Naya Diganta

পাতাল রেলের যুগে দেশ

পাতাল রেল

সত্যিকার অর্থে ২ ফেব্রুয়ারি পাতাল মেট্রোর যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। পাতাল রেলের ডিপোর নির্মাণকাজ উদ্বোধনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই যুগের সূচনা করেন। আর ২০২৬ সালের মধ্যে এমআইটি লাইন-১ এর কাজ শেষ হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক। তিনি আরো বলেছেন যে, এই লাইনের কাজ প্রাক্কলিত সময়ের আগেই সম্পন্ন হবে।

আশা করা ভালো। আমরা বহুবারই এই রকম কথা বলেছি, ঘোষণা করেছি এবং সেই চিন্তার পথ ধরে স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু সেই স্বপ্ন বা আশা কখনোই যথাসময়ে বা প্রাক্কলিত সময়ে বাস্তবের রূপ পায়নি, কাজ শেষ করা যায়নি। ছোটো প্রকল্প বা বড় প্রকল্প এবং মেগা প্রকল্প-যেটার কথাই বলা হোক না কেন ১/২টি বাদে মেগা কিংবা অমেগা প্রকল্পের কোনোটাই নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করতে পারেননি দায়িত্বপ্রাপ্তরা।

আমাদের রাজনৈতিক সরকার উন্নয়নের প্রশ্নে উদার, মানবিক এবং প্রায়ই নীতিবিচ্যুত। প্রকল্প ডিজাইনের পর ব্যয় ও সময় প্রাক্কলনের ভেতর দিয়ে এসে যখন কাজ শুরু হয়, তখন দিগন্তবিস্তৃত স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেন রাজনৈতিক সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। প্রকল্প বাস্তবায়নে যখন ব্যর্থ হয় দায়িত্বপ্রাপ্ত পিডি, বিদেশি ঠিকাদার, তখন তাদের তরফে সরকারই নানা রকম ব্যাখ্যা ও প্রতিকূলতার দোহাই দিতে থাকে। কোভিড-১৯ এর দোহাই-এর পর এখন চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অভিঘাত, যা পৃথিবীর সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক পরিস্থিতিকে নড়বড়ে করে দিচ্ছে। এই প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট ক্ষতি সন্দেহাতীতভাবে আমাদের সঙ্কটের মধ্যে ফেলেছে। আর ওই সঙ্কটের মূলে আছে অমানবিক লোভ।

আমরা গরিব দেশ নই, আবার ধনী দেশও নই আমরা। আমাদের অবস্থা না ঘরকা, না ঘাটকা। মন্দও না আবার ভালোও না। এই অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার হিমশিম খাচ্ছে। খাবি খেতে খেতে মাথা তোলার সংগ্রাম করছে। সেটা ক্ষতির না, ভালোই বলতে হবে। আইএমএফের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী আর্থিক খাত সংস্কার করছে সরকার। বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব আইএমএফের নীতি-রীতি অনুসরণে করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আরো কিছু খাতের সংস্কার করতে পারলে সত্যই লাভবান হবে দেশ। সরকারের সক্ষমতারই প্রমাণ মিলবে। সেই সংস্কারের প্রধান খাত গ্যাস-বিদ্যুৎ-আর্থিক খাতের সংস্কার। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম এরই মধ্যে বাড়ানো হয়েছে। এতে ব্যবহারকারী ভোক্তাদের ওপর আর্থিক চাপটি দিলেন সরকার। কারণ আইএমএফ এই প্রেসক্রিপশনই করেছে। তাদের কথা না শুনলে, মানে সংস্কার না করলে তারা ৪৭০ কোটি ডলারের যে ঋণ অনুমোদন দিয়েছে, তা দিত না। সাধারণ ও স্বাভাবিক প্রশ্ন হচ্ছে সরকারকে আইএমএফের ঋণ নিতে হচ্ছে কেন? তার কারণ অনেকই। তবে সরকার তার নির্দিষ্ট কিছু খাতের উন্নয়নের জন্য টাকাটা নিচ্ছে। সরকারের হাতে যে অর্থের ঘাটতি আছে, সেটা ঋণ নেয়া থেকেই বোঝা যায়। কিন্তু সেটা স্বীকার করে না সরকার। রিজার্ভে চাপ পড়ছে এটা স্বীকার করেও সরকার বগল বাজায় রেমিট্যান্সের গতি বাড়ায়। কিন্তু রেমিট্যান্সের ভেতরে অনেক প্রশ্ন আছে।


আমদানিকৃত এক্সেসরিজ ও কাপড়ের মূল্য পরিশোধের পর কত টাকা আর সরকারের কোষে যায়?


