Naya Diganta

বইমেলা নিয়ে হেলাখেলা

বইমেলা নিয়ে হেলাখেলা।

বই নিয়ে মনীষীদের এত উক্তি আছে যে, এই পরিসরে তার বর্ণনা সম্ভব নয়। বই মানুষের জীবনে বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো। মানুষ যদি চায় তাহলে বই থেকে জীবন নির্দেশনা লাভ করতে পারে। হৃদয়কে আলোকিত করতে পারে। বই সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিতে পারে। সব দেশে জাতি ও রাষ্ট্র গঠনে বই ব্যাপক ভ‚মিকা রেখেছে। বই মানুষের চিন্তার জগৎকে প্রসারিত করেছে। বই মানে তো শুধু ছাপার অক্ষরের পৃষ্ঠা নয়। বই মানে মনীষীদের চিন্তা-চেতনা ও পথনির্দেশনা।

পৃথিবীতে যত যুগান্তকারী ঘটনা ঘটেছে তার পেছনে মনীষীদের ভূমিকা ব্যাপক। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের ভিত্তি রচনা করেছিল হবস, রুশো ও ভলতেয়ারদের চিন্তা-চেতনা। ১৯১৭ সালে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ভিত্তি ছিল মাক্সীয় দর্শন। ১৯৭৯ সালে ইরানি ইসলামী বিপ্লবের পেছনে অনুপ্রেরণা ছিল আয়াতুল্লাহ খোমিনি, আয়াতুল্লাহ মোন্তাজেরি প্রমুখ মনীষীর গ্রন্থ। এই বাংলাদেশে কলকাতাকেন্দ্রিক নবজাগরণের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন ডি রোজীয়। বঙ্গভঙ্গ ও তৎপরবর্তী মুসলিম জাগরণের পেছনে মুন্সি মেহেরুল্লাহ, কায়কোবাদ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মীর মশাররফ হোসেন ও ড. শহীদুল্লাহদের ভূমিকা ছিল অনন্য। সেভাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর অবদান রয়েছে।

রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয়ের পর আশা করা হয়েছিল, নতুন জাতির নতুন সূচনায় আগের মতো জ্ঞানের জগতে নতুন যুগের নতুন সূচনা ঘটবে। কিন্তু তা ঘটেনি। কারণ আলোকিত সমাজ বা রাষ্ট্র আলোকিত রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল। যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব জ্ঞানকে শক্তির উৎস মনে করে না, পেশিশক্তির প্রাধান্য দেয় ও ত্যাগের পরিবর্তে ভোগের শিক্ষা দেয়, তাদের কাছে আলোকিত সমাজ আশা করা যায় না। ১৯৭২ সালে জ্ঞানী ও শিক্ষাবিদরা বললেন, লেখা ও পড়ার জগতে ফিরে যাওয়ার কথা, আর শাসককুল বলল- অটো প্রমোশনের কথা। তাদের লেখাপড়া সম্পর্কে এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে পরবর্তীকালে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নিকৃষ্ট নকল বিপ্লব অনুষ্ঠিত হয়। এর প্রভাব দৃষ্ট হয় প্রাইমারি থেকে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত। পরবর্তীকালে সরকার বদল হলে দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন হয়। তবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে জ্ঞান বিকাশের চেষ্টা লক্ষ করা যায়। আজকের অমর একুশে গ্রন্থমেলা এরকমই একটি প্রয়াস।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন তাদের ত্যাগকে জাগরূক রাখতে এই মেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। সে কারণে পুরো ফেব্রুয়ারি মাস ধরে এর আয়োজন। অন্য সময় অন্যরকম বইমেলার আয়োজন হলেও তা জমে উঠেনি। তবে ঈদে মিলাদুন্নবীকে কেন্দ্র করে ইসলামি ফাউন্ডেশনের বইমেলা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। একুশে বইমেলার আদলে সারা দেশে অঞ্চল ও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক বইমেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। এভাবে বইয়ের চেতনা সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া যায়। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রæয়ারি জনপ্রিয় প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের বটতলায় কলকাতা থেকে আনা কিছু বই নিয়ে মেলার সূচনা করেন। চিত্তরঞ্জন সাহার মুক্তধারা প্রকাশনী ইতোমধ্যে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনী হিসেবে সুনাম অর্জন করেছে, তার দেখা দেখি অন্যরাও উৎসাহী হন।

