Naya Diganta

শিক্ষাক্রমে ধর্মের সহাবস্থানবিষয়ক আলোচনা

কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর কাছে ইসলামই হচ্ছে একমাত্র মনোনীত দ্বীন।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত -১৯) অপর একটি আয়াতে বলা হয়েছে- ‘যদি কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো দ্বীন গ্রহণ করতে চায়, তাহলে তা কখনোই কবুল করা হবে না।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-৮৫) আল্লাহ আরো বললেন- ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চিত জেনে রাখো, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সূরা আল বাকারা, আয়াত-২০৮)

ইসলাম এমন এক দ্বীন তথা জীবনবিধান যেখানে মানুষের প্রতি উদাসীনতা বা অমানবিকতা প্রদর্শনের কোনো সুযোগ নেই। তবে সেটি অবশ্যই হতে হবে, ইসলামী পথ ও পদ্ধতি অনুযায়ী। কোনো মানবসৃষ্ট মতাদর্শের ভিত্তিতে নয়। ইসলামে কোনো ধরনের সঙ্কীর্ণতা ও বাড়াবাড়িকেও প্রশ্রয় দেয় না। ইসলাম এসেছে মানুষের কল্যাণ নিয়ে। অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখাতে। বলা হয়েছে- ‘তিনি (আল্লাহ) দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের ওপর কোনো প্রকার সঙ্কীর্ণতা বা কঠোরতা জোর করে চাপিয়ে দেননি।’ (সূরা হজ, আয়াত-৭৮)

ইসলাম অপরের মতাদর্শকে সম্মান জানায়, কাউকে জোর করে ইসলাম গ্রহণে কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ করে না। ইসলাম যে এক আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত জীবনবিধান, এ বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করলে কুরআন তার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। যদি সে তার যুক্তির উপরে সত্যবাদী হয়, তাহলে যেন সে প্রমাণ করে দেখায়, এটি এক আল্লাহ মনোনীত জীবন বিধান নয়। ইসলাম কখনোই ইসলামকে আবেগের বশে অনুসরণ করতে বলে না। এ কারণে কুরআন বারবার মানুষকে চিন্তা-ভাবনা করার প্রতি জোর তাগিদ জানিয়ে আসছে। কুরআনকে বোঝার জন্য যারাই কুরআনের সংস্পর্শে এসেছে কুরআন তাদের বদলে দিয়েছে। তাদের জীবনের সঠিক রাস্তা চিনিয়ে দিয়েছে।

ইসলামের মূল আকিদাই হলো- তাওহিদ। আর তাওহিদের প্রথম কথাই হলো- আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের স্বরূপ এ রকম যে, আল্লাহ জাত, সেফাত, অস্তিত্ব ও ক্ষমতায় অদ্বিতীয়। এ কারণে বিশ্বাস, কথায় ও কাজে আল্লাহর প্রতি কোনো ধরনের অংশীদার সাব্যস্ত করাকে ইসলাম সবচেয়ে বড় পাপ বলে অভিহিত করেছে। বলা হয়েছে- ‘আল্লাহ তার সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করাকে কোনোভাবেই ক্ষমা করেন না, এ ছাড়া যাকে ইচ্ছে অন্য যেকোনো ধরনের অপরাধ ক্ষমা করেন, যে আল্লাহর সাথে শরিক করে সে মহাপাপ করে।’ (সূরা নিসা, আয়াত-৪৮)

আমাদের রাসূল বলেন, ‘যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় মারা গেল সে আল্লাহর সাথে কাউকে শিরক করেনি সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় মারা গেল যে আল্লাহর সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করেছে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ (মুসলিম, হাদিস-৯৩)

কথাগুলো আমরা শিক্ষাক্রম প্রসঙ্গে বলছি। বর্তমানে নতুন কারিকুলামে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন শেখানো কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার দিয়েই ঢেলে সাজানো হয়েছে। অবশ্য এই কারিকুলাম নিয়ে ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহল থেকে বেশ সমালোচনাও উঠছে। আবার অনেক ইতিবাচক দিকও রয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ শ্রেণীতে সহাবস্থান নিয়ে একটি অধ্যায় সংযুক্ত করা হয়েছে। দেখা যায়, ষষ্ঠ শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে সহাবস্থান নিয়ে যে আলোচনা করা হয়েছে তাতে কোনো ধরনের আপত্তিকর মন্তব্য না থাকলেও শিক্ষক সহায়িকায় অন্য ধর্মের সহাবস্থান নিয়ে যা বলা হয়েছে তা ইসলামের সাথে বেশ কিছু আকিদাগত অমিল রয়েছে।