আবার বিশাল অঙ্কের টাকা শিল্পপতিদের কাছে খেলাপি হয়ে পড়ে আছে। সেই টাকাটা সরকার ফিরিয়ে আনতে পারছে না। আইএমএফ সেই টাকা তুলে আনার জন্য চাপ দিয়েছে সরকারের ওপর। সরকারের চার পাশের ব্যক্তিরাই মূলত বিশাল অঙ্কের খেলাপিঋণী। কী কী কারণে সেই ঋণখেলাপিদের বছরের পর বছর ছাড় দিয়ে জনগণের অর্থের পাচার ও লুটপাট বন্ধ করছেন না, সেটা আমরা জানি না। সরকার বিনিয়োগ খাত থেকে খেলাপ হয়ে যাওয়া অর্থ ফেরত আনতে পারবে কি না, জানি না। তবে চেষ্টা তো করছে বা করবে, এটাই আমরা শুনেছি বা পড়েছি পত্রিকায়। সরকার বিরোধী রাজনীতিকদের চামড়া তুলে নিতে যে অঙ্গভঙ্গি ও কথার ছুরি চালাচ্ছেন, সেই প্রয়াসটা যদি খেলাপিদের বিরুদ্ধে চালাতেন, তাহলে বোধ হয়, জনগণের অর্থ অনেকটাই ফিরে আসত। আমরা সেই আশাই করতে চাই।

২.
বাংলাদেশ এবার পাতাল মেট্রোরেলের যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। গত ২ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে এমআরটি লাইন-১-এর নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুরুতে করা হবে ডিপো এলাকার ভূমি উন্নয়নকাজ। ডিপোটি হবে নারায়ণগঞ্জের পিতলগঞ্জের ১ হাজার ২১৯ একর জমির ওপর। মেট্রোরেলটির পাতাল অংশ পড়েছে বিমানবন্দর, খিলক্ষেত, বাড্ডা, রামপুরা, মালিবাগ, রাজারবাগ, কমলাপুরের মধ্যে। এ রুটের বিদ্যমান সড়কের নিচ দিয়ে তৈরি হবে পাতাল রেলপথ। এর বেশির ভাগই মাটির ১০ থেকে ৩০ মিটার নিচ দিয়ে যাবে। তবে সবচেয়ে গভীরতম অংশ হবে মালিবাগ-রাজারবাগের মধ্যবর্তী এলাকা। এ অংশে মাটির ৭০ মিটার নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন। (প্রথম আলো/০২/০১/২৩ )

বোঝা যায়, পাতাল রেলের কাজ সত্যই শুরু হচ্ছে। তবে শুরুটা যদি বোরিং মেশিন দিয়ে পাতাল কেটে টিউব বসানোর কাজটি হতো, তাহলে আমাদের মতো স্বপ্নবাজ গরিব মানুষদের মনে আশা বাস্তব হয়ে উঠত। ডিপোর ভূমি উন্নয়নের কাজটিও পাশাপাশি করলে অতি দ্রুতই এই লাইনের কাজের অগ্রগতি সাধিত হতো। এই প্রকল্পের ঠিকাদার যখন বিদেশী, তারা দ্রুত কাজ করতেই অভ্যস্ত। জাইকা যেহেতু অর্থায়ন করছে, তখন অর্থের সরবরাহ ঘাটতি হবে না, এটা আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু নির্দেশদাতা সরকারি তরফ ভেবেছে পাতালে কাজ হলে তো আমজনতা চোখে কিছুই দেখতে পাবে না, তাই রাজনৈতিক সরকারের ওপর তেমন কোনো ইমেজে ভালো ইমপ্যাক্টও পড়বে না। আবার এই লাইনটি দ্রুত সম্পন্ন করতেই তারা তিনটি বোরিং মেশিন ব্যবহার করবে, এ‘কথা পিডি’র। এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো উচিত।

এমআরটির মোট ছয়টি উড়াল ও পাতাল লাইনের মধ্যে লাইন ১-ই পাতাল ফুঁড়ে যাবে। বাদবাকিগুলো উড়ালপথেই হবে। ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা মহানগরের রেলযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে পাতাল যাত্রাই হতো ভালো সিদ্ধান্ত। এতে কি উড়াল পথের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি পড়ত? সময় বেশি লাগবে? আরো কিছু জটিলতা কি হবে পাতাল কেটে মেট্রোরেল লাইন বসাতে? কে জানে?

পিডিকে বা ঠিকাদারকেও একটা প্রশ্ন করতে পারি আমরা, তারা যেন ব্যবসার লাভের জন্য সময় অপচয় না করেন। ২০৩০ সালের মধ্যে সব লাইন নির্মাণের চেষ্টা করে দেখাতে হবে যে তাদের ভেতরে আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। ঘাটতি আমাদের মন-মানসিকতায়। আমরা তো কুমির ও শেয়াল পণ্ডিতের সেই লোকগল্পের কাহিনী জানি। শেয়াল পণ্ডিত কুমির ছানাদের একটি রেখে বাকিদের হাপিস করে দিয়েছিল। একটাকেই বারে বারে দেখিয়ে কুমিরকে খুশি করেছিল সে। সরকারও মেট্রোসহ মেগা প্রকল্পগুলো দেখিয়ে জনগণকে খুশি রাখার তরিকা নিয়েছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে। এই উন্নয়নের ধামাকা লেজ দেখানোর কাজটি বাদ দিয়ে পাচার হয়ে যাওয়া ১১ লাখ কোটি টাকা ফেরত আনার কাজটিই প্রধান কাজ সরকারের। আর ঋণখেলাপিদের পেট থেকে সুদেমূলে টাকাটা আদায় করতে হবে। দলীয় লোক বলে ছাড় দেবার যেসব ব্যবস্থা তারা আইনের মাধ্যমে ‘সুযোগ’ বা ফোকর’ করে রেখেছেন, সেই ছিদ্রগুলো বন্ধ করতে হবে সব কিছুর আগে। না হলে যে লাউ সেই কদুই হবে। জনগণের আশা পূরণ হবে না।

পাতাল কাটার বোরিং মেশিনে পাতাল কেটে মেট্রোর টিউব বানান, জনগণের হৃৎপিণ্ড কাটবেন না দয়া করে।