Naya Diganta

ইউরোসেন্ট্রিক ইসলাম-পাঠ ও হীনম্মন্য মনের দুর্গতি

ইউরোসেন্ট্রিক ইসলাম-পাঠ ও হীনম্মন্য মনের দুর্গতি।

তিনি বেঞ্জামিন ওয়াকারের (১৯১৩-২০১৩) কুসংস্কার ভরা বই ফাউন্ডেশন অব ইসলামের উদ্ধৃতি দিয়ে দাবি করলেন, মহানবী সা: তাঁর বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে আরবকে বশীভূত করেছেন। নিজেকে ক্ষমতার কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠা করতে কৌশলী পদক্ষেপ নিয়েছেন। সে জন্য মক্কায় অবলম্বন করেছেন ধর্মপ্রচারকের ভূমিকা। মদিনায় গ্রহণ করেছেন রাজনৈতিক নেতার ভূমিকা। সেখানে তিনি তার আসল লক্ষ্য উন্মোচন করেন। মূলত রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল তার লক্ষ্য। তখনকার আরবের সমাজবাস্তবতায় ধর্মের আবেগ ও অনুভূতি কাজে লাগিয়ে যা নিশ্চিত করতে সক্ষম হন তিনি।

এই যে বয়ান, তাতে মোটেও সত্যতা নেই। তাকে জানালাম, বেঞ্জামিন ওয়াকারের মতো বর্ণবাদী ও পারভারটেড ভাষ্যগুলো কখনো ইসলাম সম্পর্কে সত্য উচ্চারণ করে না। ওয়াকারের প্রতিটি বাক্য থেকে ঝরে পড়ে ইসলামের প্রতি ঘৃণা ও অন্ধ আক্রোশ। এ ভাষ্য কখনোই জ্ঞানের পরিমণ্ডলে স্বীকৃত হতে পারে না। তিনি বললেন, ওয়াকারের অনুক‚লে ঐতিহাসিক প্রামাণ্যতা রয়েছে। আর্নল্ড টয়েনবি একই কথা বলেছেন। তিনি ঠিকই বলেছেন। ব্যক্তিগত ক্রোধ ও উত্তেজনা মিশিয়ে টয়েনবির প্রতিধ্বনি করেছেন ওয়াকার। তাকে নিয়ে বলার আদৌ মানে নেই বটে, তবে ব্রিটিশ ঐতিহাসিক, কবি, ইতিহাস দার্শনিক আর্নল্ড টয়েনবির (১৮৮৯-১৯৭৫) ভাষ্য নিয়ে কিছু বলা দরকার। কারণ দুনিয়ার ইতিহাসবয়ানে টয়েনবির একটা মূল্য রয়েছে। তার সাথে আলাপ হয়েছিল টয়েনবির ভাষ্য ও এর ঐতিহাসিকতা নিয়ে।

টয়েনবি তার বিখ্যাত A Study of History গ্রন্থে ঐতিহাসিক পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। ১২ খণ্ডের বিখ্যাত এই কাজে সমগ্র মানবেতিহাসকে অরৈখিক নজরে দেখা ও দেখানোর চেষ্টা করেছেন। সভ্যতার উৎপত্তি, উত্থান-পতন, সভ্যতা ও সম্প্রদায়গুলো, তাদের বিভিন্ন পরিবেশ, প্রতিবেশ, জলবায়ু, কৌম-জীবন ইত্যাদি বিশ্লেষণ করেছেন। বইটি রচিত হয়েছে ত্রিশ বছর ধরে। ১৯৩১ থেকে ১৯৬১ সাল অবধি টয়েনবি এটি রচনা করেন। প্রকাশের পর দুনিয়ার জ্ঞানমার্গে বইটি মনোযোগের সাথে পঠিত হয়। বিশ্লেষণ ও সমালোচনাও কম হয়নি। টয়েনবি যখন ঐতিহাসিক বিবরণের রেকর্ড পেশ করেন, তখন তিনি শক্তিশালী। অনেকটা বিশ্বস্ততার সাথেই কাজটি করেন। কিন্তু যখন তিনি নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেছেন, তখন প্রাধান্য পেয়েছে তার ব্যক্তিগত কুসংস্কার।

