Naya Diganta

মানবহিতৈষী এক আলেমের বিদায়

মাওলানা মুফতি শহীদুল ইসলাম ।

নড়াইল-২ আসনের সাবেক এমপি (২০০২) বিশিষ্ট সমাজসেবক, মানবদরদী ও শিক্ষানুরাগী মাওলানা মুফতি শহীদুল ইসলাম (৬৩) পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন গত ২৭ জানুয়ারি। ইসলাম ও মুসলমানের সেবায় তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। তিনি ছিলেন মানবিক ও দাতব্য কার্যক্রমের অন্যতম পথিকৃৎ। তার ইন্তেকালে দেশব্যাপী আলেম সমাজের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। তিনি তার নির্বাচনী এলাকা নড়াইলে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের পাশাপাশি অসংখ্য মাদরাসা, মসজিদ, এতিমখানা ও টিউবওয়েল স্থাপন করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ও দৃষ্টিনন্দন লোহাগড়া উপজেলার আন-নূর কমপ্লেক্স মাদরাসা। এখানে প্রায় ৪৫০ জন এতিম শিক্ষার্থী ও ৩১ জন শিক্ষক রয়েছেন। মুফতি শহীদুল ইসলাম ২০০৩ ও ২০০৪ সালের ১১ ও ১২ মার্চ লক্ষ্মী পাশা মোল্লার মাঠে আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলনের আয়োজন করেন। এতে বিশ্বের ২২টি দেশের ধর্মীয় স্কলাররা অংশ নেন। মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা কর্মসূচির আওতায় তিনি ১৭টি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন, যেখানে পৃথক বালক-বালিকা শাখাসহ অন্ধদের জন্যও রয়েছে ভিন্ন ক্যাম্পাস। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৭০০ এতিম, অসহায় ও অন্ধ বালক-বালিকার দ্বীনি শিক্ষা, খাদ্য, বস্ত্র ও চিকিৎসা বিনামূল্যে দেয়া হয়। মুফতি শহীদুল ইসলাম ১৯৮৮ সালে আল মারকাজুল ইসলামী নামে একটি সেবামূলক অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান কায়েম করেন। এর মাধ্যমে তিনি দেশ-বিদেশে মানবসেবামূলক ব্যাপক কাজ করে গেছেন। মসজিদ-মাদরাসা ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, অভাবগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোসহ নানাভাবে মানবসেবায় তিনি বিশেষ অবদান রেখে গেছেন। সেবামূলক কাজে তিনি ধর্মের ভেদাভেদ করতেন না। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, আল-মারকাজুল ইসলামীর অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের প্রথম সেবা গ্রহণকারী ছিলেন একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তি (ফয়সল আহমদ জালালী)।

বিশেষ করে বৈশ্বিক করোনা মহামারীর সময়ে ছেলেমেয়েরা অসুস্থ পিতা-মাতার কাছে যায়নি। তখন মুফতি শহীদুল ইসলামের আল-মারকাজুল ইসলামীর স্বেচ্ছাসেবকরা করোনায় মৃত শত শত ব্যক্তির লাশ দাফন-কাফন করে দেশ-বিদেশে সুনাম বয়ে এনেছেন। বর্তমানে এ সংগঠনের আওতায় সারা দেশে ১৩০টি মসজিদ ও ঢাকা শ্যামলীতে আল-মারকাজুল ইসলামী হাসপাতাল এবং মুমূর্ষু রোগী ও লাশ বহনের জন্য দেশের সর্ববৃহৎ বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস চালু রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিদিন প্রায় ২০ জনের মতো মারা যাওয়া ব্যক্তির লাশ দাফন করে থাকে। এ ছাড়া ২০ জনের অধিক হিন্দু ধর্মাবলম্বীর লাশের সৎকার করে মানবতার অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সংস্থাটি। বিগত দুই বছরে মহামারীতে মুফতি শহীদুল ইসলাম প্রতিষ্ঠিত আল-মারকাজুল ইসলামী ঢাকা সিটিতে ছয় হাজার পাঁচ শতাধিক লাশ কাফন ও দাফন করেছে।

আল-মারকাজুল ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হামজা এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। করোনায় মৃত ব্যক্তিদের কাফন-দাফন একটি জটিল সমস্যা। ওই সমস্যা সহজতর পন্থায় সমাধানের লক্ষ্যে ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও জনসচেতনতামূলক বিভিন্ন বিষয়ে আল-মারকাজুল ইসলামী জাতিসঙ্ঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহযোগিতায় ২০২০ সালে ঢাকা, সিলেট, খুলনা, বরিশাল ও কক্সবাজারসহ দেশের ১০টি জেলায় করোনায় মৃতব্যক্তিদের কাফন-দাফন পদ্ধতি নিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়। (ইনকিলাব, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১)।

