Naya Diganta

গ্রীষ্মের আগেই সুপেয় পানির সঙ্কটে উপকূলের মানুষ

বেশিরভাগ নলকূপ কাজ করে না

তীব্র গরম পড়ার আগেই বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা ও এর আশপাশের উপকূলীয় অঞ্চলে নিরাপদ পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। গ্রীষ্মের তাপদাহ বাড়ার সাথে সাথে এই সঙ্কট আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের।

গত বছর বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় এবারে শীতের পর থেকেই খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও এর আশপাশের অঞ্চলের গভীর নলকূপ থেকে আর পানি উঠছে না। সুপেয় পানির অন্য উৎসগুলোয় ছড়িয়ে পড়েছে লবণাক্ততা।

আবার লবণ পানি পরিশোধন করতে যে ফিল্টারগুলো বসানো হয়েছিল, সেগুলো অকেজো হয়ে পড়ায় কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করা।

খাবার পানি সংগ্রহে মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অপরিকল্পিতভাবে ভূগর্ভের পানি উত্তোলন ও লবণাক্ততার সমস্যা দূর করতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যেসব উদ্যোগ হাতে নেয়া হয়েছে, সেগুলো তদারকি না করার ফলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের জেলা পর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী, খুলনার ২২ ভাগ, বাগেরহাটের ১৫ ভাগ ও সাতক্ষীরার ১৩ ভাগ মানুষ খাবার পানির সঙ্কটে রয়েছে।

পরিবেশবাদীরা বলছে, সরকারিভাবে এই তথ্য দেয়া হলেও বাস্তবের চিত্র আরো ভয়াবহ।

ওয়াসার পানি নিয়ে সংশয়

খুলনা মহানগরীর ৩৮ হাজার বাড়িতে পানি সরবরাহ করে আসছে খুলনা ওয়াসা। ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমাতে ২০১৯ সালে গোপালগঞ্জের মধুমতী নদী থেকে পানি এনে পরিশোধন করে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।

নগরবাসী নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করলেও এই পানি পান করা কিংবা রান্নার কাজে ব্যবহার করা নিয়ে তারা সংশয়ে থাকেন। কারণ এই পানি হয়ে পড়েছে ঘোলা ও লবণাক্ত।

খুলনা ওয়াসার দাবি, তারা সম্পূর্ণ পরিশোধিত পানি সরবরাহ করছে। সঞ্চালন লাইনে লিকেজের কারণে বাসাবাড়িতে পৌঁছানোর সময় পানি লবণাক্ত ও দূষিত হয়ে পড়তে পারে বলে তারা ধারণা করছে।

এমন অবস্থায় বিশুদ্ধ পানির জন্য নলকূপের পানির ওপরই ভরসা করার কথা জানিয়েছে সাধারণ মানুষ।

খুলনা নগরীর বাসিন্দা শারমিন রহমান বলেন, ’পানি পাচ্ছি, কিন্তু এটা শুধু ফুটিয়ে খাওয়াটা কতটা নিরাপদ হবে জানি না। মাঝখানে কয়েক দিন পানি কিনে আনলাম। ওই পানিটা ডিপ টিউবওয়েল থেকে তোলা। শুধু খাওয়ার পানিটা নিয়ে আসি।’

খাবার পানি পেতে নগরবাসীদের অনেকেই শক্তিশালী সাবমার্সিবল পাম্প ব্যবহার করে পানি উত্তোলন করছে। এটা শুধুমাত্র বহুতল ভবনের মালিকদের বাস্তবতা। নগরের নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোকে ওয়াসার পানির ওপরেই নির্ভর করতে হচ্ছে।

অন্যদিকে, উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষদের এখনো দৈনন্দিন কাজে ও সুপেয় পানির জন্য নির্ভর করতে হয় পুকুর ও বৃষ্টির পানির ওপর।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অনিয়ন্ত্রিত চিংড়ি চাষ, চিংড়ি ঘেরে উঁচু বাঁধ না দেয়া, নদী প্রবাহ আটকে দেয়া, পুকুর ভরাট, খাল বেদখলের কারণে প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষগুলো নিরাপদ পানির তীব্র সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে দিন পার করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সাধারণত শীতের মৌসুম থেকে বর্ষা আসার আগ পর্যন্ত একটা লম্বা সময় এই দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় উপকূলের সাধারণ মানুষকে।