কোনো কোনো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের প্রতি তিনি প্রায়ই ব্যক্তিগত শত্রুতার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। ফলে ইতিহাসবিদদের দ্বারা কঠোরভাবে সমালোচিত হন টয়েনবি। ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে কেন্দ্রে রেখে তিনি সাধারণীকরণ করেছেন বিস্তর। ফলে তার অবস্থান একজন ঐতিহাসিকের জায়গায় থাকেনি, বরং একজন খ্রিষ্টান নীতিবাদীর ভূমিকা গ্রহণ করে। টয়েনবির এ সমালোচনা The Encyclopedia Britwnica তেও উচ্চারিত (Vol. Il, page 880, Chicago, Encyclopedia Brittanica Inc. 1988)। তেমনি তিনি অভিযুক্ত হয়েছেন স্বেচ্ছাচারী অনুমান ও বাস্তবিক ত্রুটির জন্য। যা মূলত খ্রিষ্টধর্মের ওপর নির্ভরশীল দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর থেকে জন্ম নিয়েছে।The Encyclopedia Americana-এর মতো বিশ্বকোষ টয়েনবির এ প্রবণতাকে স্পষ্ট করেছে। (Vol. 26, page 889 (Danbury Connecticut, Grolier Inc. 1988)|

ইসলাম ও হজরত মুহাম্মদ সা: প্রশ্নে তার মন্তব্য ও সমালোচনা শত্রæতাপূর্ণ, যাতে আছে বিদ্বেষের কাতরানি ও শত্রুতার আবেগ। একজন স্বীকৃত ও বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিকের উচিত ছিল নিজস্ব মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে সত্যের সব দিক নজরে রাখা। কিন্তু টয়েনবি ইসলামকে দেখিয়েছেন খণ্ডিত চিত্রপটে, যা উদ্দেশ্যমূলক বার্তা দেয়, প্রকৃত ঘটনা প্রতিফলিত করে না। এ ক্ষেত্রে তিনি ভর করেন নেতিবাদী প্রাচ্যবিদ ডি এস মার্গোলিয়থের (১৮৫৮-১৯৪০) মোহামেডানিজমের ওপর। ব্রিটিশ পণ্ডিত মারগোলিয়থ এক দিকে ছিলেন ইংল্যান্ডের চার্চের পুরোহিত, অন্য দিকে ইসলাম গবেষণায় নিয়োজিত একজন। ১৮৮৯ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষার লাউডিয়ান অধ্যাপক ছিলেন তিনি। তার Mohammedanism প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে।

এ গ্রন্থে যেসব কুসংস্কার ভাষা লাভ করেছে, টয়েনবি প্রায়ই তাকে স্থানান্তরিত করেছেন নিজের গ্রন্থে। আবার অনেক জায়গায় ছাড়িয়ে গেছেন স্বয়ং মারগোলিয়থকেও! এর মধ্যে প্রধান প্রসঙ্গটি হলো মক্কায় মহানবী সা: ছিলেন নবীর ভূমিকায়, মদিনায় সিজারের ভূমিকায়। মহানবী সা:-এর পবিত্র ও মহান মিশনকে তিনি নেতৃত্ব অভিলাষের একটি কৌশলী ধারাবাহিকতা হিসেবে বিবৃত করেন। এটি অবশ্য তার আগেও অনেকেই প্রচারের চেষ্টা করে সত্যের কাছে তিরস্কৃৃত হয়েছেন। যেমন (ক) হজরত মুহাম্মদ সা: তাঁর মিশনের তেরোতম বছরে যখন মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় অবস্থান নিলেন, তখন ধর্মীয় জীবন ত্যাগ করে রাজনৈতিক হয়ে উঠলেন। নবীর ভূমিকার বদলে রাজনৈতিক নেতার ভূমিকা গ্রহণ করলেন। (এ স্টাডি অফ হিস্ট্রি, অধ্যায় ৩, পৃষ্ঠা ৪৬৯)

(খ) ক্ষমতার নিপীড়নের শিকার হয়ে তিনি রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে আকাক্সক্ষা করবেন না, এটাই হওয়ার ছিল। কিন্তু নিজের বার্তা অপমান করে নিজেই হয়ে উঠলেন এক সিজার। (প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭০ ) (গ) রাজনৈতিক লক্ষ্যপূরণের জন্য মক্কার ওপর একটি হামলা চাপিয়ে দেয়ার জন্য ধর্মকে তিনি হাতিয়ার বানিয়েছেন। (প্রাগুক্ত- পৃ. ৪৭১)
কিন্তু মহানবী সা: মদিনায় আগমন করে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন আর নবুওতের পরিবর্তে ক্ষমতাই হয়ে উঠেছিল তার মূল বিষয়, এমন মিথ্যা কবুল করতে পারেনি স্বয়ং পশ্চিমা একাডেমিয়া। যে মারগোলিয়থকে অনুসরণ করেছেন টয়েনবি, তিনিও টয়েনবির সুরে সুর মেলাতে পারেননি। যদিও মোহামেডানিজম গ্রন্থে তিনি নবীজীর বিরুদ্ধে, অভিযোগের নথি তৈরি করেছেন, তবুও তিনি এটা মানতে প্রস্তুতি ছিলেন না যে, মদিনায় আগমনের পর মহানবী সা: আর ধর্মপ্রচারক এবং নবী ছিলেন না। মার্গোলিউথ লিখেছেন : “কিন্তু সাধারণ, আইনপ্রণেতা, বিচারক ও কূটনীতিকের সব দায়িত্বের মধ্যেও নবী প্রচারক ও শিক্ষকের দায়িত্ব অবহেলা করেননি।”
টয়েনবি ও তার পূর্ববর্তী-পরবর্তীরা যে প্রোপাগান্ডা চালান, তা প্রত্যাখ্যান করেন প্রাচ্যবিদদের কর্তৃপক্ষীয় ব্যক্তিত্ব টমাস আর্নল্ড। টয়েনবির সমসাময়িক ছিলেন আর্নল্ড। তার জন্ম লন্ডনে, ১৮৬৪ সালের ১৯ এপ্রিল। পড়ালেখা শুরু করেন সিটি অব লন্ডন স্কুলে। তার পর উপমহাদেশে নানা প্রতিষ্ঠানে পড়েন ও পড়ান। শিক্ষকতা করেন ভারতের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৮৯৩) এবং লাহোর সরকারি কলেজে (১৮৯৮)। শিবলী নোমানী ছিলেন তার বন্ধু, আল্লামা ইকবাল ছিলেন তার বন্ধু ও শিষ্য। পাশ্চাত্য দর্শনের প্রতি ইকবালকে আকৃষ্ট করেছিলেন আর্নল্ডই। ১৯৩০ সালের ৯ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। দ্য প্রিচিং অব ইসলাম (১৮৯৬) বইটি তিনি লেখেন মূলত খ্রিষ্টান মিশনারিদের জন্য ‘ট্রেনিং মডিউল’ হিসেবে। গ্রন্থটি লিখিত হওয়ার পর এ অবধি মিশনারিদের পাঠ্যভুক্ত হয়ে আছে। এতে টমাস লিখেন : “ইউরোপীয় লেখকরা প্রায়ই প্রচার করছেন যে, মদিনায় হিজরতের পরে মুহাম্মদ নবী চরিত্রের বিপরীত ভূমিকায় চলে যান। তিনি তখন আর ঈশ্বরের প্রেরিত পুরুষ ও প্রচারকের কাজ করছিলেন না। বরং অসাধু গোঁড়া চরিত্রে আবির্ভূত হন। যিনি তার ক্ষমতার প্রতিষ্ঠার জন্য সব কৌশলকে কাজে লাগান আর নিজের মত ও নিজেকে প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যবহার করেন রাষ্ট্রযন্ত্র।

“কিন্তু ব্যাপারটি তা নয়। মদিনায় মুহাম্মদ তার ইসলামের প্রচারক ও ধর্মপ্রচারকের ভূমিকাকে এক পাশে রেখেছেন কিংবা নিজের এক সেনাবাহিনী হয়ে যাওয়ার পরে অবিশ্বাসীদের ধর্মের দাওয়াত দেননি, এ অনুমানের ভিত্তি নেই। ইবনে সাদ হাজির করেছেন নবীর তরফে লেখা অনেকগুলো চিঠি। যাতে মদিনা থেকে আরবের সীমানার বাইরে বসবাসকারী ক্ষমতাবানদের সম্বোধন করে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে এবং আরবের বিভিন্ন গোত্রের প্রধানদের এবং অন্যান্য সদস্যদের প্রতি জানানো হয়েছে ইসলাম গ্রহণের আমন্ত্রণ। ইবনে সাদ এর পরে উল্লেখ করেন বিভিন্ন উপজাতির কাছে প্রেরিত ধর্মপ্রচারকদের বৃত্তান্ত ”... ((The Preaching of Islam, পৃ. ২৮)

