Naya Diganta
ছাতকে খতিবের বিরুদ্ধে মামলা

কথা বলতে দিন

ছাতকে খতিবের বিরুদ্ধে মামলা

কথিত সরকারবিরোধী বক্তব্য পেশের অভিযোগে সিলেটের ছাতকে মসজিদের খতিবসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সরকারবিরোধী বক্তব্য পেশের অভিযোগ করা হলেও সংবাদপত্রের খবরে জানা যাচ্ছে, সম্প্রতি পাঠ্যপুস্তকে বিতর্কিত, ইসলামবিরোধী বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি এবং ভুলভ্রান্তি নিয়ে দেশজুড়ে যে আলোচনা-সমালোচনার সূত্রপাত হয়; খতিব সাহেব সেই বিষয়ে কথা বলেন।
বিষয়টি জনগণের বাকস্বাধীনতার সাংবিধানিক অধিকারের বিবেচনায় রীতিমতো উদ্বেগজনক। কিন্তু প্রায় দেড় যুগ ধরে এই প্রবণতা চলছে। সুতরাং এটি আর উদ্বেগ তৈরি করে না। হয়ে ওঠে হতাশা ও নৈরাশ্যের কারণ।
কথা বলার অধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মানবাধিকার ইত্যাদি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার যেসব স্বাভাবিক অনুষঙ্গ সেগুলো গত ১৪ বছরের বেশি সময় ধরে খর্বিত হচ্ছে। সরকারবিরোধিতাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার গুরুতর অপরাধের সাথে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। সংবাদপত্র, গণমাধ্যম, সামাজিকমাধ্যমের বিরুদ্ধে একের পর এক দমনমূলক আইন-কানুন ও বিধি-নিষেধ প্রণয়ন ও কার্যকর করা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। শুধু তাই নয়, মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় রাষ্ট্রীয়ভাবে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে।
বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, ওয়াজ মাহফিল, ফেসবুক, মেসেঞ্জারে মন্তব্য করার জন্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, গ্রেফতার করা হয়েছে, আদালতে তোলা হয়েছে এমনকি পিটিয়ে মেরেও ফেলা হয়েছে। আর এসব ঘটনা ঘটিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও এমন ঘটনা ঘটেছে। কথিত সরকারবিরোধী বক্তব্য দেয়ার অভিযোগে একটি হলের প্রক্টোরিয়াল বডি একজন ছাত্রকে পুলিশে সোপর্দ করে।
গত বছর ১৯ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের মেসেঞ্জার গ্রুপের কথোপকথনকে সরকারবিরোধী কাজ ও জঙ্গি সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততা হিসেবে চিহ্নিত করে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মিফতাহুল মারুফকে থানায় সোপর্দ করেন হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো: বিল্লাল হোসেন। মারুফকে সারারাত থানার লকআপে আটকে রাখা হয়। কিন্তু তার যে মন্তব্যটি নিয়ে এত তোলপাড় সেটির যৌক্তিকতা অস্বীকারের উপায় নেই।
২০২১ সালের নভেম্বরে এক ‘শিশুবক্তা’ রফিকুল ইসলাম মাদানীকে নেত্রকোনার নিজ বাড়ি থেকে আটক করে র‌্যাব। পরে মামলা করা হয়। অভিযোগ সেই একই, সরকারবিরোধী বক্তব্য। গত বছর ১০ আগস্ট নোয়াখালীর হাতিয়ায় ফেসবুকে সরকারবিরোধী মন্তব্য করার দায়ে গ্রেফতার এক যুবককে কারাগারে পাঠানো হয়।
একটি-দু’টি নয়, সারা দেশে সর্বত্র দিনের পর দিন এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। এর কোনো প্রতিকার তো নেইই; বরং মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় রীতিমতো পদ্ধতিগতভাবে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেছে সরকার।
এসব ঘটনা থেকে জনগণকে যে বার্তা দেয়া হচ্ছে তা স্পষ্ট। কোনোভাবে সরকারের কোনো কাজের সমালোচনা করা যাবে না। সরকার ও সরকারি দল থেকে উপর্যুপরি প্রকাশ্য সভা-সেমিনারে, মিডিয়ায় বলা হচ্ছে, সরকারের বিরোধিতা মানে রাষ্ট্রের বিরোধিতা, উন্নয়নের বিরোধিতা।
কিন্তু সমস্যা হলো, সরকার ও রাষ্ট্রের মধ্যে যে মৌলিক প্রভেদ আছে সেটি তারা জেনেশুনে গুলিয়ে ফেলেছেন। বিষয়টিকে তারা কোনো অপরাধ বা গণতন্ত্রের ব্যত্যয় বলে ভাবছেন না। এরই ধারাবাহিকতায় জনগণের একান্ত জীবনে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেছে সরকার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম বন্ধে আড়ি পাতার ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার ।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা আছে এমন সবাই জানেন, রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড আর সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড কখনো এক নিক্তিতে মাপার বিষয় নয়। রাষ্ট্রের বিরোধিতা চরম অপরাধ। এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু সরকারবিরোধিতা কখনো অপরাধ নয়; বরং সরকারের ভুলভ্রান্তি জনগণের সামনে তুলে ধরাই বিরোধী দলগুলোর কাজ। জনগণও এই সমালোচনায় অংশ নেবে, বিতর্ক করবে এবং সরকারকে সঠিক পথে নিয়ে আসার উপায় বাতলে দেবে; এটিই গণতান্ত্রিক-প্রক্রিয়া। এর বিপরীত হলে সেটি সামন্ততন্ত্র অথবা স্বৈরতন্ত্র।
দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সরকার গণতন্ত্রের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসবে এটিই কাঙ্খিত।