Naya Diganta

শিক্ষার সঙ্কট

শিক্ষার সঙ্কট।

মৌলিক মানবীয় চারিত্রিক গুণাবলির বিকাশ, জাতিসত্তার চেতনা স্ফুরণ, দেশপ্রেম, নাগরিক দায়বোধ, সমসাময়িক বৈশ্বিক ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পর্কিত ধারণা এবং দেশ, জাতি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে কার্যকরী জনশক্তি তৈরির লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশ ও জাতি প্রণয়ন করে শিক্ষানীতি। পাঠ্যক্রমে ধারাবাহিকভাবে সুবিন্যস্ত এই নীতিমালার আলোকে একজন তরুণ আত্মপ্রত্যয়ী, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, সৃজনশীল ব্যক্তি হিসেবে গড়ে ওঠে। শিক্ষাজীবন শেষে তার সামনে থাকে শুধুই এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। দেশ, জাতি ও বিশ্বপরিসরে নতুন কিছু সৃষ্টির চেতনায় শুরু হয় তাদের পথচলা। স্বকীয় জাতীয় পরিচিতি এবং দেশপ্রেম আলোকিত করে তার চলার পথকে।

পপুলেশন অ্যান্ড হাউজিং সেন্সাশ ২০২২-এর হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে শিক্ষিতের হার ৭৪.৬৬%। শিগগিরই হয়তো আমরা শতভাগ শিক্ষিতের দেশ হিসেবে বিশ্বে বিধৃত হবো। দেশের ৭৪.৬৬ শতাংশ শিক্ষিত জনসংখ্যা নিয়ে আমরা দেশের প্রয়োজনীয় জনশক্তির চাহিদা মেটাতে পারছি না কেন তার মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান উৎস তৈরী পোশাক শিল্পের প্রয়োজনীয় কার্যকরি জনশক্তি কেন জোগান দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, দেশে এখন প্রায় ৫০ লক্ষাধিক শিক্ষিত বেকার থাকা সত্ত্বেও। ৮০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশীর কষ্টার্জিত বার্ষিক ১৬ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্সের পাঁচ বিলিয়ন ডলার চার লাখ বিদেশী নাগরিক নিয়ে যায়; প্রয়োজনীয় জনশক্তি সৃষ্টি না হওয়ায়। এখন সরকারি বেসরকারি স্বায়ত্তশাসিত খাতে প্রচুর পদ শূন্য রয়েছে। যা উপযুক্ত ও কার্যকরী জনশক্তির অভাবে পূরণ করা যাচ্ছে না। আমাদের শিক্ষার কারিকুলাম প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারছে না। এটা আমাদের শিক্ষা কারিকুলামের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। এর একটা কারণ হতে পারে ভবিষ্যৎ চাহিদাভিত্তিক দক্ষ নাগরিক তৈরির চিন্তা প্রাধান্য না পাওয়া। শুধুমাত্র সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত বেকার তৈরি করে সাক্ষরতার হার বাড়ানোর লক্ষ্যে তৈরি শিক্ষানীতিতে সাক্ষরতার হার বাড়বে ঠিকই; কিন্তু তাতে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে টিকে থাকার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন নাগরিক তৈরি করা যায় না। সার্টিফিকেট অর্জনের শিক্ষায় অভিভাবকদের আর্থিক বিনিয়োগ, বুকভরা আশা, জাতীয় প্রত্যাশা যখন কোনো প্রাপ্তির মুখ দেখে না তখন নিরাশা এবং হতাশাই সৃষ্টি হয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অসঙ্গতি ও সঙ্কটের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল। অথচ এই ভর্তি পরীক্ষায় এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সবচেয়ে মেধাবী ও কীর্তিমান শিক্ষার্থীরাই অংশগ্রহণ করে। এই চিত্র বছরের পর বছর চলে আসছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এসব দেখার, ভাবার যেন কেউ নেই।

জাতিসঙ্ঘের উপাত্ত অনুসারে বাংলাদেশের ৪৮ শতাংশ জনগোষ্ঠী ২৪ বছর ও তার চেয়ে কম বয়সের। যেকোনো দেশের জন্য এই জনগোষ্ঠী এক বিরাট সম্পদ। টগবগে তারুণ্যে ভরপুর এই জনগোষ্ঠীকে প্রায়োগিক দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করা গেলে তা শুধু দেশের পরিচিতিকেই পাল্টে দেবে না, সাথে সাথে তা হবে অনেক দেশের জন্য অনুকরণীয়। তথ্য অনুসারে সারা দেশে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ৮৫টিসহ মোট ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ব বিদ্যালয় রয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে স্বীকৃতি নেই অথচ শিক্ষাকার্যক্রম চলছে। শিক্ষার্থীরা পাস করে বের হচ্ছে। পৃথিবীর অন্য কোথাও এটি ভাবাই যায় না। শোনা যায় সমাজের প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এগুলো হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে অসহায়ের ভূমিকায় থাকতে হয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ অনেক ক্ষেত্রেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের চেয়েও খারাপ। শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় আবাসন তো দূরের কথা ব্যবহারযোগ্য মানসম্পন্ন লাইব্রেরি পর্যন্ত নেই। নেই পর্যাপ্ত জার্নাল বা জার্নাল সংযোগ। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ হিসেবে পরিচিত গবেষণা কার্যক্রমের কোনো ব্যবস্থা বা উদ্যোগ নেই। নেই শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ বা বিনোদনের ব্যবস্থা। নিয়মিত উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানে দুই বা তিন ধাপে ভর্তি হয় প্রায় ত্রিশ লাখ শিক্ষার্থী; যা ২০২৬ সাল নাগাদ পঞ্চাশ লাখের কাছাকাছি পৌঁছানোর সম্ভাবনা। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক শিক্ষার্থী ধারণক্ষমতা ১২ লাখ হলেও ১৩ লাখ শিক্ষার্থী বের হচ্ছে শিক্ষাজীবন শেষ করে। ব্যবহারিক এবং প্রায়োগিক শিক্ষা না থাকায় এদের বেশির ভাগ বেকারের খাতায় নাম লেখায়। দেশ ও জাতির প্রয়োজনে এদের শিক্ষা কোনো কাজে আসে না।

বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি বাংলাদেশের জন্য দক্ষ, ব্যবহারিক সৃজনশীল জনশক্তি এবং পরিচালকের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছে। বিশেষ করে শিল্পায়ন পরিকল্পনা এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে এগিয়ে নেয়া, পরিবেশ দূষণের মোকাবেলা, বিশ্বায়ন কর্মসূচির সাথে সমান্তরালভাবে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক দক্ষতাসম্পন্ন জনশক্তির ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানটি সতর্কবার্তা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, স্মার্ট বাংলাদেশ বা সোনার বাংলা গড়তে হলে ও যে এর বিকল্প নেই বলাই বাহুল্য।

পরিস্থিতির আলোকে প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে শক্তিশালী করা। উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ব্যবহারিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নিবিড় তত্ত্বাবধানে এনে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা। প্রয়োজন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য পাঠ্যক্রম তৈরি এবং তা নিয়মিতভাবে মানোন্নয়নের ব্যবস্থা। সাধারণ শিক্ষার সাথে সাথে পেশাগত শিক্ষার সমন্বয় করা। প্রয়োজনীয় এবং যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের কোনো বিকল্প নেই। প্রয়োজন কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া। এ ব্যাপারে নিয়মিত প্রয়োজনীয় তত্ত্বাবধানের জন্য রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করা যেতে পারে। দেশের বরেণ্য ও জ্যেষ্ঠ শিক্ষাবিদরা এর সদস্য হবেন। প্রয়োজন শিক্ষার নামে বছরের পর বছর ধরে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট বন্ধ করা। শিক্ষার্থীদের মেধা ও চেতনার বিকাশ পরিস্ফুটনের ব্যবস্থা করা। শিক্ষাঙ্গনগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা জরুরি। ছাত্রদের হাতে থাকবে বই। তাদের সময় যাপিত হবে লাইব্রেরিতে অথবা গবেষণাকর্মে। তাদের হাতে লাঠি শিক্ষাঙ্গনেরই অসম্মান। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য সমন্বিত শিক্ষাই দিতে পারে জাতীয় সমৃদ্ধির সোপানের সন্ধান। আমাদের মনে রাখা দরকার, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রমিক সরবরাহের জন্য এ দেশের সৃষ্টি হয়নি। বিশ্বসভায় আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন গৌরবের সাথে সৃজনশীল মানবীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জাতি অভিধায় পরিচিত হতে পারে তার ব্যবস্থা আমাদেরই করতে হবে। বাইরে থেকে কেউ এসে তা করে দেবে না। এতদিনের অনুসৃত শিক্ষাপাঠ্যক্রমের খোলনলচে পাল্টে নতুন অবয়বে বিন্যস্ত করা এখন সময়ের দাবি। যা আমাদের জাতীয় চেতনার ধারক হবে, মৌলিক মানবীয় গুণাবলির লালনে সহায়ক হওয়ার সাথে সাথে দেশ ও জাতিকে পরিচালিত করবে সমৃদ্ধির পথে, মানবতার কল্যাণের পথে।

লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email- shah.b.islam@gmail.com