যদিও এ বিষয়গুলো অন্য ধর্মের সহাবস্থান প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে। তবুও কোমলমতি শিক্ষার্থীরা এখান থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। অন্য ধর্মের সহাবস্থানের বিষয়টি পড়তে গিয়ে তারা ইসলাম সম্পর্কে অনুরূপ ধারণা পোষণ করতে পারে। মোটা দাগে অনেকে এখানে এক ধরনের সূত্র চিন্তারও গন্ধ খুঁজে পান। শিক্ষক যখন এই বিষয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করবেন বা সেশন পরিচালনা করবেন শিক্ষার্থীরা অবশ্যই এ বিষয়ে তথ্য খুঁজে নিতে বাধ্য থাকবে।

অনেকেই প্রশ্ন রাখছেন, অন্য ধর্মের সহাবস্থানকে কেন পাঠ্যবইয়ে উল্লেখ করা হলো না। কেন সেটিকে সুকৌশলে শিক্ষক সহায়িকায় স্থান দেয়া হলো। যদি পাঠ্যবইয়ে উল্লেখ করাকে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক বলে মনে করলেন, তাহলে কেন তারা সেটিকে অন্যভাবে কোমলতি শিক্ষার্থীদের পড়াতে বাধ্য করলেন। সহাবস্থান নিয়ে ইসলামে উদারতার কী এতই কমতি ছিল যে, অন্য ধর্মের সহাবস্থানের প্রসঙ্গ নিয়ে ইসলাম বিষয়ে সহাবস্থান বোঝাতে হবে, যেখানে বইটি আকিদাগত নানা ত্রুটিতে ভরপুর।

কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যখন এ বিষয়গুলো পড়বে, তারাও মনে করবে ইসলামেও ইসলামী অনুশাসন পালন ও ধর্মীয় বাধা-নিষেধের বালাই নেই। ফলে এটি তাদের বিশুদ্ধ আকিদায় ফাটল ধরাতে সক্ষম হবে। কারণ ইসলাম শিক্ষায় সহাবস্থান সম্পর্কে পাঠ্যবইয়ে যা বলা হয়েছে শিক্ষক সহায়িকায় অন্যান্য ধর্মের সহাবস্থানে তার থেকে বেশ কিছু আকিদাগত ব্যতিক্রমী বিষয় রয়েছে। সেসব বিষয়ের পার্থক্য নির্ণয় করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিশুদ্ধ আকিদায় অটুট থাকা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

ইসলামে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করার জন্য প্রকৃত মুসলিম মনীষীদের জীবনী থেকে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো এখানে তুলে ধরা যেত। প্রতিবেশীর অধিকার, তাদের প্রতি সদয় আচরণ, তাদের অধিকার রক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সহাবস্থানের বিষয়টিও নিশ্চিত হতো। কিন্তু বিষয়টি একেবারে ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করা হয়েছে।

ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষক সহায়িকায় হিন্দুধর্মে সহাবস্থান নিয়ে বর্ণনা প্রসঙ্গে একজন ধর্মগুরুর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে- ‘...সব ধর্মের উদ্দেশ্য ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা, বিভিন্ন ধর্ম বিভিন্ন পথে হাঁটলেও সব ধর্মই স্র্রষ্টার নৈকট্য লাভ করতে চায়।’ এখানেই তার একটি বিখ্যাত বাণীতে বলা হয়েছে- ‘সব ধর্মই সত্য, যত মত তত পথ’ অর্থাৎ বিভিন্ন ধর্মের মত ও পথ ভিন্ন হলেও তাদের উদ্দেশ্য ও গন্তব্য এক বা অভিন্ন।

ইসলাম শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষক সহায়িকায় এ রকম একটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকলে এটি কোমলমতি শিশুদের ভুল বার্তা দিতে পারে। পবিত্র আল-কুরআনে বলা হয়েছে- ‘... যে ব্যক্তি তার প্রভুর সাক্ষাৎ কামনা করে সে যেন নেক আমল করে আর তার প্রভুর ইবাদতে কাউকে কোনো প্রকার শরিক সাব্যস্ত না করে।’ (সূরা কাহফ, আয়াত-১১০) একজন মুসলমানকে আল্লাহর প্রতি প্রকৃত আত্মসমর্পণকারী মুসলিম হিসেবে বেড়ে উঠার জন্য শিরকমুক্ত ঈমান খুবই প্রয়োজন। তাই তো আল্লাহ বলেন- ‘যদি কোনো পুরুষ বা নারী নেক আমল করে আর সে ঈমানদার হয়, আমি অবশ্যই তাদেরকে দুনিয়াতে পবিত্র জীবন দান করব। আর আখিরাতে তাদের ভালো কাজের জন্য সর্বোত্তম পুরস্কার দেবো।’ (সূরা নাহল, আয়াত- ৯৭) যদি কোনো মুসলমানের ঈমান ও আমলে শিরকের ছোঁয়া ধরিয়ে দেয়া যায়, তাহলে তার সমুদয় আমল বরবাদ হয়ে যাবে। ইসলামে আল্লাহর প্রতি ইবাদতে, যে মত ও মতকে স্বীকার করে তা অন্য কোনো ধর্মের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