নলকূপে পানি নেই
ওয়াসার পানি আসার আগে খুলনা নগরীর মানুষ মূলত মোটরচালিত-নলকূপের মাধ্যমেই পানি উত্তোলন করে ব্যবহার করত। কিন্তু যত্রতত্র পানি তোলার কারণে মহানগরীর ওই নলকূপগুলোয় বর্তমান শুষ্ক মৌসুমে আর পানি তোলা যাচ্ছে না। শুধুমাত্র যারা গভীর নলকূপের সাথে সাবমার্সিবল পাম্প ব্যবহার করছে, তারাই কিছুটা পানি পাচ্ছে।

একে অনাবৃষ্টি তার ওপর অপরিকল্পিতভাবে ভূগর্ভের পানি তোলার কারণে গত বছর খুলনার পানির স্তর স্বাভাবিকের চেয়ে ২৫ থেকে ৩০ ফুট পর্যন্ত নীচে নেমে গেছে বলে জানা যায়।

যার ফলে চলতি শুষ্ক মৌসুমে পানির ভয়াবহ সঙ্কট তৈরি হয়েছে, যা সামনে আরো বাড়তে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।

খুলনার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সুশীলনের সমন্বয়কারী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘মানুষ প্রচুর পরিমাণে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে ফেলছে। এ কারণে মাটির নিচে পানির প্রবাহ আর আগের মতো নেই।’

জাতিসঙ্ঘের এক সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের দিক দিয়ে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন বিশেষ করে বোরোর আবাদ প্রধানত সেচ নির্ভর।

দীর্ঘসময় অনাবৃষ্টির কারণে নদী-নালা ও খালে-বিলে পানি না থাকায় চলতি বোরো আবাদে সেচ দিতে হচ্ছে শুরু থেকেই।

চাষাবাদে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ওপর মানুষের নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় পানির স্তর আরো নিচে নেমে গেছে।

এ ব্যাপারে বাগেরহাটের বাসিন্দা মো: আরজ আলী বলেন, ‘আমাদের এখানে টিউবওয়েলে পানি ওঠেনা। মাঠঘাট শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে। এ বছর পানির অভাবে কৃষকরা হালচাষ করতে পারছে না, ধানের চারা রোপণ করতে পারছে না। পানির অভাবে ও লবণে ফসল সব মরে যাচ্ছে।’

পানির পেছনে যাচ্ছে হাজার হাজার টাকা

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় নলকূপের গভীরতা ৭০০ থেকে ১২০০ ফুটের মধ্যে হয়ে থাকে।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ১২০০ ফুট গভীর নলকূপ থেকেও তারা আর পানি তুলতে পারছে না। এতে সুপেয় পানির সঙ্কটে পড়েছে সাধারণ মানুষ।

সবচেয়ে বেশি বিপাকে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা। খাবার পানির জন্য তাদের দূর-দূরান্তের জলাশয়ের দিকে ছুটতে হচ্ছে। না হলে প্রতিদিনের পানি কিনে নিতে হচ্ছে।

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগর এলাকার বাসিন্দা ধনঞ্জয় বৈদ্য প্রতিমাসে তিন হাজার টাকার পানি কিনে থাকেন।

তিনি বলেন, ‘রান্নাবান্নার পানি অনেক দূর থেকে আনা লাগে। আমি বাসায় নলকূপ বসিয়েছি কিন্তু কোনো পানি ওঠে না। সাইকেলে করে দূর থেকে পানি আনা লাগে। গোসলের পানি, ধোয়া-মোছার পানিও খুব কষ্ট কর সংগ্রহ করতে হচ্ছে। পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে গোসল করার মতো পানি নেই। খাওয়ার পানি বেশিরভাগ কিনতে হচ্ছে। আমার পাঁচজনের ফ্যামিলিতে পানি কিনতেই মাসে তিন হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়।’

টানা অনাবৃষ্টির ফলে এই ভূগর্ভস্থ পানি আর রিচার্জ হচ্ছে না।

দ্রুত বৃষ্টিপাত না হলে পানির স্তর আরো নিচে নামবে এবং তাতে উপকূলের নলকূপ দিয়ে পানি না ওঠার পরিস্থিতি তৈরি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

পুকুরগুলোর কী অবস্থা?

পরিবেশবাদীরা বলছে, ভূগর্ভের পানির স্তর নেমে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ ভূ-উপরিভাগের পানির উৎসগুলো শুকিয়ে যাওয়া।

ইতোমধ্যে বহু পুকুর ভরাট হয়ে গেছে, আশপাশের গ্রামে যে কয়েকটি মিঠা পানির পুকুর রয়েছে সেগুলোর পানি শুকিয়ে গেছে। নদী ও খালগুলো দখল হয়ে যাওয়ায় পানি প্রবাহ কমে গেছে। সব মিলিয়ে ভূ-পৃষ্ঠের সুপেয় পানির উৎসগুলো কমে যাচ্ছে।

