Naya Diganta

মিয়ানমারের ‘খুনের ফ্যাক্টরি’

মিয়ানমারের ‘খুনের ফ্যাক্টরি’।

মিয়ানমারের সামরিক স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল, এসএসি সরকার ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অভ্যুত্থানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বেসামরিক সরকারকে উৎখাত করার পর থেকে এখনো ক্ষমতায় টিকে রয়েছে। আকাশছোঁয়া প্রতিকূলতা সত্ত্বেও জান্তা সরকার বিশ্বকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেদের মতো করে এগিয়ে যাচ্ছে। ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে, সামরিক বাহিনী একটি ‘বহুমুখী অস্ত্র শিল্প কমপ্লেক্স’ গড়ে তুলেছে এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার প্রভাব থেকে এটিকে রক্ষার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

কিন্তু জান্তা সরকার এখন অবৈধ ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন প্রতিরোধের মুখোমুখি। পুচকে বিদ্রোহী দল নির্বাসনে নতুন জাতীয় ঐক্য সরকার, এনইউজি গঠন করে সেটিকে আস্তে আস্তে শক্তিশালী রূপ দিতে চেষ্টা করেছে। তারা দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে শত শত পিপলস ডিফেন্স ফোর্স, পিডিএফকে সহায়তা দিচ্ছে।

মিয়ানমার সামরিক জান্তা, রক্তাক্ত ও ক্ষত-বিক্ষত, তারপরও যুদ্ধবাজ। কয়েকটি কারণে তারা ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছে। তার একটি গার্হস্থ্য অস্ত্র শিল্প; যার কারণে ছোট অস্ত্র ও হালকা অস্ত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশটি। বিদেশী টেকনোলজির সহজপ্রাপ্যতার কারণে বিমান শক্তি এবং ভারী আর্টিলারির উন্নয়ন ও যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে হত্যাকারী মারমুখী এই সামরিক বাহিনী।

আন্তর্জাতিক অনেক সম্প্রদায় মিয়ানমার জান্তার কাছে রুশ, চীনা ও ভারতীয় অস্ত্র বিক্রি বন্ধে জাতিসঙ্ঘের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানিয়েছে। আহ্বানের দুই বছর যেতে না যেতেই, মস্কো, বেইজিং ও নয়াদিল্লি অস্বাভাবিকভাবে নিরাপত্তা পরিষদের ২৬৬৯ নম্বর সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করেছে। গত জানুয়ারি মাসে পরিচালিত এক আন্তর্জাতিক জরিপে অভ্যুত্থানের পর থেকে ভিন্নমতাবলম্বী ও প্রতিরোধ দমনে প্রাণঘাতী প্রভাব বিস্তারে ব্যবহৃত ছোট অস্ত্র ও হালকা অস্ত্র সরবরাহ শৃঙ্খলের একটি জরিপ মিডিয়ায় এসেছে। ‘ফেটাল বিজনেস’ শিরোনামের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জান্তা সরকার সরাসরি তিন হাজার বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে। ১০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং ৩০ হাজার স্থাপনা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এই পরিসংখ্যানে রোহিঙ্গা গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের হিসাব ধরা হয়নি। এসব কাজে অভ্যন্তরীণভাবে উৎপন্ন অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। যার নতুন নামকরণ করা হয়েছে ‘খুনের ফ্যাক্টরি’। মিয়ানমারে এখন খুনের ফ্যাক্টরি বললে সেনা নিয়ন্ত্রিত এসব অস্ত্র কারখানাকেই বোঝায়।

১৯৫০-এর দশক থেকে সামরিক বাহিনী তার নিজ জনগণের বিরুদ্ধে যেন চিরকালের যুদ্ধ শুরু করেছে। দেশটি তো আগে থেকেই মগের মুল্লুক বলে খ্যাত। বাহিনীর লোকেরা কয়েক দশক আগ থেকেই জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য সহায়ক অস্ত্র এবং সরঞ্জাম তৈরি করে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এনেছে। নেপিডোর ডিফেন্স সার্ভিসেস মিউজিয়ামে যেকোনো দর্শনার্থী অস্ত্র উৎপাদনের এসব ইতিহাস ও অস্ত্রের ধরন সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিতে পারে। সামরিক বাহিনী এ জন্য গর্ব অনুভব করে।

গত সাড়ে তিন দশকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বাইরের দেশের সরবরাহের ওপর নির্ভরতা থেকে সেনাবাহিনীকে মুক্ত করার প্রয়োজনীয় উপায় হিসেবে অস্ত্র উৎপাদনের অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা জোরদারে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেছে। ফলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এম-১৪ অ্যান্টি-পারসোনাল ল্যান্ডমাইন, এমকে আই এবং জি-৩ রাইফেলসহ বিভিন্ন অস্ত্র তৈরিতে ধীরে ধীরে মূলত স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে।

