Naya Diganta

মেয়াদ শেষে নির্বাচনমুখী বাজেটে মোদি সরকারের যেসব পদক্ষেপ

মেয়াদ শেষে নির্বাচনমুখী বাজেটে মোদি সরকারের যেসব পদক্ষেপ।

ভারতে আগামী অর্থবছরের বাজেটে মূলধনী খরচে ব্যাপক বৃদ্ধি, মধ্যবিত্তদের আয়করে ছাড় ও সার্বিক আর্থিক শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য নানা প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। আগামী বছরের সাধারণ নির্বাচনের আগে এটাই ছিল নরেন্দ্র মোদি সরকারের শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট, তাই এবারের বাজেটে বেশ কিছু ‘পপুলিস্ট’ বা জনমোহিনী পদক্ষেপ থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল।

বুধবার ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সিতারামন পার্লামেন্টে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য এই কেন্দ্রীয় বাজেট উপস্থাপন করেন।

ভারতে বিবিসির বিজনেস ইউনিট এই বাজেটের মূল চারটি বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করেছে।

অবকাঠামোতে ব্যয় বৃদ্ধি
২০১৪ সালে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশে সড়ক, মহাসড়ক, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বলে আসছে। ওই নীতির সাথে সাদৃশ্য রেখেই ভারতের মোট মূলধনী খরচ (ক্যাপিটাল এক্সপেনডিচার) এবারের ৩৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে, যা গত বাজেটের অঙ্কের ৩৫.৪ শতাংশ তুলনায় সামান্য কম।

এই বাজেটে মূলধনী খরচের মোট অঙ্ক ধরা হয়েছে ১২ হাজার ২০০ কোটি ডলার, যা ২০১৯ সালের পরিমাণের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পাচ্ছে রেল প্রকল্পগুলো, যার পরিমাণ প্রায় ২৪০০ কোটি ডলার। দেশের কোনো বাজেটে রেল প্রকল্প কখনো এত বরাদ্দ পায়নি।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কানেক্টিভিটি ও আকাশপথে সংযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে অর্থমন্ত্রী ৫০টি নতুন বিমানবন্দর, এরোড্রোম ও হেলিপোর্ট বানানোর কথাও ঘোষণা করেছেন, যার জন্য সরকার অর্থায়ন করবে।

সাধারণ মানুষের ক্ষমতার নাগালের মধ্যে আবাসন দিতে বিভিন্ন আবাস যোজনাতেও খরচের পরিমাণ প্রায় ৬৬ শতাংশ বাড়িয়ে প্রায় ১ হাজার কোটি ডলার করা হয়েছে।

বাজেট ঘাটতিতে রাশ টানা
সরকার বলেছে যে এবার তাদের লক্ষ্য হলো বাজেট ঘাটতি (ফিসক্যাল ডেফিসিট) অন্তত ০.৫ শতাংশ কমানো।

সরকারের মোট আয় ও ব্যয়ের মধ্যে যে পার্থক্য তাকেই বলে বাজেট ঘাটতি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারতে এই ঘাটতি ছিল ৬.৪ শতাংশ, এখন ওটাকেই তারা এ বছরে ৫.৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায়।

মোট খরচের বৃদ্ধিকে সাত শতাংশে বেঁধে রেখে সরকার এই লক্ষ্য পূরণ করতে চাইছে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দেশে সাধারণ নির্বাচনের আগের বছর খরচে এভাবে রাশ টানা যথেষ্ঠ কঠিন।

তবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের মধ্যে বাজেট ঘাটতিকে আরো কমিয়ে ৪.৫ শতাংশ করার যে মধ্য-মেয়াদি লক্ষ্যমাত্রা সরকার আগেই ঘোষণা করেছে, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সিতারামন তার ওই অঙ্গীকার এদিন পুনর্ব্যক্ত করেছেন।

কোভিড মহামারির সময় ভারতের সাধারণ মানুষকে বিনা পয়সায় ভ্যাকসিন ও গরিব মানুষের মুখে বিনা খরচায় খাবার জোগাতে ২০২০-২১ অর্থবছরে ভারতের বাজেট ঘাটতি রেকর্ড ৯.৩ শতাংশে পৌঁছেছিল।