উপকূলের বেশিরভাগ পুকুর ব্যক্তি মালিকানাধীন। সরকারি পুকুরের সংখ্যাও হাতে গোনা। এ অবস্থায় ওই পুকুরগুলোয় সকাল থেকেই লাইন পড়ে যায় পানি-পীড়িত এলাকার মানুষদের।

শুষ্ক মৌসুমে এসব হাতে গোনা কয়েকটি সংরক্ষিত পুকুর থেকে এক কলসি পানি সংগ্রহের জন্য কয়েক কিলোমিটার দূরের আরেক গ্রামে ছুটছে তারা।

তেমনই একজন মনিরা বেগম। তিনি জানান, ‘প্রতিদিন পানি আনতে তাকে অন্তত এক ঘণ্টা পায়ে হাঁটা লাগে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে পানি সংগ্রহ করতে হয়। পানি আনতেই বেলা ফুরিয়ে যায়। বাসাবাড়িতে খাবার পানি নেই, রান্নার পানি নেই, নেই গোসলের পানি। এক ড্রাম পানি ৩০ টাকা দিয়ে কিনে খাওয়া লাগে।

এদিকে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন পুকুরগুলো সংরক্ষণ না করায় সেগুলোর পানিও ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সুশীলনের সমন্বয়কারী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘একটি পুকুরে প্রতি পাঁচ বছরে এক ফুট করে পলি পড়ে। এই পলিগুলো বছরের পর বছর খনন করা না হলে ওই পানি আর ব্যবহার করা যায় না। ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুরগুলোর বেশিরভাগ খনন ছাড়াই পড়ে থাকে।’

লবণাক্ততা

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খুলনার চার উপকূলীয় উপজেলার নলকূপ, নদী, পুকুর ও খাল-বিলে লবণাক্ততার পরিমাণ গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। ২০২১ সালে জাতিসঙ্ঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এক জরিপে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

ওই জরিপের তথ্য মতে, উপকূলীয় এসব উপজেলার মানুষের প্রতি লিটার খাবার পানিতে ১৫০০-২৪০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণাক্ততা পাওয়া গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার গ্রহণযোগ্য মাত্রা প্রতি লিটারে ১০০০ মিলিগ্রাম। এর বেশি লবণাক্ততা থাকা মানে তা খাওয়ার অনুপযোগী।

আবার চিংড়ি ঘেরে উঁচু বাঁধ না দেয়ায় সেখানকার লবণাক্ত পানি পুকুরে ঢুকে পড়ছে এবং ওই পানিও আর খাওয়ার উপযোগী থাকছে না।

এমন অবস্থায় পুকুর নিয়মিত খননের পাশাপাশি লবণ পানি শোধনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলে মনে করছে পরিবেশবাদীরা।

সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘বেড়িবাঁধ যদি ৩০-৩৫ ফুট উঁচু না হয় তাহলে লবণ ছড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু আমাদের এখানে বাঁধগুলো হয় পাঁচ ফুট থেকে সাত ফুট। তাই লবণাক্ততা আটকানো যাচ্ছে না।’

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটি ও অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষণায় বলা হচ্ছে যে মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের উপকূলের প্রায় দুই লাখ কৃষক বাস্তুচ্যুত হবে। কারণ সেখানকার মাটিগুলো ধান চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়বে।

জানা যায়, ২০০৯ সালে আইলা ও তার আগে সিডরের তাণ্ডবের পর থেকে এসব উপকূলীয় এলাকার সুপেয় পানির উৎসগুলো নষ্ট হয়ে যায়।

এসব এলাকায় সুপেয় পানি সমস্যার সমাধানে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে পুকুর খনন, নলকূপ স্থাপন, লবণ পানি পরিশোধন যন্ত্র পন্ডস অ্যান্ড ফিল্টার (পিএসএফ) স্থাপন এবং বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিংয়ের মতো প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও তেমন সুফল মেলেনি।

মেরামত ও সংরক্ষণ না করায় ইতোমধ্যে অধিকাংশ পিএসএফ নষ্ট হয়ে পড়েছে। এনজিওগুলো পৌর এলাকায় ওভারহেড ট্যাংকের মাধ্যমে পাইপলাইনে পানি সরবরাহ, রিভার্স অসমোসিস প্লান্ট, বায়ো স্যান্ড ফিল্টার বসানোর পর সেগুলোও নষ্ট হচ্ছে।

উপকূলীয় এলাকার মানুষকে বাঁচাতে সরকারিভাবে বড় ধরণের জলাধার বা পানির প্লান্ট নির্মাণ প্রয়োজন বলে মনে করছে স্থানীয়রা।

সূত্র : বিবিসি