এসএসি-এম বলেছে, জান্তা তার অপারেশনাল চাহিদা মেটাতে ছোট অস্ত্রের জন্য একটি অত্যন্ত শক্তিশালী উৎপাদন ক্ষমতা তৈরি করেছে, যা প্রায় একচেটিয়াভাবে মিয়ানমারের জনগণের নৃশংস অভ্যন্তরীণ দমনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।

বৈদেশিক সরবরাহ ও উপকরণ সংগ্রহের ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুরের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এটিকে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর অস্ত্র উৎপাদনের জন্য নির্দিষ্ট কাঁচামালসহ সম্ভাব্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণের আইটেমের জন্য কৌশলগত ট্রানজিট পয়েন্ট বলা হয়। এখানে উল্লেখ্য, সিঙ্গাপুরকে ইসরাইলি অস্ত্র উৎপাদনের এশীয় হাব বলা হয়। মিয়ানমারকে ইসরাইল সামরিক প্রশিক্ষণসহ সব ধরনের অস্ত্র সহায়তা দিয়ে আসছে। এখানে অস্ত্র সরবরাহের জন্য ইসরাইলি কোনো বন্দর ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়ে না। সামরিক জান্তাকে সমর্থন করার জন্য চীন ও রাশিয়ার মতো দেশগুলোকে অনেক দোষারোপ করা হয় সরাসরি অস্ত্র বিক্রি করার জন্য। সিঙ্গাপুর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী, এর মিত্রদের এবং ব্যবসায়ী গ্যালাক্সির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অফশোর বাণিজ্যকেন্দ্র ও আর্থিক অভয়ারণ্য হিসেবে তার দীর্ঘস্থায়ী ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ এবং সফলভাবে সম্পন্ন করে আসছে। সিঙ্গাপুরে প্রচুর ইহুদি কর্মকর্তা এসব দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার জন্য কাজ করছে।

মিয়ানমারভিত্তিক অ্যাডভোকেসি গ্রুপ জাস্টিস ফর মিয়ানমার মোট ১১৬টি কোম্পানিকে চিহ্নিত করেছে, যারা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে বিদেশী অস্ত্র, সরঞ্জাম ও খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ করেছে। চিহ্নিত ১১৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্তত ৩৮টি সিঙ্গাপুরভিত্তিক।

অস্ত্র নির্মাণ টেকনোলজি শেখানোতে অবাক হওয়ার কিছু নেই : চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন নরিনকো, রাশিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ইসরাইল, ইউক্রেন ও অন্যান্য প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী আরো দেশ সহায়তাকারী তালিকায় শীর্ষের দিকে রয়েছে।

সামরিক অভ্যুত্থানের পরে এসএসি-এম গঠিত হয়েছিল মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য। তাদের সহায়তার জন্য এটি একটি আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম। এরা কৌশলগত বিষয়গুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সহায়তা গ্রহণকারী টার্গেট গোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ করে তথ্য ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি হন্তান্তর করে। ইয়াং হি লি সংস্থার সহ-প্রতিষ্ঠাতা। তিনি জানান, অন্তত ১৩টি দেশের কোম্পানি মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে ‘দৈনন্দিন নৃশংসতা চালানোর জন্য ব্যবহৃত অনেক অস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম করেছে।’

মিয়ানমারের বিশেষ উপদেষ্টা পরিষদের (এসএসি-এম) প্রতিবেদনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ অস্ত্র উৎপাদন এবং বৈশ্বিক ভ্যালু চেইন পরীক্ষা করে দেখা যায়, অস্ট্রিয়া, চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইসরাইল, জাপান, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্রসহ ৪৫টি সংস্থা সরবরাহ কাজে ন্যস্ত বা এখনো সরবরাহ করছে যা একটি বিস্তৃত ‘অস্ত্র শিল্প কমপ্লেক্স’ বজায় রাখতে সহায়তা করেছে।

এসএসি-এমের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ইয়াং হি লি বলেন, ‘বিদেশী কোম্পানিগুলো বিশ্বের অন্যতম নিকৃষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে মিয়ানমারের জনগণের বিরুদ্ধে দৈনন্দিন নৃশংসতা চালানোর জন্য ব্যবহৃত অনেক অস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম করছে।’