১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত স্বল্পপরিসরে মেলা চলতে থাকে। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে বইমেলার সাথে সমন্বিত করেন। তারই উদ্যোগে ১৯৭৯ সাল থেকে বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি বইমেলার ব্যবস্থাপনায় অংশীদার হয়ে ওঠে। ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কাজী মনজুরে মওলা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বইমেলার আয়োজনের দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু এরশাদবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের তোড়ে সে বছর মেলা অনুষ্ঠিত হয়নি। ১৯৮৪ সাল থেকে পুরো উদ্যমে মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বাংলা একাডেমি চত্বরে জায়গা না হওয়ায় ২০১৪ সাল থেকে বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। করোনাকালীন সময়ে একুশে বইমেলা অনুষ্ঠান ব্যাহত হয়।
যেহেতু এটি জ্ঞানের মেলা, সেটি প্রাণের মেলা হবে- সেটিই কাম্য। দল-মত নির্বিশেষে এখানে সবার অংশগ্রহণ হবে অবারিত। ক্রমেই বইমেলা অনুষ্ঠানে সরকারের সহযোগিতা বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে তদারকি। ২০০৯ সাল থেকে মেলা অনুষ্ঠানে দলীয়করণ বা রাজনীতিকরণের অভিযোগ শোনা যায়। উল্লেখ্য, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় মেলা নিয়ন্ত্রণের সার্বিক দায়িত্ব পালন করে। সেই সুযোগে সরকার ভিন্ন মত দলনে বইমেলাকে ব্যবহার করছে বলে দেখা যাচ্ছে। আইনগতভাবে রাষ্ট্র ও ধর্মের দোহাই দেয়া হলেও সরকার কাজ করছে এর বিপরীত। যেকোনো সরকারবিরোধী বইকে রাষ্ট্রবিরোধী বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। আবার ধর্মের নাম করে ধর্মীয় বই ও স্টলের অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। এবারের বইমেলার শুরুতে এরকম একটি বিরোধ সংবাদপত্রে এসেছে। রাজনৈতিক দলীয়করণের প্রাধান্য মেলায় ঢুকলেই যে কেউ দেখতে পাবেন। যেখানে বিশুদ্ধ বইমেলাই কাম্য সেখানে রাজনৈতিক ঘনঘটা কাক্সিক্ষত নয়। তবে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান- প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর, পরিসংখ্যন বিভাগ ও পর্যটন করপোরেশনের অংশগ্রহণ প্রাসঙ্গিক মনে হয়।

