Naya Diganta

ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সুশাসন ও অর্থনৈতিক সঙ্কট উত্তরণ


দেশে আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত লোকজন চাইলেই যেমন বেশির ভাগ অপরাধ দূর করতে পারে তেমন ব্যাংকিং সেক্টরে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের প্রায় সব বড় বড় দুর্নীতির ঘটনা রোধ করতে পারে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলো।... বড় দুর্নীতি রোধ করলে ছোটগুলো এমনিতেই বন্ধ হবে

ব্যাংকিং খাতের সুশাসন হলো সরকারি প্রতিষ্ঠান ও দেশের জনগণের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে দেশের সম্পদ পরিচালনার সুব্যবস্থা করা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, স্বচ্ছতা হলো এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি, যেখানে মুদ্রা ও আর্থিক নীতি-সম্পর্কিত সব তথ্য সময় সময় জনগণকে বোধগম্য উপায়ে জানানো হয়। দেশের ব্যাংক খাতে সঙ্কটের বর্তমান প্রেক্ষাপটে, বিশেষ করে ব্যাংকিং কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য, সরকারি এবং বেসরকারি দায়িত্বকে পুনর্জীবিত করার জন্য সুশাসন শব্দটি এখন গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। ব্যাংকিং খাতের সুশাসনের গুরুত্ব কতখানি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো- যুক্তরাষ্ট্রের সাব-প্রাইম মর্টগেজ মার্কেটে আগ্রাসী ঋণচর্চার কারণে সৃষ্ট আবাসন খাতে বুদ্বুদ এবং আর্থিক খাতের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা, যা ২০০৭ সালের বৈশ্বিক আর্থিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টির মূল কারণ ছিল। ওই আর্থিক সঙ্কট ছোঁয়াচে রোগের মতো মার্কিন অর্থনীতির সার্বিক আবাসন খাতে দ্রুত বিস্তার লাভ করে এবং বিশ্বের আর্থিক ও উৎপাদনশীল উভয় খাতেই ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এভাবে ওই সঙ্কট বৈশ্বিক রূপ নেয় এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিভিন্ন দেশ নানা ব্যবস্থা নেয়ার পরও বিশ্ব অর্থনীতির পুরোপুরি পুনরুদ্ধার এখনো সম্পন্ন হয়নি মূলত সুশাসনের অভাবে।


বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থা
বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার সুশাসন নিয়ে আলোচনা করতে হলে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর ধারণা থাকা প্রয়োজন। ‘বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ-১৯৭২’ পাস হওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে এটি কার্যকর করে। পাশাপাশি দু’টি দেশী ও ১০টি পাকিস্তানি ব্যাংককে জাতীয়করণ করে মোট ছয়টি রাষ্ট্রীয় ব্যাংক নিয়ে স্বাধীন দেশে ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর প্রধানত চার ধাপে নতুন নতুন বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হয়ে বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি, বাণিজ্যিক, বিশেষায়িত মিলে মোট ৬২টি ব্যাংক কার্যরত রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক যাত্রা শুরু করে এবং বর্তমানে দেশে ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংক এবং অনেকগুলো প্রচলিত ব্যাংকের ইসলামী ধারার শাখা ও উইন্ডো রয়েছে।
বাংলাদেশে প্রথম প্রজন্ম, দ্বিতীয় প্রজন্ম এমনকি তৃতীয় প্রজন্মের ব্যাংক প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত দেশের আর্থিক খাতে যথেষ্ট সুশাসন ছিল। তখন পর্যন্ত আর্থিক খাতে সুশাসন শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন আর্থিক খাতে সংস্কারনীতি গ্রহণ করে। সংস্কারের আওতায় আর্থিক খাতের আইনি কাঠামো শক্তিশালী করা, গতিশীলতা আনা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন প্রসারিত করা এবং মানিলন্ডারিং অপরাধ প্রতিরোধ করার প্রয়াস চালানো হয়। এখন ব্যাংক খাতের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো- একটি ভালো করপোরেট শাসন নিশ্চিত করা যেন আমানতকারী, গ্রহীতা ও বিনিয়োগকারীরা লাভবান হয়। যাতে বাজার প্রসারিত হয়; মালিকানা বিস্তৃত হয়; বিকল্প অর্থায়নের সুযোগ তৈরি হয়; প্রবৃদ্ধি দ্রুত গতি লাভ করে; কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায় আর তা দেশের দরিদ্র কমাতে সাহায্য করে।
বর্তমানে দেশে ব্যাংক ব্যবস্থায় সুশাসনের বেশ অভাব দেখা যায় । বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) গবেষকরা বলেছেন, মাত্র ৪৬ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির একটি দেশে ৬২টি ব্যাংক স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। এমনকি চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলো অনুমোদন দেয়ার সময় সরকারও বলেছিল- এ দেশে আর ব্যাংকের দরকার নেই। তার পরও রাজনৈতিক বিবেচনায় দিতে হচ্ছে। প্রতিযোগিতামূলক সেবা ও সমৃদ্ধির জন্য বেশি সংখ্যক প্রতিষ্ঠান থাকা ভালো তবে তা যদি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয় তাহলে অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি টিকে থাকার জন্য তাদেরকে অনেক অনৈতিক, অপরাধমূলক ও দুর্নীতি প্রবণতার আশ্রয় নিতে হয়। বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে এ ধরনের অভিযোগ ক্রমেই বাড়ছে।


