Naya Diganta

আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে চলা ড্রাইভারবিহীন গাড়ির ভবিষ্যৎ কী?

যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েট শহরে চলছে চালকবিহীন গাড়ি

সানফ্রান্সিসকো শহরের একটি শান্ত আবাসিক এলাকায় মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। ভুল করে ঠিকমতো গাড়ির দরজা বন্ধ করা হয়নি। আমি এক বিরক্তিকর অনুভূতি নিয়ে ট্যাক্সি থেকে নেমে এসেছি।

অন্য কোনো সময় হলে আমি এটা নিয়ে মোটেই ভাবতাম না। কারণ এই ট্যাক্সির রাইডটি কোনো সাধারণ রাইড না। এটি ক্রুজ কোম্পানির একটি রোবট্যাক্সি। যার দরজা ঠিকভাবে বন্ধ করার জন্য কোনো মানুষ বা চালক নেই।

এরপর আমি চেক করতেই ফিরে গেলাম ও দেখলাম যে ঠিক তাই, ট্যাক্সির দরজাটা ঠিকমতো লাগানো হয়নি। ট্যাক্সির স্পিকার থেকে একটি মানুষের গলা শোনা গেল। সবকিছু ঠিক আছে? দরজা বন্ধ না করার জন্য আমি সরি বললাম এবং ট্যাক্সিকে প্রশ্ন করলাম, আমি যদি দরজাটা বন্ধ না করতাম তাহলে কী হতো? আমরা সেটার ব্যবস্থা করতাম বলে ট্যাক্সির স্পিকার আমাকে আশ্বস্ত করল।

চালকবিহীন রোবট্যাক্সি পরিষেবাগুলো এখন জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য চালু করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোর ব্যস্ত রাস্তায় সেগুলো চলাচল শুরু করেছে, যদিও বেশ সীমিত আকারে।

ক্রুজ হচ্ছে মার্কিন গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি জেনারেল মোটরসের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। এটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে ওয়েমোর সাথে, যেটি গুগলের মূল কোম্পানি অ্যালফাবেটের মালিকানাধীন।

ক্রুজের রোবট্যাক্সিগুলো গত জুন মাস থেকে ভাড়া খাটতে শুরু করেছে। এর ভাড়া উবার বা লিফটের থেকে একটু কম।

দু’টি কোম্পানির গাড়িতে চড়ে আমি সানফ্রান্সিসকো শহরের এখানে সেখানে ঘোরাঘুরি করি। ট্যাক্সির সামনে চালকের আসন খালি। স্টিয়ারিং হুইল একা একা ঘুরতে থাকে। গাড়ির ক্যামেরা, লেজার রশ্মির লিডার সিস্টেম এবং রাডার থেকে পাওয়া ডাটা ব্যবহার করে গাড়িটি চালায় আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) প্রযুক্তি।

আমি যেসব রাইডে চড়েছি সেগুলো বেশিরভাগই মসৃণ ও অটোনোমাস। গাড়িগুলো রাস্তায় সাইকেলচালক এবং পথচারীদের বাঁচিয়ে সতর্কভাবেই চলাচল করেছে। তবে আমি নিজে ড্রাইভ করার সময় যে স্পিডে গাড়ি চালাই তার তুলনায় এ রোবট্যাক্সিগুলো বেশ সতর্ক বলে মনে হয়। তবে যাত্রাপথের কিছু অংশে ট্যাক্সিগুলো অযথাই রাস্তায় বেশি ঘোরাফেরা করেছে।

রোবট্যাক্সিগুলো যখন রাস্তায় থাকে তখন পথচারীরা তাদের দেখে থমকে দাঁড়ায় এবং তাকিয়ে থাকে। তারা ছবি তোলে এবং এই চমকপ্রদ প্রযুক্তির ট্যাক্সির সাথে কথা বলে।

আমি যতবার এই রাইড ব্যবহার করেছি, ওই সময় বিশেষ কোনো ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু ট্যাক্সিগুলো রাস্তার মাঝখানে বিপজ্জনকভাবে হঠাৎই থেমে যায়। এতে সানফ্রান্সিসকো কর্মকর্তাদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