খ্রিষ্টধর্মে সহাবস্থান নিয়ে আলোচনার এক স্থানে বলা হয়েছে- ‘যারা ঈশ্বরের সন্তান হিসেবে দাবি করে তাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব সৃষ্টি ও স্র্রষ্টার প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করা।’ এখানে ইসলামের সাথে আকিদাগত বড় একটি ফারাক রয়েছে। যদি কেউ এই বিশ্বাসে অটল থেকে ধর্মীয় আইন-কানুনন মেনে চলে, তাহলে তার কোনো ইবাদতই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। সূরা ইখলাসে আল্লাহ নিজের পরিচয় তুলে ধরে বলেছেন-‘‘বলো আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। তিনি কারো থেকে জন্ম নেননি, আর তাকেও কেউ জন্ম দেয়নি। আর তার সমতুল্য কেউ নেই।’’ সুতরাং ঈশ্বরের সন্তান এ পরিভাষাটি ইসলামের সাথে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে না। মানুষ আল্লাহর গোলাম হতে পারে, তাকে ভালোবাসতেও পারে, কিন্তু কখনোই তাঁর সমতুল্য হতে পারে না।

অন্য আরেক জায়গায় বলা হয়েছে- ‘সামাজিক বা ধর্মীয় যেকোনো বাধার ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ অন্য মানুষের প্রতি প্রেম বা সহমর্মিতা প্রকাশ করতে পারে।’ এখানেও কোমলমতি শিশুদের চিন্তা ও মননে ইসলামপরিপন্থী বিষয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হচ্ছে। তারা নিজের অজান্তেই অবচেতন মনে এই বিশ্বাসের সাথে নিজেদের একাত্মতা ঘোষণা করবে। তারা মনে করবে, ইসলামের ক্ষেত্রে হয়তো এ ধরনের উদাসীনতা প্রদর্শন করা দূষণীয় নয়। অথচ সূরা বাকারার ২০৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো আর শয়তানের অনুসারী হয়ো না।’

ষষ্ঠ শ্রেণীর এই শিক্ষক সহায়িকার আরেকটি জায়গায় বলা হয়েছে- ‘ধর্ম মানুষের জন্য, মানুষ ধর্মের জন্য নয়।’ এটি ইসলাম শিক্ষার সাথে পরিপূর্ণ সাংঘর্ষিক একটি বিষয়। ইসলামে প্রণীত সমূহ বিধি-বিধান মানুষের জন্য উপযুক্ত বিধায় তা পালনে অপরিহার্য করে দিয়েছেন। এখানে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও উপেক্ষার ভঙ্গিতে একটু কমানো বা বাড়ানোর সুযোগ তিনি রাখেননি। যার জন্য যেটুকু প্রযোজ্য সেভাবেই তিনি তা বর্ণনা করেছেন।

আল্লাহ বলেন- ‘যারা অকৃতজ্ঞ ও অবিশ্বাসী তারা ঈমানের চেয়ে কুফরকেই বেশি ভালোবাসে।’ (সূরা তাওবা, আয়াত-২৩) অন্য আয়াতে বলা হয়েছে- ‘অবিশ্বাসীরা দুনিয়াকে ভালোবাসে।’ (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত-১৫২) আরেক আয়াতে এসেছে- ‘অকৃতজ্ঞরা দুনিয়ার জীবনকে ভালোবাসে।’ (সূরা নাহল, আয়াত-১০৭) সুতরাং একজন ঈমানওয়ালা মানুষ বা মুসলিম পরিবারের সন্তানকে এ বিষয়টির সাথে পরিচয় না করিয়ে কীভাবে ইসলামী আদর্শ মোতাবেক সমাজে পারস্পরিক সহাবস্থান নিশ্চিত করা যায়, সে দিকটি ফুটিয়ে তোলাই শ্রেয়।