২০২২ সালের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সুনামগঞ্জের এক হাজার বন্যার্ত পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিল আল-মারকাজুল ইসলামী। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের বেতগঞ্জ, ফতেহপুর বল্লভপুর, মোল্লাপাড়া, দেখার হাওর পাড়ের কয়েকটি গ্রামসহ বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করে। প্রতি পরিবারকে ২০ কেজি চাল, চার কেজি আলু, দুই কেজি পেঁয়াজ, দুই লিটার তেল, দুই কেজি ডাল, এক কেজি চিঁড়া, এক কেজি গুড় দেয়া হয়। ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস কর্মসূচির আওতায় ৩৪টি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে সারা দেশের অসংখ্য গরিব ও অসহায় রোগীকে হাসপাতালে আনা নেয়া করা হয়। সেই সাথে লাশ পরিবহনের কাজও সুচারুরূপে পরিচালনা করে আসছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মতোই স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর আনিসুজ্জামানের লাশ গোসল ও দাফনের ব্যবস্থা করে আল-মারকাজুল ইসলামী।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সুপারিশে এ এনজিওটি সম্প্রতি রাজধানীর ডিএমপি হেডকোয়ার্টারে তিন দিন ১৫০ জন পুলিশকে করোনায় মৃত ব্যক্তিদের লাশ দাফনের কার্যক্রম ট্রেনিং দিয়েও পুলিশ কর্তৃপক্ষের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে। বর্তমানে কেরানীগঞ্জ উপজেলার সিরাজনগর ইউনিয়নে ১৬০ বিঘা জমির ওপর আল-মারকাজুল ইসলামীর বিভিন্ন মানবিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। মুফতি শহীদুল ইসলাম ২০০২ সালে ঢাকায় একটি উন্নতমানের হাসপাতাল নির্মাণ করেন, যা চক্ষু ও সাধারণ স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয়, মানসম্মত ও উন্নত চিকিৎসাসরঞ্জামে সজ্জিত। চক্ষু বিভাগে গরিব, দুস্থ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের ফ্রি চিকিৎসা দেয়া হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনগুলো নামমাত্র মূল্য পরিশোধে সম্পন্ন করা হয়। লাভলি স্মাইল প্রজেক্টের আওতায় যেসব শিশু জন্ম থেকে ঠোঁট কাটা বা ঠোঁট ও নাক উভয়ই কাটা, তাদের বিনামূল্যে অপারেশন করে সুন্দর হাসি নিশ্চিত করা হয়। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিরাপদ পানীয় জলের ব্যবস্থাকরণ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রায় এক হাজার হ্যান্ড টিউবওয়েল এবং শতাধিক গভীর নলক‚প স্থাপন করা হয়। লাশের কাফন-দাফন কার্যক্রম কর্মসূচির আওতায় নারী-পুরুষের আলাদা মরদেহ গোসলের ঘর নির্মাণ এবং গোসলের জন্য উন্নত মানের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিশ্চিত করা হয়েছে। এ ছাড়াও বিনামূল্যে কাফন-দাফনের বন্দোবস্ত করা হয় এর আওতায়।

সেই সাথে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সব বেওয়ারিশ লাশ আল-মারকাজুল ইসলামী স্বাচ্ছন্দ্যে শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করে থাকে। দুর্যোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কর্মসূচির আওতায় প্রায় অর্ধকোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রামে একটি সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হয় এবং এ প্রকল্পের আওতায় যেকোনো প্রকার দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সার্বিক সহায়তা দেয়া হয়। ১৯৯৮ সালে তিনি নিউ ইয়র্কে ‘দারুল উলুম’ নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এখানে প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী ও ৬০ জন শিক্ষক রয়েছেন। এ বিদ্যায়তন তার স্মৃতি ও কীর্তির অম্লান সাক্ষর। পাশ্চাত্যের শত শত শিক্ষার্থী এই প্রতিষ্ঠানে ইলমে দ্বীনের তালিম পাচ্ছেন। তার লিখিত ‘দুনিয়ার আমল ও আখিরাতের সম্বল’ ‘সহজ নাহবেমির’ বেশ পাঠকপ্রিয়তা পায়। ১৫ মার্চ ১৯৬০ ফরিদপুরের ঝিলটুলি এলাকায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক নিবাস নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলায়। করাচির নিউটাউন মাদরাসা থেকে ১৯৮৮ সালে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। অতঃপর ইফতা (ইসলামী আইনশাস্ত্রে) উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন।
মানবহিতৈষণা ও পরোপকার সত্যিই একটি প্রশংসনীয় কাজ। জনগণ পরোপকারীকে পথিকৃৎ হিসেবে দেখে। মানুষের কল্যাণে যারা আন্তরিক তারা সম্মান ও গৌরব নিয়ে চিন্তা করেন না। তদুপরি তারা তাদের মহৎকাজগুলো প্রকাশ করে এবং এর জন্য প্রতিদানের প্রত্যাশা করে না। স্বীকৃতি চাওয়ার পরিবর্তে তারা অন্যদের অনুপ্রাণিত করার বিষয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। এর কারণ তারা জানে যে পরোপকারের সাথে যে সন্তুষ্টি ও পরিপূর্ণতা আসে তা এক বিশাল পুরস্কার।