গত জানুয়ারি মাসে শহরটির কর্তৃপক্ষ ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের যানবাহন নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে বলেছে, ‘যতক্ষণ না তারা এসব সমস্যার সমাধান করবে, ততক্ষণ যেন তারা রোবট্যাক্সি কোম্পানিগুলোর সম্প্রসারণের পরিকল্পনা অনুমোদন না করে।’

বর্তমানে রোবট্যক্সিগুলো শুধুমাত্র শহরের কিছু অংশে চলাচল এবং বিশেষভাবে ডাউন-টাউন অর্থাৎ শহরের কেন্দ্রস্থলে যায় না। এসব ট্যাক্সি কোম্পানি এখন চায় আরো বেশি এলাকাজুড়ে তাদের পরিষেবা ছড়িয়ে দিতে এবং ট্যাক্সির সংখ্যা আরো বাড়াতে।

রোবট্যাক্সিগুলো রাত ১০টা থেকে ভোর সাড়ে ৫টার মধ্যে চলাচল করে। কিন্তু ক্রুজ কোম্পানি দিনের বেলাতেও তাদের পরিষেবা চালাতে আগ্রহী।

অন্য একটি কোম্পানি ওয়েমোকে ২৪ ঘণ্টা শহরে ট্যাক্সি চালানোর অনুমতি দেয়া হয়েছে এবং চালকবিহীন ট্যাক্সি ভাড়া খাটানোর জন্য কোম্পানিটি এখন সরকারি অনুমতির জন্য অপেক্ষা করছে।

চাহিদা বেশি থাকায় ওয়েমো বা ক্রুজ ট্যাক্সির রাইডগুলো ডাকতে মানুষকে ওয়েটিং লিস্টে নাম লেখাতে হচ্ছে।

অন্যদিকে, রোবট্যাক্সি কোম্পানিগুলো তাদের নানা ধরনের পরীক্ষামূলক প্রকল্প চালিয়ে যাচ্ছে। যেখানে অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচিত ব্যক্তিরা বিনামূল্যে রাইড ব্যবহার করতে পারবেন।

অন্যান্য যেসব শহরে এধরনের চালকবিহীন রাইড-হেইল সার্ভিস চালু হয়েছে, সেগুলো হলো অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের শহর ফিনিক্স (ওয়েমো ও ক্রুজ দু’টি কোম্পানি এখানে কাজ করছে) এবং টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের শহর অস্টিন (ক্রুজ)। দু‘টি কোম্পানিই আরো অনেক শহরে ব্যবসা চালু করার পরিকল্পনা করছে।

অন্যান্য অনেক কোম্পানিও এ ধরনের চালকবিহীন গাড়ি চালু করেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার গাড়ি নির্মাতা হুন্দাইয়ের সাপোর্ট নিয়ে কাজ করছে একটি কোম্পানি, নাম তার মোশনাল।

রাইড হেইলিং কোম্পানি উবার এবং লিফটের সাথে এর অংশীদারিত্ব রয়েছে। চলতি বছরেই লাস ভেগাসে তারা সীমিত আকারে এআই প্রযুক্তি-নিয়ন্ত্রিত চালকবিহীন ট্যাক্সি চালুর পরিকল্পনা করেছে।

তবে মানুষের যাতায়াতে এই উদ্ভাবনীর অগ্রগতি বেশ ধীর। অটোনোমাস ট্যাক্সির ব্যবসা আসলে লাভজনক হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

স্বল্প বেতনের ট্যাক্সি ড্রাইভারদের খরচের খাতায় লিখে দিতে এসব কোম্পানি অনেক অর্থ বিনিয়োগ করছে। আমার ট্যাক্সির দরজা ঠিক মতো বন্ধ না করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে এসব ট্যাক্সির অপারেশনগুলো সম্পূর্ণভাবে মানবমুক্ত করার লক্ষ্য এখনো অনেক দূরের ব্যাপার।

তবে ক্রুজের একজন মুখপাত্র আমাকে জানিয়েছেন যে দরজাটি সামান্য বন্ধ থাকলেও পরে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুরোপুরিভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু যদি অনেকটা খোলা থাকত তাহলে একজন মানুষকেই তা বন্ধ করতে হতো।