মধ্যবিত্তদের আয়করে রেহাই
চলতি বছরে ভারতের অন্তত নয়টি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন, তারপর সামনের বছরেই দেশের সাধারণ নির্বাচন। এর ঠিক আগে বুধবার ভারতের বিপুল সংখ্যক মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য সরকার আয়করে বিরাট ছাড়ের কথা ঘোষণা করেছে।

ব্যক্তিগত আয়কর গণনার জন্য যে নতুন পদ্ধতি ২০২০ সালে চালু করা হয়েছিল, ওই পদ্ধতি গ্রহণ করেছে এমন নাগরিকদের জন্য করযোগ্য আয়ের ঊর্ধ্বসীমা অনেকটা বাড়ানো হয়েছে।

যেসব ভারতীয়রা বছরে সাত লাখ রুপি (প্রায় ৮৫০০ ডলার) পর্যন্ত আয় করবে, নতুন পদ্ধতিতে গেলে তাদের আর কোনো আয়কর দিতে হবে না। ভারতে ব্যক্তিগত আয়করের ওপর যে সর্বোচ্চ হার, তা ৪২ শতাংশ থেকে কার্যত ৩৯ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। ফলে দেশের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত, সবাই আগামী বছর থেকে কম আয়কর দেবেন।

বাজারে পণ্যের বিক্রিবাটা (কনজাম্পশন) বাড়ানোর জন্যই এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, কারণ আয়করে সাশ্রয় হলে ক্রেতাদের হাতে খরচ করার মতো বাড়তি অর্থ আসবে।

অব্যাহত মুদ্রাস্ফীতির কারণে ভারতের সাধারণ মানুষের হাতে খরচ করার মতো অর্থ (ডিজপোজেবল ইনকাম) কমে আসছিল।

অর্থমন্ত্রী আরো জানিয়েছেন, আয়কর গণনার নতুন পদ্ধতিই (যাতে নিজস্ব বিনিয়োগের ওপর করদাতারা বাড়তি কোনো ছাড় দাবি করতে পারেন না) এখন থেকে ’ডিফল্ট’ পদ্ধতি হিসেবে গণ্য হবে। তবে মানুষ চাইলে পুরনো পদ্ধতিতেও ফিরে যেতে পারবে।

জনকল্যাণ ও ভর্তুকিতে ছাঁটাই
বাজেটে মধ্যবিত্তদের রেহাই মিললেও দেশের সবচেয়ে দরিদ্র ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শ্রেণির জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে তেমন বড়সড় কোনো পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করা হয়নি।

ভারতের গ্রামীণ কর্মসংস্থান বা একশো দিনের কাজের প্রকল্প, যেটাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বাফার বলে বিবেচনা করা হয়, সেখানে বরং ৩০ শতাংশ বরাদ্দ ছাঁটাই করা হয়েছে।

ভারতে যখন বেকারত্বের হার খুব চড়া এবং কর্মীদের বেতন ও মজুরি মেটাতে বহু মালিকপক্ষ দেরি করছে, তাতে এই সিদ্ধান্ত সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলতে পারে। কোভিড মহামারির সময় গরিব মানুষকে প্রায় বিনা পয়সায় চাল-গম খাওয়াতে সরকার যে বিশেষ প্রকল্প শুরু করেছিল, তাও ইতোমধ্যে বন্ধ করার কথা ঘোষণা করা হয়েছে।

এর ফলে খাদ্য ভর্তুকিতে গত বছরের সংশোধিত হিসাবের তুলনায় সরকারের প্রায় ৩০ শতাংশ অর্থ সাশ্রয় হবে।

এছাড়া দেশের কৃষকদের জন্য সারে যে ভর্তুকি দেয়া হয়ে থাকে, সেই বরাদ্দেও ২০ শতাংশের বেশি ছাঁটাই করার কথা জানানো হয়েছে।

সূত্র : বিবিসি