Naya Diganta

নানাভাই

তখন আমি বেশ ছোট। সেই সময়কার একটি ঘটনা। মা আমাকে ডেকে বলল, আব্বা নানাবাড়ি বেড়াতে যাবে? মায়ের কথা শোনামাত্রই আমি খুশিতে বাকবাক। দৌড়ে গিয়ে একবার জামা টেনে নামাই, আরেকবার প্যান্ট টেনে নামাই। খুশিতে যেন আত্মহারা, পুরো দিগি¦দিক হয়ে গেলাম। কারণ নানাবাড়ি বেড়াতে যাওয়ার মজাই আলাদা। খুব সাজগোজ করে মায়ের সাথে বের হলাম।
সময়টা ছিল গ্রীষ্মকাল। চার দিকে রোদের প্রখরতা। যেন অগ্নি ঝরছে আকাশ থেকে। গাড়িতেও মানুষের প্রচণ্ড ভিড়। সব মিলিয়ে বাহ্যিক পরিবেশটা ছিল সম্পূর্ণ প্রতিকূল। তবুও নানাবাড়ির মজার কাছে এসব কষ্ট ছিল অতিনগণ্য। তা যেমনই হোক, গাড়ি চলছে আপন গতিতে। হর্নের পোঁ পোঁ শব্দ অনাবরত কানে আসছে। খানিক পরে গেটে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি আওয়াজ দিচ্ছে ‘শাহপুর, শাহপুর’, জলদি লাবেন জলদি লাবেন। আমি জানালা দিয়ে গলা উঁচিয়ে দেখি একদম চলে এসেছি। তখন তো খুশির বাহার দেখে কে!
গাড়ি থেকে নেমেই নিজের গুটিপায়ে শাঁই শাঁই করে হাঁটতে লাগলাম। আর মা পিছে আপন গতিতে আসছে। অবশেষে এসে গেলাম নানা বাড়ি। সেখানের দৃশ্যগুলো আমাকে এখনো আনমনা করে তোলে। জায়গাটা খুবই মনোরম, বাড়ির চার পাশে আমবাগান, জামবাগান, কাঁঠালবাগান। বিস্তৃত ছায়াভরা এলাকা। সব মিলিয়ে পরিবেশটা ভালোই অনুভব করি। ঠিক এখনো।
ঘরের সামনে একটা আমগাছ। গিয়ে দেখি গাছের নিচে চৌকি পেতে গড়াগড়ি করছে নানাভাই। সে ছিল খুবই সুন্দর গড়নের। দৈহিক বিবেচনায় বলতে গেলে নানাভাই একজন চমৎকার মানুষ। সামনের একটি দাঁত ছিল হালকা ভাঙা। এটাই তার সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে তুলত। আমি দৌড়ে গিয়ে নানার পেটের ওপর উঠে বসি। নানা আমার দু’গালে চুমু খাচ্ছিল আর বলছিল, ‘আমার ভাই একদিন হাফেজ হবে, বড় আলেম হবে, সেদিন আমার খুশি কে দেখে? সারা গ্রামের মানুষকে ডেকে ডেকে বলব, তোমরা দেখো, আমার ভাই আজ হাফেজ হয়েছে, বড় আলেম হয়েছে।’ এমন করে বলে বলে নানা তার হৃদয়-কোণে চেপে রাখা আশাগুলো ব্যক্ত করেছিল। তবে সেদিন এ আশার মর্ম আমি বুঝিনি। বুঝিনি সে কথার পরিধি কতটুকুন ছিল।
যে দিন ইফতা শেষ করলাম, সে দিন রাতে ঘুমের সময় নানাভাইয়ের সেই কথাগুচ্ছ কেন জানি একে একে হৃদয়-জানালায় উঁকি দিচ্ছিল। তখন নানার ওই কথা মনে করে খুবই কাঁদছিলাম আর আক্ষেপ নিয়ে বলছিলাম, আহ আজ যদি আমার নানাভাই বেঁচে থাকত তাহলে কত খুশিটাই না হতো! মানুষের সামনে খুব গর্বভরে আমার কথা বলত। কথাগুলো আমি যতই মনে করছিলাম, দমে থাকা কষ্টগুলো ঠিক ততটাই অশ্রুফোঁটা হয়ে ভিড় জমাতে লাগল চোখের কিনারায়। লোনাপানির চাপ যেন ক্রমে বাড়তেই লাগল। আমার ভেতরটা তখন ফুলে ফেঁপে একাকার হয়ে গেল। কখন যে ঢলে পড়লাম নিদ্রাকোলে, বুঝতেই পারলাম না।