কাপাসা নামে পরিচিত অস্ত্র কারখানাগুলো- প্রতিরক্ষা শিল্প অধিদফতরের স্থানীয় নামের সংক্ষিপ্ত রূপ। এসএসি-এম প্রকাশ করে, সামরিক উৎপাদন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা শিল্প অধিদফতর, ডিডিআই দ্বারা সমন্বিত করা হয়। সাধারণত কাপাসা নামে পরিচিত কারখানাগুলো একটি নেটওয়ার্ক দিয়ে পরিচালিত হয়, প্রায় এক ডজন স্থানে অবস্থিত এই কাপাসা সুবিধাগুলো কাঁচামাল প্রক্রিয়াকরণ ও অস্ত্র উৎপাদন থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ মেরামতের কাজ সম্পাদন এবং বিদেশ থেকে পাঠানো উপাদানগুলো পুনরায় একত্রিত করা পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের কার্য সম্পাদন করে। মিয়ানমারের অস্ত্র তৈরির ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে অ্যাসল্ট রাইফেল ও মেশিনগান থেকে শুরু করে মর্টার, ট্যাংকবিধ্বংসী ও বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার এবং আর্টিলারি ও এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। কাপাসায় অস্ট্রিয়া, জার্মানি, জাপান, তাইওয়ান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি মিলিং, গ্রাইন্ডিং এবং অন্যান্য ফাংশনের জন্য কম্পিউটার সংখ্যাসূচক নিয়ন্ত্রণ বা সিএনসি মেশিনও রয়েছে। এ ধরনের কারখানার সঠিক সংখ্যা অস্পষ্ট, তবে স্যাটেলাইট চিত্র ও অন্যান্য তথ্য বিশ্লেষণ করে এই জাতীয় কয়েক ডজন সুবিধা শনাক্ত করা হয়েছে। মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ অস্ত্র উৎপাদন ১৯৫০-এর দশক থেকে শুরু হয়েছে, তখন পশ্চিম জার্মানি ও ইতালির সহায়তায় অনেকগুলো কাপাসা কারখানা প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমান অস্ত্র শিল্প কমপ্লেক্সটি ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে চালু হয়েছিল। আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ অ্যান্ড্রু সেলথ ২৫ বছর আগে মিয়ানমারের সামরিক এই গতিশীলতা ম্যাপিং করেছিলেন।

১৯৮৮ সালের অভ্যুত্থানের পরে বিদ্রোহীরাও অস্ত্র সরবরাহকারীদের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়। জার্মান ফার্ম ফ্রিটজ ওয়ার্নার, ইসরাইল ও সিঙ্গাপুর থেকে একাধিক সরবরাহকারী প্রযুক্তিগত দক্ষতা, বিশেষত নতুন সিরিজের অ্যাসল্ট রাইফেল নতুনভাবে আকর্ষণ সৃষ্টি করে।

অস্ত্র তৈরির কাঁচামাল মিয়ানমারে প্রচুর রয়েছে, তা সত্ত্বে ও এখনো প্রধানত চীন থেকে আমদানি করা হয়। যার মধ্যে প্রক্রিয়াকরণ, উৎপাদনের ঘাটতি কমানো ও নিয়ন্ত্রণ, উচ্চমানের-নির্ভুল অস্ত্র ও উপাদান সরঞ্জাম তৈরি করার ক্ষমতা অর্জনের মতো মৌলিক কিছু ফ্যাক্টর রয়েছে। জার্মানি, ফরাসি, ইসরাইল ও তাইওয়ানের সংস্থাগুলো কম্পিউটার নিউমেরিকাল কন্ট্রোল মেশিন সরবরাহের পাশাপাশি ছোট অস্ত্র, মর্টারসহ হালকা অস্ত্র, ভারী ক্যালিবার আর্টিলারি, ক্ষেপণাস্ত্র ও লঞ্চার প্যাড তৈরিতে সক্ষমতা বাড়িয়ে দিতে সহায়তা দিয়েছে।

এই অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা একাধিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অপারেশনাল গতি বজায় রাখার জন্য যথেষ্ট। কেননা, জান্তা দুই বছরের অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাত দমনে অনেকটা সক্ষম হয়েছে। ‘দেশে অস্ত্র উৎপাদনের সক্ষমতা মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর জন্য গর্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস।’

বিদ্রোহী দলগুলো বেশির ভাগই ম্যাগওয়ে অঞ্চলে ও বাগো, মান্দালয়, নেপিডো এবং ইয়াঙ্গুন অঞ্চলেও অবস্থান করে। এই সাইটগুলোতে সড়ক, নদী ও রেলপথে মূল পরিবহন যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কাছে যন্ত্রাংশ বিক্রির অভিযোগ যে সব বিদেশী প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম- ইসরাইল মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিজ, যা এসটিকে ৫০ এমজি মেশিনগান তৈরির লাইসেন্স দিয়েছে; ভারতীয় প্রতিষ্ঠান টনবো ইমেজিং, যা থার্মাল দর্শনীয় স্থান বিক্রি করে; চায়না অ্যারোস্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি করপোরেশন, যেটি মনুষ্যবিহীন বিমান বা ড্রোন উৎপাদনের প্রযুক্তি বিক্রি করে; সিঙ্গাপুরের এসটি ডিনামিক্স ও ইউক্রেনের ইউক্রোবোরনপ্রম এবং উকারস্পেক এক্সপোর্ট।

