Naya Diganta

তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখার রোহিঙ্গাদের উখিয়ায় ট্রানজিট ক্যাম্পে স্থানান্তর শুরু

তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখার রোহিঙ্গাদের উখিয়ায় ট্রানজিট ক্যাম্পে স্থানান্তর শুরু।

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু এলাকায় অবস্থানরত শূন্যরেখার রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর শুরু হয়েছে।

রোববার (৫ ফেব্রুয়ারি) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে প্রথম ধাপে তুমব্রু ইউনিয়ন পরিষদ ভবন থেকে তিনটি বাসে ১৪ পরিবারে ৮০ জন রোহিঙ্গাকে আনা হয় চার কিলোমিটার দূরের কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং আশ্রয়শিবির-সংলগ্ন বালুখালী ট্রানজিট ক্যাম্পে।

দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ট্রানজিট ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের এনে তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শুরু করেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। সেখানে উপস্থিত ছিলেন জাতিসঙ্ঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের কর্মকর্তাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

বিকেলে দ্বিতীয় দফায় তুমব্রু থেকে আরো শতাধিক রোহিঙ্গাকে উখিয়ার ট্রানজিট ক্যাম্পে সরিয়ে আনার কথা রয়েছে। ট্রানজিট ক্যাম্পে আনা রোহিঙ্গারা সবাই উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরের নিবন্ধিত রোহিঙ্গা।

এ সত্যতা নিশ্চিত করে আরআরআরসি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গাবিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্স কমিটি সিদ্ধান্তে তুমব্রু থেকে শূন্যরেখার রোহিঙ্গাদের সরিয়ে আনার কাজ শুরু হয়েছে। আজ প্রথম ধাপে দুই দফায় তুমব্রু থেকে ৩৬ পরিবারের ১৮৬ জন রোহিঙ্গাকে উখিয়ার ট্রানজিট ক্যাম্পে আনা হবে। ধাপে ধাপে অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের তুমব্রু থেকে

মোহাম্মদ মিজানুর রহমান আরো বলেন, ট্রানজিট ক্যাম্পে আনা রোহিঙ্গারা উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরের নিবন্ধিত শরণার্থী কি না, তার সত্যতা যাচাইয়ের পর কার্ডে উল্লেখিত ঠিকানা অনুযায়ী আশ্রয়শিবিরে পাঠানো হবে।
গত ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আশপাশের কয়েকটি এলাকায় অবস্থান নেয়া শূন্যরেখার রোহিঙ্গাদের গণনা করে পাওয়া যায় ৫৫৮ পরিবারের দুই হাজার ৯৭০ জন। এর মধ্যে উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ৩৭৭ পরিবারের ২ হাজার ৯৮ জন। অবশিষ্ট ১৭৯ পরিবারের ৮৭২ জন রোহিঙ্গার নিবন্ধন কার্ড পাওয়া যায়নি।

আজ প্রথম ধাপে নিবন্ধিত ৩৭৭ পরিবারের দুই হাজার ৯৮ জন রোহিঙ্গার মধ্য থেকে ৪৬ পরিবারে ১৮৬ জন রোহিঙ্গাকে উখিয়ায় সরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে আরআরআরসি কার্যালয়। ট্রানজিট ক্যাম্পে রোহিঙ্গা নিবন্ধন কার্ডের তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের পর সঠিক পাওয়া গেলে রোহিঙ্গাদের সংশ্লিষ্ট আশ্রয়শিবিরের ঠিকানায় পৌঁছে দেয়া হবে। এভাবে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ জন নিবন্ধিত রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের তুমব্রু থেকে সরিয়ে আনার কাজে হাত দেয়া হবে। একইসাথে তুমব্রু এলাকা থেকে উধাও শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরের এক হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে খুঁজতে মাঠে নেমেছে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলেন, গত ১৮ জানুয়ারি শূন্যরেখা আশ্রয়শিবিরে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সাথে মিয়ানমারের আরেকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় একজন রোহিঙ্গা নিহত ও দুই শিশু আহত হয়। এ ঘটনার পর শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরে ৬৩০টির বেশি ঘর আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। তাতে চার হাজার ৩০০ রোহিঙ্গা গৃহহীন হয়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে আশ্রয় নেয়। গত ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি দুই দিন গণনা করে দুই হাজার ৯৭০ রোহিঙ্গা পাওয়া গেলেও অবশিষ্ট এক হাজার ৩৩০ জন রোহিঙ্গার হদিস মিলছে না।

আজ বেলা ১১টায় তুমব্রু ইউনিয়ন পরিষদ ভবন এলাকা থেকে কক্সলাইন পরিবহনের একটি বাসে তোলা হয় ৩০ জনের বেশি রোহিঙ্গাকে। রোহিঙ্গাদের একজন মো: আনোয়ার (৪৫) বলেন, সাড়ে পাঁচ বছর আগে তিনি স্ত্রী, তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে হেঁটে তুমব্রু সীমান্তের কোনারপাড়ার শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরে ঠাঁই নেন। দেড় বছর পর তিনি উখিয়ার বালুখালীতে গিয়ে শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধন করেন। এত দিন দুই দিকে (বালুখালী ও শূন্যরেখা) ত্রাণসহায়তা ভোগ করেন তিনি।

দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে বাসে ওঠেন শূন্যরেখার রোহিঙ্গা নারী সলিমা খাতুন (৪০)। তার স্বামী কয়েক দিন আগে কাজের সন্ধানে কক্সবাজার শহরে পাড়ি জমিয়েছেন। সলিমা বলেন, শূন্যরেখার রোহিঙ্গারা উখিয়ার আশ্রয়শিবিরে থাকা আত্মীয়স্বজনের কাছে ফিরতে চান। শোনা যাচ্ছে, কিছু রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর ভাসানচরের আশ্রয়শিবিরে পাঠানো হবে। এ নিয়ে তিনিও উদ্বিগ্ন।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বাসিন্দারা বলেন, মাথা গোঁজার ঠাঁই এবং গ্রেফতার এড়াতে তুমব্রু এলাকা থেকে ২৯ ডিসেম্বরের আগে এক হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা, আলীকদম, কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ, ঈদগাঁও এবং কক্সবাজার পৌরসভার বিভিন্ন পাহাড়ে আত্মগোপন করেছেন। কেউ কেউ চলে গেছেন চট্টগ্রামের দিকে।

এ প্রসঙ্গে আরআরআরসি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, বেশ কিছু রোহিঙ্গা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছেন। কিছু নাইক্ষ্যংছড়িসহ বিভিন্নস্থানে লুকিয়ে আছে বলে শোনা যাচ্ছে। এসব রোহিঙ্গা সবাই বিভিন্ন মামলার আসামি। তাদের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে পুলিশকে বলা হয়েছে।

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, তুমব্রু সীমান্তে অবস্থান নেয়া শূন্যরেখার রোহিঙ্গাদের অনেকে বিরুদ্ধে হত্যা, মাদক ও অস্ত্র মামলার আসামি। তাদের ধরতে মাঠে নেমেছে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে আট লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর কয়েক মাসে, দেশটির সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে। ওই সময় স্থলপথে ছয় হাজারের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরটি গড়েছিল।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলেন, গত ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরে ছিল ৬২১টি পরিবারের চার হাজার ৩০০ জন রোহিঙ্গা।