ইংরেজ লেখক রেজিনাল্ড বসওয়ার্থ স্মিথ (১৮৩৯-১৯০৪) এর ভাষ্যে পাওয়া যায় এমনতরো প্রোপাগান্ডার জোরালো বিরোধিতা। মুহাম্মদ অ্যান্ড মোহামেডানিজম (নিউ ইয়র্ক, ১৮৭৫) গ্রন্থে স্মিথ লিখেন: ‘মুহাম্মদ একসাথে ছিলেন সিজার- রাষ্ট্রনায়ক এবং ধর্মগুরু; পোপ। কিন্তু তিনি পোপ ছিলেন পোপের ভান করা ছাড়াই আর সিজার ছিলেন কোনো সেনাবাহিনী ছাড়াই। স্থায়ী সেনাবাহিনী ছাড়া, একজন দেহরক্ষী ছাড়া, একটি রাজপ্রাসাদ ছাড়া, নির্দিষ্ট রাজস্ব ছাড়া যদি কোনো মানুষের এটা বলার অধিকার থাকে যে দৈবশক্তিতে তিনি শাসন করেছিলেন, তাহলে এটা ছিলেন মুহাম্মদ সা:। কারণ তাঁর সব শক্তি ছিল শক্তির হাতিয়ার এবং এর সমর্থন ছাড়াই।

তিনি শক্তির প্রলেপের কোনো পরোয়া করেননি। তাঁর ব্যক্তিজীবনের সরলতা নিহিত ছিল তাঁর জনজীবনের সঙ্গে থাকার মধ্যেই।

‘সর্বোপরি কত বিস্ময়কর বিষয়! বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মুহাম্মদ নিজের মধ্যে থেকেও নিজ থেকে স্বতন্ত্র। মরুভূমির মেষপালক, সিরিয়ার বণিক, হেরা পর্বতে নির্জন ধ্যানী, সংখ্যালঘুর সংস্কারক, মদিনায় নির্বাসিত, স্বীকৃত বিজেতা, ফরাসি কাইজার এবং গ্রিক হিরাক্লিয়াসের সমকক্ষ, এতসব বৈচিত্র্যের মধ্যে আমরা এখনো বাস্তবিক ঐক্য সন্ধান করতে পারি। আমার সন্দেহ হয়, তিনি ব্যতীত আর অন্য কোনো ব্যক্তি এমন আছে কিনা যার বাহ্যিক অবস্থা এত পরিবর্তনশীল আর এত বিচিত্র। কিন্তু মানুষ ও সমাজের সম্মুখীন হওয়ার সময় তিনি নিজেকে কখনো বদলাননি।’
মেজর আর্থার গিন লিওনার্ড (১৮৬৫-১৯৩২) বলেছিলেন যে, ‘ভূপৃষ্ঠে যদি কেউ আল্লাহ্কে পেয়ে থাকেন; যদি কেউ বিশুদ্ধ ও পবিত্র আগ্রহসহকারে, কোনো সন্দেহ পোষণ না করে এবং নিশ্চিতরূপে নিজের জীবন উৎসর্গ করে থাকেন, তাহলে তিনি ছিলেন একমাত্র একজন; আরবের পবিত্র নবী।’

এটা ছিল মুহাম্মদের ঔৎকর্ষ, এ ছিল সেই জীবনীশক্তি, যাকে তিনি ইসলামের আত্মার মাধ্যমে আরবে বিস্তার দিয়েছিলেন, সেই জীবনীশক্তি জনতাকে সমুন্নত করেছিল। সেটাই তাদেরকে উত্থান দিয়েছিল তন্দ্রা এবং উপজাতীয় গোত্রহীনতার নিম্নস্তর থেকে, জাতীয় ঐক্য ও সাম্রাজ্যের উচ্চ শিখরে। এটা নিহিত ছিল মুহাম্মাদের ঈশ্বরবাদ, বিনয়, মিতাচারিতা ও বিশুদ্ধতার উৎকর্ষের মধ্যে। এই উৎকর্ষ ইসলামের প্রতিষ্ঠাতার আনুগত্যকে তাঁর নিজস্ব নীতির ওপর মুদ্রিত করেছিল, সত্য প্রত্যাদেশের সব চুম্বক-আকর্ষণের মধ্য দিয়ে এই উৎকর্ষ ও নীতি কাজ করছিল মহানবীর অনুসারীদের নৈতিক সত্তার সব শিরা-উপশিরায় এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের প্রতিটি তন্ত্রিতে। ((Islam, its Moral and Spiritual Values, পৃ.-৯।)

