠাই উত্তম। এজন্য জাতিসঙ্ঘ, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইউক্রেনসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তবে সবার আগে উদ্যোগ নিতে হবে যুদ্ধে সরাসরি জড়িত দেশ দুটিকেই। বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষরা যুদ্ধ বিগ্রহ চায় না। তারা সবাই মিলেমিশে শান্তিতে বসবাস করতে চায়।

রাশিয়া ও ইউক্রেন প্রতিবেশী দুটি দেশ। ইউক্রেন একসময় সাবেক সোভিয়েত ইঊনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইঊনিয়ন থেকে ইউক্রেন স্বাধীনতা অর্জন করে। দুটি দেশই আয়তনে অনেক বড়। রাশিয়ার আয়তন ১ কোটি ৭১ লাখ বর্গ কিলোমিটার। ইউক্রেনের ৬ লাখ ৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার। দেশ দুটির মধ্যে ২,২৯৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। ইতোমধ্যেই রাশিয়া ইউক্রেনের কয়েকটি এলাকা দখল করেছে। দখলকৃত এলাকার পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার বর্গ কিলোমিটার। ন্যাটোতে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্তিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে দীর্ঘদিন ধরেই রাশিয়ার সাথে মতবিরোধ চলছে। চলমান এই উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে রাশিয়া ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করে। তখন থেকেই যুদ্ধ চলছে। ইতোমধ্যেই ইউক্রেনের কয়েকটি শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ইউক্রেনের প্রায় ১০ লাখ মানুষ অন্য দেশে শরণার্থীর জীবন যাপন করছে। ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণে রাশিয়ারও অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। রাশিয়ার অনেক সেনাসদস্য ও লোকজন এই যুদ্ধে নিহত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক সহযোগিতা দিচ্ছে। বরাবরের মতোই এই যুদ্ধে বিশ্ব আবারো দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্ররা রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে। অন্যদিকে রাশিয়ার পক্ষের রাষ্ট্রগুলো যুক্তরাষ্ট্রের এসব অবরোধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ফলে রাজনৈতিক বিভক্তির পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনৈতিকভাবেও বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই যুদ্ধের কারণে ইতোমধ্যেই বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের পণ্যসামগ্রীর দাম অনেক বেড়ে গেছে। ফলে বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। বিশ্বে সৃষ্টি হয়েছে নতুন এক সঙ্কট এবং নতুন এক অস্থিরতা। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্বে নিয়োজিত জাতিসঙ্ঘ বরাবরের মতোই এই যুদ্ধ বন্ধে এখন পর্যন্ত ব্যর্থ।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনেস্কি যুদ্ধ শুরুর পর বিভিন্ন সময়ে কয়েকটি মিত্র দেশের পার্লামেন্টে সহযোগিতা চেয়ে অনলাইনে ভাষণ দিয়েছেন। তিনি ২০২২ সালের ২১ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ২০২৩ সালের ২২ জানুয়ারি ইউক্রেন সফর করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত ২০ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন সফর করেন। বাইডেনের ইউক্রেন সফরের পরপরই অর্থাৎ ২০২৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি চীনের শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই রাশিয়া সফর করেন। তিনি রাশিয়ার নেতাদের সাথে বৈঠক করেন এবং এ সফরের পর তিনি রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ১২ দফা শান্তি পরিকল্পনা পেশ করেন। এদিকে এসব সফরের পরপরই সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান ২৬ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন সফর করেন। তিনি এ সময় ইউক্রেনকে ৪০ কোটি ডলারের সহায়তার কথা ঘোষণা করেন। ১৯৯১ সালে ইউক্রেন স্বাধীন হওয়ার পর এটি হচ্ছে ইউক্রেনে কোনো সৌদি মন্ত্রীর প্রথম সফর। এভাবেই বিভিন্ন রাষ্ট্র নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই যুদ্ধকে মূল্যায়ন করছে এবং যুদ্ধ বন্ধ না করে তার মিত্রপক্ষের পাশে দাঁড়িয়েছে। মিত্রপক্ষকে সাহায্য করছে। ফলে এই যুদ্ধ এখন আর রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি এখন বহুপক্ষীয় যুদ্ধের রূপ নিয়েছে এবং পরাশক্তিগুলো যুদ্ধের অংশে পরিণত হয়েছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বে চলমান যুদ্ধগুলোর সাথে আরেকটি নতুন সংযোজন। দীর্ঘদিন ধরেই পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশের মধ্যে একাধিক যুদ্ধ চলছে। লিবিয়ায়, সিরিয়ায় এবং ইয়েমেনে যুদ্ধ চলছে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। যুদ্ধে যুদ্ধে এসব দেশ আজ ধ্বংসের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে। অথচ এসব দেশ একসময় অনেক উন্নত এবং শান্ত ছিল। দেশগুলো আজ বহু ভাগে বিভক্ত এবং এক এক এলাকায় চলছে এক এক গোত্রের শাসন। দেশব্যাপী একক সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই এবং সার্বভৌমত্ব আজ দুর্বল হয়ে পড়েছে। সাধারণ জনগণের জীবনে আজ কষ্টের শেষ নেই। দীর্ঘদিন যুদ্ধ চলেছে ইরাকে এবং আফগানিস্তানে। ইরাকে প্রায় এক দশক এবং আফগানিস্তানে প্রায় চার দশক ধরে যুদ্ধ চলেছে। এ দুটি দেশে লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে। আফগানিস্তানের প্রায় চল্লিশ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। বর্তমানে এ দুটি দেশে যুদ্ধ বন্ধ হলেও পুরোপুরি শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা যুদ্ধে এসব দেশ কেবল ধ্বংস হয়েছে। যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায় শিশু, মহিলা এবং বয়স্ক মানুষরা। যুদ্ধের কারণে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখাও বন্ধ হয়ে যায়। জাতিসঙ্ঘের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে বিশ্বে উদ্বাস্তুর সংখ্যা এখন প্রায় ছয় কোটি। এসবই হলো যুদ্ধের উপহার এবং অর্জন। মূলত যুদ্ধে ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই অর্জন হয় না। যুদ্ধের ফলে কোনো একটি স্থাপনা যখন ধ্বংস হয় তখন তার পুরোটাই ক্ষতি। আবার এই স্থাপনা ধ্বংসে যে অস্ত্র ব্যবহৃত হয় তাও ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে এটাও ক্ষতি। এসব যুদ্ধাস্ত্রের মূল্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। এই অর্থ অস্ত্র ও যুদ্ধের পিছনে ব্যয় না করে মানবতার কল্যাণে ব্যবহার করা হলে পৃথিবী থেকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অশিক্ষা বহু আগেই দূর হয়ে যেত। পৃথিবীজুড়ে শান্তি বিরাজ করত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ও জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যৎ বিশ্বকে যুদ্ধমুক্ত করার প্রত্যয়ে ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ইতোমধ্যেই জাতিসঙ্ঘের ৭৭ বছর পূর্ণ হয়েছে। প্রতি বছর জাতিসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে জাতিসঙ্ঘে সম্মেলন হয় এবং এতে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান তাদের বক্তৃতায় বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। কিন্তু বাস্তবে যুদ্ধ বন্ধ হয় না এবং শান্তিও প্রতিষ্ঠা হয় না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, জাতিসঙ্ঘ বিভিন্ন দেশের মাঝে বিদ্যমান যুদ্ধ বন্ধে বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া এবং ইয়েমেনের চলমান যুদ্ধ জাতিসঙ্ঘ বন্ধ করতে পারেনি। কয়েক দশক ধরে চলে আসা ফিলিস্তিনের ওপর ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধেও শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ফিলিস্তিনের হাজারো মানুষ বছরের পর বছর ধরে উদ্বাস্তু শিবিরে বসবাস করছেন। এদের অনেকেই উদ্বাস্তু শিবিরেই জন্মেছেন, উদ্বাস্তু শিবিরেই বড় হয়েছেন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নিজভূমিতে প্রত্যাবাসনেও জাতিসঙ্ঘ ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসঙ্ঘ বিভিন্ন যুদ্ধ বন্ধ করতে পারেনি। কারণ, বৃহৎ শক্তিবর্গ কখনোই নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করেনি এবং জাতিসঙ্ঘের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স হচ্ছে জাতিসঙ্ঘে ভেটো ক্ষমতার অধিকারী পাঁচটি দেশ। এরা নিজেদের ইচ্ছাবিরোধী সব প্রস্তাব ভেটো প্রয়োগে বরাবরই নাকচ করে দিয়েছে। ফলে কোনো এলাকায় যুদ্ধ শুরু হলে তা বন্ধের জন্য জাতিসঙ্ঘ কখনোই সর্বসম্মতভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ফলে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয়েছে এবং সাথে প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞ বেড়েছে।

বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ১৯৫টি স্বাধীন রাষ্ট্র রয়েছে, যারা সবাই জাতিসঙ্ঘের সদস্য। এসব রাষ্ট্রের সবার আর্থসামাজিক অবস্থান সমান নয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে কোনোটা অনেক বেশি শক্তিশালী আবার কোনোটা একেবারেই দুর্বল। কিন্তু সব রাষ্ট্রের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বকে সম্মান করতে হবে এবং এর মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। একইভাবে সব দেশের সব মানুষেরই স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। মানুষের সার্বজনীন এই অধিকার জাতিসঙ্ঘ-স্বীকৃত।

আইনের দৃষ্টিতে সবার অধিকার সমান এবং তা নিশ্চিত করতে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সমঝোতা ও ঐক্য প্রয়োজন। কোনো একটি ইস্যুতে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো যদি বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে তাহলে কখনোই সমাধান আসবে না। আধিপত্য বিস্তারের জন্য যুদ্ধ নয় বরং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
আজ যুদ্ধ করতে হবে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা এবং রোগ জীবাণুর বিরুদ্ধে। পৃথিবীর শতকোটি মানুষ এখনো দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে। অস্ত্র নির্মাণে অর্থ ব্যয় না করে সেই অর্থ আজ এসব মানুষের জীবন মান উন্নয়নে ব্যয় করতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আজ যেসব মানুষ শরণার্থী হিসেবে উদ্বাস্তু শিবিরে বসবাস করছে, তাদের নিজ নিজ দেশে নিজ আবাসভূমিতে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে হবে। মানবিকতাকে ছড়িয়ে দিতে হবে সবখানে। রোগব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। পৃথিবীর বিরাট এলাকার মানুষ আজ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতির মুখোমুখি। এসব মানুষের পাশে দাঁড়ানোই হবে সত্যিকারের মানবিকতা।

লেখক : প্রকৌশলী এবং উন্নয়ন গবেষক
ই-মেল: omar_ctg123@yahoo.com