বিপুলসংখ্যক লাইসেন্সদাতা, উপাদান সরবরাহকারী, প্রস্তুতকারক ও পরিবেশকদের একটি অত্যন্ত জটিল, বহু স্তরযুক্ত নেটওয়ার্কের বিবরণ সম্প্রতি মিডিয়ায় এসেছে, যেটি আন্তঃমহাদেশীয় অস্ত্র তৈরির গোপন চক্র। এই চক্রের কাছে আপন, পর বা ইজমের কোনো মূল্য নেই। দাও টাকা নাও অস্ত্র- এটিই তাদের মূলমন্ত্র।

মৃতদেহ গণনা, ঘাঁটি দখল, যুদ্ধবন্দী, স্নাইপারের গুলিতে নিহত কর্মকর্তা, সরঞ্জাম ও গোলাবারুদ জব্দ, বিমানবিধ্বংসী সক্ষমতা বৃদ্ধি, বিমান জ্বালানি সরবরাহ হ্রাস এবং অপারেশনাল এলাকা সম্প্রসারণের মতো সঙ্ঘাতের মেট্রিকগুলো একটি বৃহত্তর ইমেজ স্থাপনের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

বিদ্রোহী শক্তিগুলোর সক্ষমতা হ্রাস করার একটি বহুমুখী প্রকল্পের জন্য অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট কৌশল প্রয়োজন, যদিও এনইউজি বা ঐক্য সরকারের এ ধরনের প্রচেষ্টার সমন্বয় ক্ষেত্রে প্রচুর ঘাটতি রয়েছে।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যাপক এসএসিবিরোধী প্রতিরোধের মাধ্যমে ‘কার্যকর নিয়ন্ত্রণ’ শীর্ষক বিভ্রান্তিকর প্রকাশনার পরে কাপাসার প্রতিবেদন আংশিকভাবে এসএসি-এমের অবস্থানকে পুনরুদ্ধার করে : সামরিক কাউন্সিল মিয়ানমারের মাত্র ১৭ শতাংশের ওপর স্থিতিশীল নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এবং প্রতিরোধ বাহিনীর হাতে ৫২ শতাংশ অঞ্চলের ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বলা হলেও বিষয়টি সঠিক নয়। জান্তা এটি স্বীকার করে না মূলত এই প্রচার এককভাবে প্রতিরোধ বাহিনীর। আরো বলা হয়েছে, বিরোধী ভাসমান সরকার মিয়ানমারজুড়ে দীর্ঘ দিন ধরে দুর্দশাগ্রস্ত জনগণের কাছে অনেক আশার কথা প্রচার করেছিল।

২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক একটি থিংক ট্যাংক সেনাবাহিনীকে উৎখাত করতে চেয়েছে, এখন মনে হচ্ছে বিষয়টি এত সোজা নয়, অনেক পথ পাড়ি দেয়ার রয়েছে।

পশ্চিমারা প্রতিরোধকে সশস্ত্র করার পরিবর্তে তাইওয়ান, ইউক্রেন, ইসরাইল ও সিঙ্গাপুরে মিত্রদের ওপর রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত বা বেসরকারি সংস্থার সম্পৃক্ততার মাধ্যমে সমস্ত সমর্থন বন্ধ করার জন্য চাপ বাড়িয়ে তুলতে পারে। ওসব দেশ রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে পারে বা গোয়েন্দা ক্ষমতা নির্ধারণ করতে পারে।

মানবাধিকার আইনজীবী ও ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মিয়ানমার-বিষয়ক জাতিসঙ্ঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের সদস্য সিদোতি বলেন, ‘মিয়ানমারের জনগণের দুর্দশা থেকে মুনাফা অর্জনকারী বিদেশী কোম্পানিগুলোকে অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।’

অস্ত্র বাণিজ্য কতটা বৈশ্বিক ও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে তা মিয়ানমারের অস্ত্র উৎপাদন ও সংগ্রহের কেস স্টাডি থেকে বোঝা যায়। মিয়ানমারের মতো একটি দেশ যা কিছুটা হলেও আধিপত্য অর্জনের চেষ্টা করেছে তা কীভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে জড়িত রয়েছে তার একটি চমকপ্রদ চিত্র। যাই হোক, এর সাথে জড়িত সরবরাহ চেইন জটিলতা ও জড়িত জাতীয় এখতিয়ার অনেকটা নিখুঁত হওয়ার কারণে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অপারেশনাল ক্ষমতা হ্রাস করা কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার