Naya Diganta

ভাষার মাস : চেতনার দীপ জ্বলুক, ঈমানের ফুল ঝরুক

ভাষা আল্লাহ তায়ালার বড় পুরস্কার

ভাষা আল্লাহ তায়ালার বড় পুরস্কার। মুখের ভাষা, কলমের ভাষা দু’টিই আল্লাহর বিশেষ দান। সূরাতুর রহমানে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘দয়াময় আল্লাহ, তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন, সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তাকে শিখিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে। (সূরা রহমান, আয়াত : ১-৪)

‘সৃজন’ আল্লাহর এক মহিমান্বিত কর্ম। বান্দার প্রতি তাঁর অসংখ্য নিয়ামত ও পুরস্কারের শিরোনাম। আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন মানুষের সত্তা ও তার গুণাবলী। আল্লাহ প্রদত্ত সেইসব মানবীয় গুণের একটি- ‘বায়ান’- ভাব প্রকাশের যোগ্যতা। যে যোগ্যতাবলে মানুষ তার মনের ভাব স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে, অন্যের ভাব ও বক্তব্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করে। এরই মাধ্যমে মানুষ বোঝে ও বোঝায় দ্বীন-দুনিয়ার সকল ভালো-মন্দ। ফলে এর ওপর নির্ভর করেই পরিচালিত হয় ইহলৌকিক-পারলৌকিক কর্ম-তৎপরতার এক বিরাট অংশ।

কিন্তু দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালার অন্য অনেক বড় বড় নিয়ামতের মতো এই মহানিয়ামতের উপলব্ধি ও কৃতজ্ঞতাও আমাদের অনেকের মাঝে অনুপস্থিত। এক্ষেত্রেও অজ্ঞতা ও অজ্ঞানতার এক সর্বগ্রাসী সয়লাব প্লাবিত করে রেখেছে জীবনের বিস্তৃত অঙ্গনকে। মুমিন হিসেবে আমাদের কর্তব্য, এই মহাপ্লাবন থেকে মুক্তির উপায় অন্বেষণ করা।

আমাদের প্রথমেই সচেতন হতে হবে এই মানবীয় গুণটির স্বরূপ ও সূত্র সম্পর্কে। এর স্বরূপ হচ্ছে, এটি আল্লাহর নিয়ামত আর এর সূত্র তিনিই, যিনি আমাদের তা দান করেছেন। তিনি আল্লাহ, রাহমানুর রাহিম। মানুষকে তিনি সৃষ্টি করেছেন সর্বোত্তম দৈহিক ও মানসিক গঠনে; তাকে দান করেছেন বোধ-বুদ্ধি, চেতনা-উপলব্ধি, ভাষা ও বাকশক্তি। কাজেই তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা আদায় করা আমাদের অতি বড় কর্তব্য। শোকর ও কৃতজ্ঞতার প্রথম শর্ত কী? নিয়ামতের যিনি স্রষ্টা তাঁকে চেনাই হচ্ছে কৃতজ্ঞতার প্রথম শর্ত। এরপর মুখে ও অন্তরে তাঁর দান স্বীকার করা, সেই দানের সুফল ও উপকারিতা স্বীকার করা, তা যে এক আল্লাহর দান, অন্য কারো এতে কোনো অংশীদারত্ব নেই এই সত্য উপলব্ধি করা, স্বীকার করা ও শিরোধার্য করা।

তেমনি কৃতজ্ঞতার এক বড় দিক, আল্লাহর নিয়ামত আল্লাহর মর্জি ও সন্তুষ্টির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা, তাঁর নারাজি ও নাফরমানির ক্ষেত্রে ব্যবহার না করা। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত সহজ ভাষায় বাকশক্তির যথার্থ ব্যবহারের উপায় নির্দেশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যে আল্লাহ ও আখিরাতের দিবসে ঈমান রাখে সে যেন ভালো কথা বলে অথবা নীরব থাকে। (সহীহ বুখারি, হাদিস : ৬০১৮)

বোঝা যাচ্ছে যে, ঈমানের এক দাবি, বাকশক্তির ব্যবহারে সংযমী ও সুবিবেচক হওয়া। কথাও মানুষের কর্মেরই অংশ, যা আমলনামায় লিপিবদ্ধ হয়। কথাতেও আছে ভালো-মন্দ, সওয়াব-গুনাহের প্রসঙ্গ, আছে সংযম ও নিয়ন্ত্রণের বিধান। জীবনের অন্য সকল বিষয়ের মতো কথার ক্ষেত্রেও মুমিনকে চলতে হবে হালাল ও সওয়াবের পথে, বেঁচে থাকতে হবে হারাম ও গুনাহের পথ থেকে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই নীতি যেমন মুখের কথার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তেমনি প্রযোজ্য লেখার ক্ষেত্রেও। বরং লেখা সাধারণত কথার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

কৃতজ্ঞতার আরেক দিক হচ্ছে, নিয়ামতের সংরক্ষণ ও পরিচর্যা। ভাব প্রকাশের যে যোগ্যতা আল্লাহ তায়ালা দান করেছেন- এজন্য মুমিনের করণীয়, এই নিয়ামতের গুরুত্ব ও মর্যাদা উপলব্ধি করা এবং এর পূর্ণ বিকাশ ও নিখুঁত ব্যবহারে প্রয়াসী ও পারদর্শী হওয়া। সাধারণভাবে যেকোনো ভালো কাজেই চৌকস হওয়া কাম্য। আর মুমিনের তো শুধু চৌকস হওয়া নয়, তাকে হতে হবে আপন ক্ষেত্রে অনন্যসাধারণ।