বিআইবিএমের গবেষকরা আরো বলেন, ৭২ শতাংশ ব্যাংক কর্মকর্তা মনে করেন দেশের বর্তমান ব্যাংক সংখ্যা কমাতে হবে। ব্যাংক মার্জারের মাধ্যমে এই খাতে ভারসাম্য ও সুশাসন ফিরিয়ে আনতে হবে। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে এই ধরনের মার্জারের ঘটনা ঘটছে। দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি কার্যকর এক্সিট পলিসিও থাকা দরকার। কোনো ব্যাংক খারাপ করলে তাকে এ নীতির মাধ্যমে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া বা একীভূতকরণের ব্যবস্থা নিতে হবে। কার্যকর গ্লোবালাইজেশনের অংশ হতে হলে মার্জারে যেতেই হবে।
ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব সৃষ্টির সূত্রপাত হয় দেশের দুর্বল নীতির কারণে। নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধন এবং সময়ে সময়ে জারী করা প্রজ্ঞাপন অনেক সময় ঋণখেলাপিদের সহায়ক হয়েছে। এই ধরনের এক বিধানে তিন বছর করে তিন মেয়াদে মোট ৯ বছর একাধারে পরিচালক থাকতে পারার সুবিধা সৃষ্টি করা করা হয়েছে, যা ব্যাংকগুলোতে জনস্বার্থকে বিঘিœত করে পারিবারিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগ তৈরি করেছে। কিছু ব্যাংকে আমানতের চেয়ে ঋণের পরিমাণ বেশি হওয়ায় তারা গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এ পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। এটি না থাকলে কখনো খেলাপি ঋণ হবার প্রবণতা থামানো যাবে না। একটি বেসরকারি ব্যাংকে মাত্র ১০ শতাংশের মালিকানা থাকে পরিচালকদের, বাকি ৯০ শতাংশ টাকা থাকে সাধারণ আমানতকারীদের। অনেক সময় দেখা যায় মাত্র ১০ শতাংশ মালিকানার সুযোগে তারা অনিয়ম-জালিয়াতির এমন কোনো দিক নেই যা করে না। এই ধরনের পরিস্থিতিতে ঋণখেলাপিরা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও ব্যাংকগুলোর অবস্থা হয়ে পড়ে খুবই নাজুক।
ব্যাংক খাতের বর্তমান সুশাসন ও শৃঙ্খলার নমুনা