ইতিবাচক কাজের মাধ্যমে প্রতিটি মানুষই কোনো না কোনোভাবে পৃথিবীতে অবদান রাখে। সমাজকর্মীরা মঙ্গল ও আলো ছড়াতে অবদান রেখে চলেছেন এবং মানুষকে হতাশার পরিবর্তে আশা দেখাতে সাহায্য করে। ফলে বিনিময়ে সমাজসেবীরা তাদের নিজের জীবনে ইতিবাচক ফলাফল প্রত্যাশা করতে পারে। মুফতি শহীদুল ইসলাম তাদের একজন। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন সরল, সজ্জন ও বন্ধুবৎসল। মানুষকে আপন করে নেয়ার এক সহজাত গুণ ছিল তার। মানবসেবায় ধর্ম ও দল নির্বিশেষে ছিলেন উদার। কোথাও মানুষ বিপদে পড়েছে অথবা দুর্যোগের শিকার হয়েছে শুনলেই তিনি টিম নিয়ে হাজির হয়ে যেতেন। ইসলামী আদর্শের আলোকে একটি কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিল তার আজীবনের লালিত স্বপ্ন। এ মহৎপ্রাণ ব্যক্তিকে একশ্রেণীর হিংসুটে মানুষের জিঘাংসার শিকার হয়ে বহুদিন বিদেশে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়েছে। বহু মামলা মোকদ্দমা দিয়ে তাকে বিব্রত করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে, তিনি কিন্তু দমবার পাত্র ছিলেন না। বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইসলামের নামে এনজিও পরিচালনা করা বেশ কঠিন। ইসলামিক এনজিও পার্বত্য এলাকায় অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মধ্যে সেবাকার্যক্রম চালাতে গেলে জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তোলা হয়। অথচ শত শত খ্রিষ্টান এনজিও দাপটের সাথে কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। বৃত্তিভোগী একশ্রেণীর ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া কাল্পনিক কথা প্রচার করে।

মুফতি শহীদুল ইসলাম ২০২৩ সালের ২৭ জানুয়ারি তার প্রতিষ্ঠিত ঢাকা মানিকগঞ্জের মাদরাসা আবু হুরায়রায় রাত ১টার দিকে ইন্তেকাল করেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস, প্রেশারসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। সেদিন বায়তুল মোকাররম মসজিদে সফররত বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদুল আকসার ইমাম ও খতিব, হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা সা:-এর চাচা হজরত আব্বাস রা:-এর বংশধর শায়খ আলী ওমর ইয়াকুব আল আব্বাসী তার নামাজে জানাজায় ইমামতি করেন। মুফতি শহীদুল ইসলামের সাথে আমার বেশ স্মৃতি রয়েছে। বহু বছর আগে ঢাকা থেকে কক্সবাজার যাওয়ার পথে যখন তিনি ফেনী পৌঁছান। আমাকে মোবাইল করে বলেন, আপনি বাসায় থাকুন, আমি আসছি। নির্ধারিত সময়ে সফরসঙ্গীদের নিয়ে পৌঁছলে আমি দুপুরের খাবারের আয়োজন করি। তিনি আমাকে আমার এলাকা থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনুরোধ করেন। নির্বাচনী ব্যয়ভার তিনি বহন করার আশ্বাস দেন। আমি যৌক্তিক কারণে অপারগতা প্রকাশ করি। কয়েক বছর আগে আরব আমিরাত সফরকালে তার সাথে কথা বলি। আমি বাহরাইন সফরে গেলে তিনি মোবাইলে আমার খোঁজখবর নেন। মানবতার সেবায় মুফতি শহীদুল ইসলাম ছিলেন উৎসর্গিত প্রাণ। তিনি তার সংস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশের সাধারণ দুস্থ মানুষের সেবায় অসামান্য অবদান রেখেছেন। তিনি দ্বীনি শিক্ষা ও সেবামূলক কাজের জন্য আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন ইতিহাসের ক্যানভাসে।

লেখক : অধ্যাপক ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com