এক প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে লক্ষ্য করে বলেছেন, ‘লোক সমাজে তোমাদের হতে হবে তিলক-সদৃশ।’ জ্বী, সৌন্দর্যে ও পারিপাট্যে তিলক-সদৃশ। এই নবী-নির্দেশনার অনুসরণে মুমিনকে হতে হবে অন্তরে-বাহিরে সুরভিত, সৌন্দর্যমণ্ডিত। বেশ-ভুষায়, আচরণে-উচ্চারণে সব কিছুতেই থাকতে হবে তার উজ্জ্বল আদর্শের প্রতিফলন। তার চেতনার আলো, বিশ্বাসের সুরভি ভাষার সৌকর্য যেন চারপাশকে করে তোলে মুগ্ধ ও মোহিত, আলোকিত ও আলোড়িত।

প্রশ্ন হচ্ছে- ভাষার যত্ন ও পরিচর্যার এর চেয়ে গভীর ও যথার্থ শিক্ষা আর কিছু হতে পারে কি?

বস্তুত ঈমানের আলো-ই আমাদের সামনে উদ্ভাসিত করে তোলে আমাদের ভাব প্রকাশের যোগ্যতা এর সূত্র ও স্বরূপ, এর প্রয়োগ ও ব্যবহারের মৌলিক সীমারেখা। তেমনি ঈমানই আমাদের সামনে উন্মোচিত করে দেয় ভাষা-কেন্দ্রিক সকল অন্যায়-অনাচার এবং জাহেলী চিন্তা ও কর্মের স্বরূপও।

কে না বুঝবে, ভাষাকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন মানুষের সেবকরূপে। অথচ জ্ঞানহীন ও জাহেলিয়াতগ্রস্ত অনেক মানুষের কাছে স্ব স্ব অঞ্চলের ভাষা তার এই স্বাভাবিক অবস্থান অতিক্রম করে উন্নীত হয়ে যায় ভক্তি ও প্রণামের স্থানে। এর ওপর আরোপিত হয় দেবত্বের ছাপ। ফলে মানুষের সেবকের স্থলে সে দখল করে বসে সেবিতের, এমনকি উপাস্যের স্থান। ভাষা তখন আর রহমত থাকে না, আজাবে পরিণত হয়; নির্মাণের উপায় থাকে না, ধ্বংসের যুপকাষ্ঠে পরিণত হয়। একে কেন্দ্র করে তৈরি হয় দলাদলি-সম্প্রদায়িকতা। জ্বলে ওঠে হিংসা, হানাহানির আগুন। তখন এই ভাষা-দেবীর বেদীমূলেই বলী হয়ে যায় মানুষ ও তার সম্পদ-সম্ভ্রম, যার জন্য এই ভাষার সৃষ্টি!

কে না বুঝবে যে, ভাষা মানুষের জন্য, মানুষ ভাষার জন্য নয়। একজন মানুষের মন-প্রাণ, সম্পদ ও সম্ভ্রমের মূল্য ভাষা ও সাহিত্যের সুবিপুল সম্ভারের চেয়েও অনেক বেশি।

ভাষা এসেছে সত্য-ন্যায়ের গোলাপ ফোটাবার জন্য, প্রীতি-ভালোবাসার পুষ্প বর্ষণের জন্য। ভাষা তো নয় অবিশ্বাস-অশ্লীলতা বিস্তারের জন্য কিংবা ও ঘৃণা-শত্রুতার বিষ ছড়াবার জন্য।

আল্লাহ-প্রদত্ত ভাষাকে যদি অবিশ্বাস-অশ্লীলতার বিস্তারেই ব্যবহার করা হয়, তাহলে এর চেয়ে কি ভালো নয় মুক ও বধির হওয়া?

সত্য বটে, একমাত্র ঈমানই পারে মানুষকে প্রকৃত মানুষ করে তুলতে। মানবের সকল গুণ ও বৈশিষ্ট্যের সঠিক বিকাশ ও যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করতে। আর তাই ঈমান ও আমলে ছালেহ থেকে বঞ্চিত মানুষ নেমে যায় অবলা পশুর স্তরে; বরং তারও নিচে। তার যোগ্যতাগুলোই তখন তার অবক্ষয়-অধঃপতন ত্বরান্বিত করে। কত সত্য মহান স্রষ্টার বাণী, ‘আমি তো সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম গঠনে। অতপর আমি তাকে পরিণত করি হীনতাগ্রস্তদের হীনতমে। কিন্তু তাদেরকে নয়, যারা মুমিন ও সৎকর্মপরায়ণ; তাদের জন্য তো রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন পুরস্কার। (সূরা ত্বীন, আয়াত : ৪-৬)

তাই আসুন, ঈমানের দীপ জ্বালি, ঈমানের পথে চলি। ঈমানই পথ, ঈমানই পাথেয়। ঈমানই আমাদের কর্ম ও রচনার চূড়ান্ত লক্ষ্য।