স্মিথ বা লিউনার্দ ছিলেন টয়েনবির সমসাময়িক প্রাচ্যবিদ। তাঁদের ভাষ্য সুস্পষ্ট। মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্রগঠনের মর্মমূলে ছিল ঐশী পবিত্রতা, রাজনৈতিক চালাকি নয়। ঐশী প্রাণশক্তি ও পবিত্রতাই মুসলিমদের জাতি গঠন নিশ্চিত করেছিল। সেখান থেকে প্রাণশক্তি ও পথনির্দেশ লাভ করেছিল মহানবীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক জীবন-কর্মসূচি। জীবনের এসব অঙ্গনে তাঁর সব ভূমিকাই ছিল নবীর ভূমিকা, আল্লাহর প্রেরিত বার্তাবাহকের ভূমিকা। ইতিহাসের প্রতি ন্যূনতম বিশ্বস্ত থাকতে চাইলে একে অস্বীকারের উপায় থাকে না।
ফরাসি ঐতিহাসিক ও রাজনীতিক এ ডে ল্যামার্টিন (১৭৯০-১৮৬৯) স্পষ্ট লেখেন : ‘উদ্দেশ্যের মহিমা, উপায়ের সামান্যতা আর ফলাফলের অসামান্যতা যদি মানব প্রতিভার তিনটি মাপকাঠি হয়, তাহলে আধুনিক ইতিহাসের কোনো মহান ব্যক্তিকে মুহাম্মদের সাথে তুলনা করার সাহস কার আছে? সর্বাধিক বিখ্যাত ব্যক্তিরা অস্ত্র ও সাম্রাজ্য তৈরি করেছিলেন। তারা যা প্রতিষ্ঠা করেছিল, তা বস্তুগত শক্তির চেয়ে বেশি নয়। সেটি যা প্রতিষ্ঠা করেছিল, তা প্রায়ই তাদের চোখের সামনে ভেঙে পড়েছে। এ মানুষটি প্রতিষ্ঠা করেছেন সেনাবাহিনী, আইন, সাম্রাজ্য, বিশেষ জনসমাজ এবং রাজবংশ। কিন্তু কেবল এতটুকুই নয়, বরং তিনি বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশে বসবাসকারী লাখ লাখ মানুষকে একত্রিত করেছেন। তার চেয়েও বেশি যা করেছেন, সেটা হলো বেদী, দেবতা থেকে উদ্ধার করেছেন ধর্মকে, বিশ্বাসকে ও আত্মাকে। তিনি তা করেছেন একটি গ্রন্থের ভিত্তিতে, যার প্রতিটি অক্ষর আইন হয়ে গেছে। তিনি প্রতিটি ভাষা ও প্রতিটি জাতির মধ্যে তৈরি করেছেন এক আধ্যাত্মিক ভ্রাতৃত্ব, জাতীয়তা, পরিবার। (Historie de la Turque, খণ্ড. ২, পৃ. ৭৬-৭৭)

আমরা এ আলোচনা শেষ করতে চাই জন হপকিন্স ডেনিসন (১৮৭০-১৯৩৬) এর উপসংহার ধার করে। হপকিন্স দেখাচ্ছেন, মহানবী সা:-এর রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলো ব্যক্তিগত অভিলাষের দ্বারা পরিচালিত ছিল না। বরং এ ছিল মানবজাতিকে উদ্ধারের অবিকল্প প্রয়াস। তিনি লেখেন:

পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে, সভ্য পৃথিবী বিশৃঙ্খলার গহ্বরে পতিত হলো। পুরনো আবেগপ্রবণ যে সংস্কৃতি সভ্যতাকে সম্ভব করে তুলেছিল, তা ভেঙে গেল।... তাদের জায়গা নেয়ার জন্য পর্যাপ্ত কিছুই কোথাও ছিল না। তখন মনে হয়েছিল, যে মহান সভ্যতাটি গড়ে উঠতে চার হাজার বছর লেগেছিল, তা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এবং মানবজাতি বর্বরতার সেই আদিম অন্ধকারে ফিরে যাবার উপক্রম হয়েছিল, যেখানে প্রতিটি গোত্র ও সম্প্রদায় পরস্পরের বিরুদ্ধে মত্ত ছিল এবং আইনশৃঙ্খলা ছিল তাদের অজানা। খ্রিষ্টধর্মের তৈরি নতুন নিষেধাজ্ঞাগুলো ঐক্য ও শৃঙ্খলার পরিবর্তে বিভাজন ও ধ্বংসের সৃষ্টি করছিল। ... একটি বিশাল বৃক্ষের মতো সভ্যতা, যার পাতা-পল্লব সারা বিশ্বে পৌঁছেছিল বটে। কিন্তু তার মূল পচে গেছে একেবারে। এ পরিস্থিতিতে মানবজাতিকে একত্রিত করার জন্য এবং সভ্যতাকে বাঁচানোর জন্য কি কোনো আবেগপূর্ণ সংস্কৃতির আগমন হতে পারে? হ্যাঁ, তা হলো। আরবদের মধ্যে এমন একজন মানুষ জন্মগ্রহণ করেছিলেন যিনি পূর্ব ও দক্ষিণের সব পরিচিত বিশ্বকে একত্রিত করতে চেয়েছিলেন।’ ((Emotions as the Basis of Civilization, পৃ. ২৬৫)

টয়েনবির তত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করেছে পশ্চিমা বিশ্লেষণের ন্যায়ানুগ চেষ্টাগুলো। ক্যারেন আর্মস্ট্রং তার Muhammad–A Biography of the Prophet এ (পৃ. ৫৩-৫৪) প্রিংলে কেনেডি তার Arabian Society at the Time of Muhammad এ ( পৃ. ৮-১০, ১৮-২১) এস পি স্কট তার History of the Moorish Empire in Europe এ ( পৃ. ১২৬) মন্টোগোমারি ওয়াট তার Muhammad at Madinah এ (পৃ.৩৩৫) আপন আপন ভাষ্যে দেখিয়েছেন, মহানবী সা: মদিনায় এসে বদলে যাননি। তিনি বরং সেই তিনি ছিলেন, যিনি হেরা পর্বতের ধ্যানী, মক্কার পথে-প্রান্তরে নিবেদিত প্রচারক। মদিনায় রাষ্ট্রপ্রধান তিনি আর তায়েফের রক্তাক্ত প্রার্থনারত মহাপুরুষ এক ও অভিন্ন। সেই অভিন্নতার স্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে মক্কা বিজয়েও! যে বিজয়ের প্রতিটি ধাপে আছে নমুনাহীন মহত্ব। কুরাইশদের অবর্ণনীয় আগ্রাসন সত্ত্বে ও মক্কাবাসী তাঁর দয়া লাভ করেছে। আর মক্কা বিজয় ছিল কুরাইশদের চুক্তি লঙ্ঘনের অবধারিত ফলাফল। প্রাণহানি ও রক্তপাত এড়িয়ে সম্পন্ন সেই বিজয় অনুকম্পা ও উদারতার ইতিহাসকে চিরকালের জন্য দিয়েছে অসামান্য উচ্চতা।

যে ভদ্রলোক টয়েনবির ভাষ্যকে সত্যের ভাষা ধরে নিয়েছিলেন, তিনি সত্য সন্ধানের দায়িত্বের প্রতি উদাসীন যতটুকু, তার চেয়ে বেশি হীনম্মন্যতার অধীন। জ্ঞান ও চিন্তার দিক থেকে পশ্চিম থেকে পাওয়া প্রতিটি বিষয়কে শেষ কথা হিসেবে বিবেচনা করার রোগে অনেকেই আক্রান্ত। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো ইসলাম সম্পর্কেও তারা জানতে চান পশ্চিমা বয়ানের মাধ্যমে। সেই জানাটাও সীমিত থাকে দু-চারটি একরৈখিক ভাষ্যের সীমানায়। ফলে তারা না অর্জন করতে পারেন জ্ঞানীয় প্রশান্তি, না পেতে পারেন সত্যের কোনো দিশা। বরং মনের ভেতর সত্যহত্যার রক্তক্ষরণে নিজের বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে করুণ দুর্দশায় ঠেলে দেন নিজস্ব অসুখে!

লেখক : কবি, গবেষক
71.alhafij@gmail.com