এখানে ইদানীং বিভিন্ন বেসরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানও অংশ নিচ্ছে। সেই সাথে বিভিন্ন ডিজিটাল প্রকাশনা- সিডি, ডিভিডি স্থান করে নিচ্ছে। মেলার আশপাশে বিভিন্ন রকমের পসরা সাজিয়ে বসছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এটি বইমেলার সৌন্দর্য ও সৌকর্য কিছু ক্ষেত্রে ব্যাহত করছে। ক্রমেই মেলার আধুনিকায়ন হচ্ছে। থাকছে মিডিয়া সেন্টার, ইন্টারনেট ও ফ্যাক্স ব্যবহারের সুবিধা, লেখক কর্নার ও তথ্যকেন্দ্রও রয়েছে। বই প্রকাশনা উৎসবের জন্য কয়েকটি ছোট কর্নার রয়েছে। বইমেলার এসব ভালো দিকের বিপরীতে অভিযোগও কম নয়। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এবারের বইমেলার ব্যবস্থাপনায় ভুলত্রুটি লক্ষ করা গেছে। বিলম্বে স্টল বিতরণের অভিযোগ রয়েছে। মেলা শুরু করার পাঁচ দিন পরও স্টলের নির্মাণকাজ চলতে দেখা গেছে। এখন ধূলিধূসরিত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ বইমেলার বাণিজ্যিকীকরণ সম্পর্ক। এবারে কাগজ ও প্রকাশনার অন্যান্য সামগ্রীর দাম আকাশচুম্বী হওয়ায় বইয়ের দাম বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রকাশনার বাণিজ্যিকীকরণের অভিযোগ অনেক পুরোনো। নকল বইয়ের ছড়াছড়ি সর্বত্র। বিশেষ করে কলকাতাকেন্দ্রিক প্রকাশনার অবিকল নকল দৃশ্যমান। অতীতের যেমন- রবীন্দ্র, নজরুল ও শরৎ সাহিত্যের প্রকাশনা অত্যন্ত নিম্নমানের দেখা গেছে- উত্তম মানেরগুলো আবার অনেক দামের। দেশের প্রকাশনাগুলোর হাতেগোনা কয়েকটি বাদে মানের কথা বলা যেন নিরর্থক। এগুলো বানান ভুলে পরিপূর্ণ। ছাপা নিম্নমানের। গেটআপ, মেকআপ ও প্রচ্ছদ তথৈবচ। গভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ বইয়ের সংখ্যা প্রতিটি মেলাতেই থাকে সংখ্যায় অনেক কম। এটি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থানের নিচু মান নির্ণয় করে। এ ক্ষেত্রে প্রকাশকের চেয়ে লেখকদের দায় বেশি। লেখকদের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসবে এটিই স্বাভাবিক। আন্তর্জাতিক পরিসরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান নিয়ে যেমন হতাশা, প্রকাশনার ক্ষেত্রেও তেমনি অবস্থা।
বুদ্ধিজীবীরা বুদ্ধির চর্চা না করলে প্রকাশকের করার কী আছে। এ ক্ষেত্রে সরকার ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তাও অপ্রতুল। বাংলা একাডেমি আমার একটি বই প্রকাশ করেছিল। সম্মানী দিয়েছিল ১৫ হাজার টাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা বিভাগটির ক্ষীণ দশা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা বিভাগটির অনেক আগেই মৃত্যুবরণ করেছে। সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন সব সরকারের একটি বিঘোষিত নীতি বলে জানি। কিন্তু অনুবাদে তেমন কোনো অর্থ বরাদ্দ নেই। বিশ্বমানের বইগুলোর অনুবাদ ও প্রকাশনা ক্ষেত্রে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ও সরকারি অগ্রাধিকার নেই। সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের জন্য একুশে বইমেলাকেন্দ্রিক প্রকল্প গ্রহণ করলে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা বইয়ের অভাব দূর হতে পারে।

আগেই বলা হয়েছে, বই দেশ ও জাতি গঠনের উত্তম হাতিয়ার। যে জাতি সর্ব উৎকৃষ্ট সেই জাতির প্রকাশনাও তত উন্নত। সারা পৃথিবীতে যত বই প্রকাশিত হয় তার ৭০ শতাংশ ইউরোপ-আমেরিকার। সেখানকার যেকোনো লাইব্রেরিতে বাংলাদেশের ওই বই পাওয়া যায়। আমি তার সাক্ষী। সে জন্য মানসম্পন্ন পাঠ্যবইয়ের যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন ইংরেজি গবেষণাসমৃদ্ধ বইয়ের। তা হলেই জাতি হিসেবে আমরা দেশ ও বিদেশে সম্মান অর্জন করতে পারব। একুশে বইমেলাকে যদি আমরা জ্ঞানের মেলায় পরিণত করতে পারি তাহলে জাতি গঠন ও রাষ্ট্র নির্মাণে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারব। মনীষী সক্রেটিসের সেই বিখ্যাত উক্তি হোক আমাদের পাথেয় ‘জ্ঞানই শক্তি, জ্ঞানই পণ্য’।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com