Naya Diganta

আল-সাকি বুকস : লন্ডনের প্রথম আরবি বইয়ের দোকানটি এখন শুধুই স্মৃতি

আল-সাকি বুকস

আল-সাকি বুকস। লন্ডনের পুরনো বইয়ের দোকানগুলোর একটি। ইউরোপের বুকে এ যেন আরবি সাহিত্য ও সংস্কৃতির মিলনস্থল। তাই আরব পর্যটকরা একবারের জন্য হলেও এখানে ঘুরতে যান। গত ৩১ ডিসেম্বর করোনা-পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক মন্দায় বন্ধ হয়ে যায় সাড়ে চার দশকের পুরনো এই বইয়ের দোকান। লন্ডনের বেসওয়াটার এলাকায় অবস্থিত এই দোকান এখন স্মৃতি হয়ে থাকবে আরবি বইপ্রেমীদের মনের পাতায়।

লেবাননের গৃহযুদ্ধ থেকে রেহাই পেতে সত্তরের দশকে লন্ডনে পাড়ি জমান অ্যান্দ্রে, সালওয়া গ্যাসপার্ড ও মাই ঘোসুব। লন্ডনে এসে তারা আরবি বইয়ের ব্যাপক চাহিদা উপলব্ধি করেন। অতঃপর ১৯৭৮ সালে তিনজনের উদ্যোগে আরবি ও ইংরেজি বইয়ের সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু হয় আল-সাকি বুকশপসের। আরবি ভাষায় সাকি শব্দের অর্থ পানি বিক্রেতা। তপ্ত মরুভূমিতে পানি বিক্রেতারা যেভাবে সবার তৃষ্ণা মেটায়, তেমনি রূপক অর্থে আল-সাকি বুকস জ্ঞানপিপাসুদের মধ্যে শিক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি বিতরণ করে বেড়ায়।

আরবি সাহিত্য ও সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয় বেসওয়াটার। আরব সম্প্রদায়ের প্রধান আকর্ষণ হিসেবে স্থান করে নেয় আল-সাকি বুকস। সেখানে শুধু মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকাভিত্তিক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের বই ছিল এমন নয়, বরং এখানে গড়ে ওঠে আধুনিক সাহিত্য-সংস্কৃতির সমৃদ্ধ ইতিহাস। সিরিয়ার কবি অ্যাডোনিস, মিসরীয় সাহিত্যিক নাওয়াল এল-সাদাবি ছিলেন এখানকার পরিচিত মুখ। সৌদি আরবের সাবেক জ্বালানিমন্ত্রী আহমেদ জাকি ইয়ামানি, ফিলিস্তিনি শিক্ষাবিদ সুহেল বুশরুই, লেবানিজ লেখক জিবরান খলিল জিবরানসহ আধুনিক যুগের আরবি সাহিত্যের সবার বই পাওয়া যেত এখানে।

গত ডিসেম্বরে এক বিবৃতিতে আল-সাকির সহ-প্রতিষ্ঠাতা সালাওয়া গ্যাসপার্ড বলেন, ‘বইয়ের দোকানের পরিচর্যায় আমার পুরো জীবন কেটেছে। নিজ সন্তানদের চেয়েও বেশি সময় এর দেখাশোনা করেছি। আমার স্বামীও (অ্যান্দ্রে) এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা; তার কাছে মনে হচ্ছে যেন সে এক সন্তানকে হারাচ্ছে। কিন্তু লন্ডনের বর্তমান অবস্থা তো আরো নাজুক। তা কারো অজানা নয়।’

লিন গ্যাসপার্ড বলেন, ‘আল সাকি বুকস সব সময় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, দৃষ্টিভঙ্গির বিনিময় ও সব মানুষের সঙ্গে সহানুভূতির পক্ষে কাজ করেছে। গত ৪০ বছরের অসংখ্য খ্যাতি ও পুরস্কারের উত্তরাধিকার এখন অন্য দুটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে থাকবে। আমরা বইয়ের দোকানে কাজের সময়কে মিস করব। আমরা পশ্চিম লন্ডনের নতুন অফিস প্রাঙ্গণ থেকে আল-সাকির ইতিহাসের নতুন অধ্যায় শুরুর অপেক্ষায় রয়েছি।’

তিনি আরো বলেন, ‘করোনাকালের লকডাউন আমাদের মতো অনেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ আরব বিশ্বের দুর্লভ বইয়ের সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠান হলেও লড়াই করে টিকে থাকতে হয়েছে। এ সময়ে আমরা আরবি বইয়ের দাম, শিপিং চার্জ ও বিক্রয় মূল্য বাড়িয়েছি।’

আল-সাকির বন্ধ হওয়ার ঘটনা আরব পাঠক ও ক্রেতাদের মনে তৈরি করে অপূরণীয় শূন্যতা। এ ঘটনাকে সময়ের ‘ট্র্যাজেডি’ হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উল্লেখ করেন অনেক পাঠক। অনেকে নিজের অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে অর্থ সংগ্রহের প্রস্তাবও দেয়। আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্টের কূটনৈতিক উপদেষ্টা আনোয়ার গারগাশ টুইট বার্তায় লিখেন, ‘সাড়ে চার দশক পর লন্ডনের সাকি বইয়ের দোকান বন্ধ হওয়ার খবর পেয়ে আমি দুঃখ পাই। লন্ডনে আরবি বই সরবরাহের মাধ্যমে সংস্কৃতি প্রসারে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বইয়ের দোকানে যাতায়াত সব সময় আমার কাছে প্রিয়।’

অবশ্য গত ৩১ ডিসেম্বর আল-সাকি বুকস বন্ধ হয়ে গেলেও পশ্চিম লন্ডন ও লেবাননের বৈরুতে এর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে। এদিকে আল-সাকির বইবিক্রেতা মোহাম্মদ মাসুদ আরবি বইয়ের আরেকটি সংগ্রহশালা খোলার চেষ্টা করছেন। মাকাম বুকস নামের শপটি আগামীতে লন্ডনের আরবি পাঠকদের প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠবে বলে আশা তার।

সূত্র : আলজাজিরা