‘হালকাভাবে বললেও (অটোনোমাস ট্যাক্সির) অর্থনীতি এখনো কল্পনার ওপর ভর করে চলছে,’ বলেন হার্ভার্ড ল স্কুলের গবেষক অ্যাশলি নুনেস। তিনি এসব ট্যাক্সির ব্যবসায়িক দিক নিয়ে গবেষণা করেন।

ইউনিভার্সিটি অব সানফ্রান্সিসকো স্কুল অব ম্যানেজমেন্টের সহযোগী অধ্যাপক উইলিয়াম রিগস বলেন, রোবট্যাক্সির ব্যবসার সঠিক মডেলটি তৈরি করার কাজ বেশ ‘গুরুত্বপূর্ণ’ এবং এই মডেল তৈরি করা ‘প্রযুক্তির চেয়েও কঠিন’।

গত এক বছর বা তারও বেশি সময় ধরে অটোনোমাস ড্রাইভিংয়ের ক্ষেত্রটিতে বারবার করে পরিবর্তন ঘটছে। আর এ পরিবর্তনের পেছনে ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ব্যয় করা হয়েছে বলে অনুমান করা হয়।

২০১০ সালে কেউ কেউ ভেবেছিলেন, আমরা এখনকার সময়ের মধ্যেই আমাদের বেশিরভাগ যাতায়াত অটোনোমাস গাড়িতেই করব। কিন্তু সেটা ঘটেনি।

দুই গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি ফোর্ড ও ভক্সওয়াগন একটি সেলফ-ড্রাইভিং টেক স্টার্ট-আপ আরগো এআইতে বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু গত বছরের শেষের দিকে সেটি বন্ধ হয়ে গেছে।

অনেক গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি বলছে যে ব্যক্তিগত অটোনোমাস গাড়ি, যেটি যাত্রীরা সীমাবদ্ধতা ছাড়াই ব্যবহার করতে পারবেন, সেটা অনেক দূরের ব্যাপার। এর বদলে তারা এখন মনোযোগ দিচ্ছেন অত্যাধুনিক ড্রাইভার অ্যাসিসট্যান্স প্রযুক্তির দিকে।

অটোনোমাস শাটল সার্ভিস, যেগুলো নির্দিষ্ট রুটে চলাচল করবে, ওই ধরনের সীমিত পরিষেবার দিকে ব্রিটেনের সরকারসহ অন্যদের মনোযোগ এখন বাড়ছে।

কিন্তু ক্রুজ ও ওয়েমো তাদের পরিকল্পনা থেকে একটুও সরে আসেনি। তারা আরো বেশি করে বিনিয়োগ করছে এবং ধীরে ধীরে অগ্রগতি অর্জন করছে বলে মনে হচ্ছে।

ফিনিক্স শহরে ক্রুজ রাইড-হেইল ও ‘লাস্ট-মাইল’ অর্থাৎ ডেলিভারির শেষ ধাপে চালকবিহীন গাড়ির মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছে মাল পৌঁছে দেয়ার ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হচ্ছে। অন্যদিকে, ওয়েমো দূরপাল্লার রুটের জন্য অটোনোমাস ট্রাক তৈরি করছে।

অটোনোমাস ট্যাক্সির সুবিধাগুলো মানুষের কাছে অনেক বেশি নিরাপদ। যদিও এটি এখনো প্রমাণিত হয়নি। এটি অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য ও আরামদায়ক। কারণ এখানে ড্রাইভারের সাথে যাত্রীকে বকবক করতে হয় না। তবে এসব সুফল পেতে এ সার্ভিসকে আর্থিকভাবে টেকসই হতে হবে।

নুনেসের বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছিল ২০২০ সালে। কিন্তু তিনি এখনো বিশ্বাস করেন যে সমস্যাগুলো দূর করা যায়নি। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, অটোনোমাস রাইড-হেইলিং সম্পর্কে অনেক আশার কথা বলা হলেও একে ব্যবসায়িক দিক থেকে এখনো লাভজনক করা যায়নি।

এর পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, পর্দার আড়ালে হলেও এই প্রযুক্তিতে এখনো মানুষের প্রয়োজন রয়েছে। অটোমেশনের ফলে যে শ্রম দরকার তার ধরনটি বদলে যায়। কিন্তু মানুষের শ্রমের প্রয়োজনীয়তা এটি দূর করতে পারে না।

পরিবহন বিষয়ক কনসালট্যান্ট নিক রিড বলেছেন, রোবট্যাক্সি সার্ভিসের জন্য প্রয়োজন হবে কাস্টমার সাপোর্ট অ্যাজেন্ট। গাড়ি কোথায় আছে তা জানার জন্য দরকার হবে ফ্লিট অপারেটর। এসব গাড়ির যান্ত্রিক সমস্যার সমাধানে লাগবে ইঞ্জিনিয়ারদের। এর পাশাপাশি বিকল গাড়িগুলোকে উদ্ধার করা, সেগুলোকে পরিষ্কার রাখা এবং এর ব্যাটারিগুলো চার্জ করার জন্যও লোকের প্রয়োজন হবে।

দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, অনেক সময়ই ভাড়া না পেয়ে ট্যাক্সি খালি বসে থাকে। যদিও এর জন্য ড্রাইভারকে অর্থ দেয়ার বিষয়টা আর থাকবে না, কিন্তু অটোনোমাস ট্যাক্সি ব্যবসার পেছনে যেসব লোক কাজ করবেন তাদেরকে তখনো পয়সা দিতে হবে।

তবে এসব কোম্পানি এখনো আত্মবিশ্বাসী যে তারা ব্যবসার পরিধি বাড়াতে পারবে এবং লাভজনক হতে পারবে।

ক্রুজের রাইড-হেইল বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট মেগান প্রিচার্ড জানান, তারা ‘অরিজিন’ নামে নতুন ধরনের একটি গাড়ির ওপর কাজ করছেন।

এ গাড়িটি অটোনোমাস পিপল মুভার (মাইক্রোবাস), যাতে কোনো স্টিয়ারিং হুইল বা চালকের জন্য জায়গা নেই। এই ট্যাক্সিতে যাত্রীদের জন্য সিট রয়েছে ছয়টি। অরিজিনের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হবে খুব শিগগিরই।

ক্রুজ আশা করছে, এ বছরেই যুক্তরাষ্ট্রে রাইড-হেইলিংয়ের জন্য এই ট্যাক্সির ব্যবহার শুরু হবে। পরে দুবাই শহরে এসব ট্যাক্সি ভাড়ায় চলবে। ওয়েমোও একই ধরনের একটি গাড়ি তৈরি করছে, যার নাম ‘জিকর’।

ক্রুজের অরিজিন গাড়ি মিশিগানে জিএমের ডেডিকেটেড ইলেকট্রিক ভেহিকল অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্টে ব্যাপক সংখ্যায় নির্মিত হবে বলে এর উৎপাদন ব্যয় হবে ‘অনেক কম’, বলেন মিজ প্রিচার্ড।

এই গাড়ি রাইড শেয়ারিংয়েরও সুযোগ খুলে দেবে। অর্থাৎ একই রুটে অনেক যাত্রী এটি ব্যবহার করতে পারবেন।

এর মাধ্যমে প্রতিটি গাড়ির সর্বোচ্চ ব্যবহার হবে এবং যাত্রীদের মাথাপিছু ভাড়াও কমে যাবে।

আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এ ধরনের হাজার হাজার গাড়ি রাস্তায় নামানো হবে বলে মিজ প্রিচার্ড আশা করছেন।

তিনি আরো বলেন, তাদের কোম্পানি মানুষ ও অটোনোমাস গাড়ির অনুপাত কমিয়ে আনতেও কাজ করছে। তখন অরিজিনের দরজাগুলো দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করে বন্ধ করা যাবে।

এ নিয়ে অনেকের মনে এখনো সংশয় রয়ে গেছে, বলেন নুনেস। তাদের যুক্তি, আগেও যাত্রীরা অপরিচিত লোকের সাথে ট্যাক্সি শেয়ার করতে চায়নি, এখনো চায় না।

রাইড শেয়ারিংয়ের দুনিয়ায় গাড়িতে এমন কি কেউ থাকবে যে যাত্রীদের মধ্যে কোনো সমস্যা হলে সেটার সমাধান করবেন?

‘এখানে কিছু সমস্যা এখনো রয়ে গেছে। যার সমাধান খুঁজে বের করতে হবে’ বলে মন্তব্য করলেন রিড।

সূত্র : বিবিসি