চলতি দশকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে সংঘটিত অনেক বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় চিড় ধরিয়েছে। পরিচালনা পর্ষদ থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপনা স্তরের নি¤œ পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ কেউ এসব ব্যাংকে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি দেখাতে পারেনি। এসব অনিয়ম বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংক পরিচালনার জন্য সার্বিক নির্দেশনা দেবে, নীতিগত বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে। ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা নীতিমালা বাস্তবায়ন করবেন, এটিই নিয়ম। পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যাংক ব্যবস্থাপনার কার্যপরিধি আইন দিয়ে নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু পরিচালনা পর্ষদকে অনেক সময় ব্যাংক ব্যবস্থাপনার কাজে হস্তক্ষেপ করতে দেখা যায়; নীতিগত সিদ্ধান্ত দেয়ার চেয়ে ব্যাংকের দৈনন্দিন কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করতেই অনেক সময় তাদের বেশি উৎসাহী দেখা যায়। ফলে ব্যবস্থাপকদের পক্ষে স্বাধীনভাবে সৃজনশীলতা কাজে লাগানো সম্ভব হয় না; বরং পরিচালনা পর্ষদের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে তারা বাধ্য হয়। এটি কোনোভাবেই ব্যাংক খাতের সুশাসনের জন্য মঙ্গলজনক হয় না।
সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারার কারণে ব্যাংক খাতে দুর্নীতির নানা ঘটনা ঘটছে, জবাবদিহির ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে পরস্পরকে দোষারোপ করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এর ফলে জবাবদিহিতার বিষয়টি এক সময় গৌণ হয়ে পড়ে। নজরদারি ও তদারকিও হয়ে পড়ে খুব দুর্বল। যারা পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান বা পরিচালক হয়ে আসেন, তাদের নিজস্ব ব্যবসা-বাণিজ্য থাকে। তারা আত্মীয়স্বজনের ব্যবসা-বাণিজ্যে সুবিধা দেয়ার এবং নিজের লোকদের ঋণ বা চাকরি দেয়ার জন্য ব্যাংক ম্যানেজমেন্টকে চাপ দেন; তাদের ওপর প্রভাব খাটান। এই অবস্থার বেশ অবনতি দেখা যাচ্ছে এখন। আগে ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় এমন মাত্রায় ছিল না এটি।
ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নিযুক্তি এমনকি তাদের চাকরি থাকা-না থাকা অনেকটাই নির্ভর করে পরিচালনা পর্ষদের ওপর। কাজেই তারা ইচ্ছা করলেই পরিচালনা পর্ষদের সদস্য বা চেয়ারম্যানের পরামর্শ বা নির্দেশনা উপেক্ষা করতে পারেন না। পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে এমনকি ব্যবস্থাপনার মধ্যেও অনেকেই সরাসরি রাজনীতির সাথে যুক্ত যা বহুলাংশে দক্ষ ও সৎভাবে ব্যাংক পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি করে। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে অনেক সময় যুক্ত হয়ে পড়েন। ব্যবস্থাপনার শীর্ষ পর্যায়ে অদক্ষতা বা দুর্বলতা অনেক সময় প্রবল হয়ে ওঠে। এতে নিচের দিকের কর্মীরাও নানা ধরনের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। টপ ম্যানেজমেন্ট যদি কঠোরভাবে সুশাসন নিশ্চিত না করে, তাহলে তার প্রভাব নিচের দিকে পড়তে থাকে।


ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতার মধ্যে অবশ্যই ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। আর্থিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের প্রধান উদ্দেশ্য হলো আমানতকারী, গ্রাহক ও সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষা করা; এর মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিকে অর্থায়ন ও বিনিয়োগের নানা সেবা দিয়ে সম্মৃদ্ধ করা। এর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলো- আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পদ্ধতিগত ঝুঁঁকি কমানো, যাতে তা অর্থনৈতিক ভিত্তি ভেঙে গিয়ে প্রকৃত উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধি হ্রাস, বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং মানবকল্যাণের ক্ষেত্র সঙ্কুুচিত হবার মতো পরিস্থিতি প্রতিরোধ করে।
সার্বিকভাবে দেশের ব্যাংক খাত দীর্ঘদিন ধরেই নানা সমস্যায় জর্জরিত। প্রথম সমস্যা- সুশাসনের অভাব। দ্বিতীয় সমস্যা- এ খাতের জন্য প্রণীত নীতিমালা ও আইন-কানুন সঠিকভাবে পরিপালন না করা। ব্যাংক খাতের নিয়ম-কানুন আন্তর্জাতিক মানের, কিন্তু সমস্যা হলো এগুলো সঠিকভাবে পরিপালন হচ্ছে না।
সামষ্টিক অর্থনীতিতে টেকসই সুশাসন ও সার্বিক আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারি কার্য পরিচালনায় স্বচ্ছতা বিধানের বিকল্প নেই। অথচ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতির কারণে ব্যাংক খাতে একের পর এক বড় কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটছে। ঋণগ্রহীতা ও কর্মকর্তারা সমঝোতার মাধ্যমে অস্বচ্ছ উপায়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এসব ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে তারল্য সঙ্কটে পড়েছে আলোচিত ব্যাংকগুলো। দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামী ব্যাংকটি এক সময় দেশের অন্যান্য ব্যাংককে ধার দিয়ে বাঁচিয়ে রাখত, অথচ আজ সেই ব্যাংকটিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে।


ব্যাংক খাতে সুশাসন না থাকার চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
দেশের চলমান সময়ের আর্থিক কেলেঙ্কারি ব্যাংক ব্যবস্থাপনা তথা দেশের সার্বিক অর্থনীতিকে বিপদগ্রস্ত করে ফেলেছে। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কঠোর হওয়ার বার্তা দিয়েছেন। এরই মধ্যে ১০টি দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিতপূর্বক সেগুলোতে সংস্কারের ব্যবস্থা ও অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের কথা বলেছেন তিনি। অর্থনীতির মূল ভিত্তি হিসাবে পরিচিত এ খাতে কোনো ধরনের ধসের সৃষ্টি হলে তা পুরো অর্থনীতিকে গ্রাস করে ফেলবে। সুতরাং বাংলাদেশ ব্যাংককে আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কঠোর ব্যবস্থা নিতেই হবে।
উন্নত দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায়ও আর্থিক কেলেঙ্কারি সংঘটিত হয়। তবে তা ধরা পড়ে এবং দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা হয়। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারি উদঘাটিত হলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা সেভাবে নিতে দেখা যায় না। এর ফলে অনিয়ম বেড়ে উঠতে পারছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ যে পর্যায়ে আছে, তা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে কিছু পদক্ষেপ, যেমন- সংজ্ঞা পরিবর্তন এবং ঋণের সুদহার হ্রাসের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু মূল সমস্যাগুলো দূর করার কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। ব্যাংক খাতের প্রতি আস্থা ভালোভাবে ফেরানোর জন্য যে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন এবং খেলাপি ঋণ আদায়ে যে সক্রিয়তা প্রয়োজন, তার ঘাটতি রয়েছে এখনো। এই ঘাটতির কারণে ঋণের ওপর সুদের হার হ্রাস করার যেসব উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে, তা কার্যকর হচ্ছে না।


ঋণখেলাপির কার্যকারণ নির্দিষ্ট করে খেলাপিদের চিহ্নিত করা, কারা বিভিন্ন সুবিধা নিয়েও ঋণখেলাপি থেকে যাওয়াকেই ভালো ‘বিজনেস মডেল’ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন তাদের চিহ্নিত করা, আইনের সংস্কার ও কার্যকর প্রয়োগে এখনো ফলপ্রসু কোনো উদ্যম দেখা যাচ্ছে না। এর বিপরীতে বরং বড় ও ধারাবাহিক ঋণখেলাপিরা বিভিন্ন প্রণোদনা পাচ্ছেন। এর ফলে যারা ভালো ঋণ গ্রাহক, তাদের জন্য এক ধরনের নৈতিক বিপত্তি সৃষ্টি হচ্ছে। এমন প্রবণতা সুষ্ঠু আর্থিক পরিবেশ গড়ে তোলার পেছনে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় যেসব উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলেছেন, তাতে সবাই আশ্বস্ত হবেন। এর আগেও সাবেক গভর্নর ও সাবেক অর্থমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নানা প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তার কোনো কিছুই সেভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। বিভিন্ন গোষ্ঠীর চাপে সংস্কার থেকে সরে এসে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যার ফলে এখন ব্যাংক খাত এক মারাত্মক আস্থা সংকটের মুখে পড়েছে। এখান থেকে অবশ্যই উত্তরণ প্রয়োজন। কারণ দেশের অর্থনীতি ব্যাংক খাতের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। এতে কোনো ধরনের বিপত্তির সৃষ্টি হলে তা পুরো অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে। বাংলাদেশে আইন-কানুন-নিয়মের কোনো কমতি নেই। সঙ্কট শুধু আইনের প্রয়োগ নিয়ে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে কঠোর হতে হবে। কোনো ব্যাংক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটালে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে যথাযথ তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণে কার্পণ্য করা যাবে না।
ব্যাংকিং খাতের সুশাসন আনতে প্রয়োজন স্বচ্ছ ও বলিষ্ঠ ঋণ ব্যবস্থাপনা। ব্যাংকের অন্যতম কাজ হলো দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসার চাকা সচল রাখতে ঋণ দেয়া এবং সময়মতো সে ঋণ আদায় করা। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নিরাপদ, কল্যাণমুখী খাতে বিনিয়োগসহ শক্তিশালী ব্যাংক ব্যবস্থা অপরিহার্য। সুশাসনের অভাব, উচ্চ কর হার, আর্থিক অপরাধ ও চুরি এবং নীতির ধারাবাহিকতা না থাকার কারণে ব্যবসার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আর ব্যাংক খাতকে ইতিবাচক ধারায় রাখা প্রয়োজন।

ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ও গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে এবং নতুন খেলাপি ঋণ সৃষ্টির পথ বন্ধ করতে হবে। ব্যাংক খাতের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারভিশন, গাইডেন্স ও তদারকি বাড়াতে হবে। অর্থঋণ আদালতসহ আইনি প্রক্রিয়াকে আরো কার্যকর ও সংস্কার করতে হবে, যাতে আইনের সাহায্য নিয়ে খেলাপি ঋণ আদায় করা যায় এবং ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়। তা ছাড়া গ্রাহককে যেনতেন প্রকারে ঋণ দিয়ে মুনাফা অর্জনের টার্গেট ব্যাংকগুলোকে পরিহার করতেই হবে। মুনাফা অর্জনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা এই খাতকে বড় ধরনের ক্ষতির মধ্যে ফেলেছে। ব্যাংকগুলোর জন্য ঋণ নীতিমালা পুনর্বিন্যাস করা এবং ঋণ বা বিনিয়োগকে বিভিন্ন খাতে বণ্টন করা এখন সময়ের দাবি।


সুশাসনের উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখা এবং আরোপিত বিধানের প্রতি সম্মতি নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন স্বাধীন এবং শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ব্যাংক। রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক চাপের কারণে ঘন ঘন বিধান পরিবর্তন না করার বিষয়টি এই নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানকে নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়াও সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং ‘সিস্টেম’ এ সঙ্কট তৈরির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থার জন্য সংশোধনমূলক নীতিমালা গ্রহণ ও এর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
আশার কথা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে ও ঋণের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে নির্দেশনা পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই নির্দেশনায় বিতরণ করা ঋণের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা, সরেজমিন পরিদর্শন ও তদারকি কার্যক্রম বৃদ্ধি করে সুশাসন নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এর পাশাপাশি ঋণের ব্যবহার যেন যথাযথ হয় এবং কিস্তিভিত্তিক প্রকল্প ঋণের ক্ষেত্রে আগের কিস্তির সদ্ব্যবহার সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে পরবর্তী কিস্তি ছাড় করার ব্যবস্থা করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ঋণের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা ও তদারকির বিষয়টি প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ ঋণ নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ঋণের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ পরিদর্শন প্রতিবেদন প্রণয়ন ও তা সংশ্লিষ্ট ঋণ নথিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়ারও নির্দেশনা রয়েছে।
পরিশেষে বলতে হয়, দেশে আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত লোকজন চাইলেই যেমন বেশির ভাগ অপরাধ দূর করতে পারে তেমন ব্যাংকিং সেক্টরে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের প্রায় সব বড় বড় দুর্নীতির ঘটনা রোধ করতে পারে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলো। দেশের এমন কোনো বড় দুর্নীতি নেই যার সাথে ব্যাংক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত নয়। আর বড় দুর্নীতি রোধ করলে ছোটগুলো এমনিতেই বন্ধ হবে। এই সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য চাই দেশের নীতিনির্ধারকদের সদিচ্ছা ও আইনের বাস্তবায়ন। এর পরও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে যে সব দুর্নীতিবাজ বেরিয়ে যায় তাদের জন্য বিচার ব্যবস্থা তো রয়েছেই। ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল : mizan12bd@yahoo.com