Naya Diganta

বাস মালিক-হাইওয়ে হোটেলগুলোর সিন্ডিকেট


কক্সবাজার থেকে ঢাকায় যাচ্ছেন ফয়সাল রহমান। চাকরির সুবাদে মাসে দুই-তিনবার ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে যাতায়াত করেন। হানিফ বাসে রাত ১১টায় ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। সকাল ৮টায় কুমিল্লা শহরের নিকটবর্তী নুরজাহান হাইওয়ে হোটেলে যাত্রাবিরতি দেয় বাসটি। এ সময় তার সাথে কথা হয়। হোটেলে খেতে বসে খাবারের দাম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ফয়সাল।
ফয়সালের মতো হাজার হাজার যাত্রী প্রতিদিন ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে যাতায়াত করেন। তাদের অধিকাংশই যাত্রাবিরতিতে কুমিল্লার হাইওয়ে হোটেলগুলোতে খাবার খান। অনেকে বাধ্য হয়ে বেশি দাম দিয়ে খান, কেউ কেউ হালকা নাশতা করেই চালিয়ে নেন। তবে কুমিল্লার হাইওয়ে হোটেলগুলোতে খাবার ও নাশতার দাম শহরের যেকোনো রেস্তোরাঁর চেয়ে বেশি। হাইওয়ে হোটেলগুলোর নাশতা খরচ দিয়ে জেলা শহরের যেকোনো রেস্তোরাঁয় পেট পুরে খাওয়া যায়। বাংলা ট্রিবিউন।


ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে যাতায়াতের সময় যাত্রাবিরতিতে হোটেলে খাবার খাওয়া ১০ বাসযাত্রীর সাথে কথা হয় এই প্রতিনিধির। তাদের প্রত্যেকের অভিযোগ, জেলা শহরের যেকোনো হোটেলের তুলনায় হাইওয়ে হোটেলগুলোতে খাবারের দাম দ্বিগুণ। কোনো কোনো খাবারের দাম তিন গুণ বেশি। বছরের পর বছর যাত্রীদের পকেট কাটছেন হাইওয়ে হোটেলগুলোর মালিকরা। এর কোনো প্রতিকার নেই।


বাস মালিকদের সাথে হোটেলের চুক্তি : চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার একটি হোটেলের কর্মচারী মোবারক হোসেন খান। তিনি বলেন, ?‘হাইওয়ে হোটেলগুলোতে আমার আসা-যাওয়া নিয়মিত। চাঁদপুরের বাড়িতে যেতে কুমিল্লা হয়েই যেতে হয়। হাইওয়ে হোটেলগুলোতেই বাসগুলো যাত্রাবিরতি দেয়। খাবারের দাম সামান্য বেশি রাখার কথা। কিন্তু এখন তারা যে দাম রাখছে, তা যেকোনো স্থানের হোটেলগুলোর তুলনায় দুই-তিন গুণ বেশি। এই দাম দিয়ে খাবার খাওয়া আসলেই যে কারও জন্য কষ্টকর।’ বাস মালিকদের সাথে হাইওয়ে হোটেলগুলোর সিন্ডিকেটের কারণে খাবারের দাম বেশি জানিয়ে মোবারক হোসেন বলেন, ‘আমি যেহেতু বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয় কাজ করেছি সেহেতু জানি, বড় একটি সিন্ডিকেটের কারণে খাবারের দাম যাত্রীদের নাগালের বাইরে। হাইওয়ে হোটেলগুলোর মালিকরা মূলত বাস মালিকদের সাথে চুক্তি করেন। চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট কোম্পানির বাসগুলো তাদের নির্ধারিত হোটেলগুলোতে থামবে। অন্য কোনো হোটেলে থামবে না। একেকজন হোটেল মালিক একাধিক কোম্পানির সাথে চুক্তি করেন। যার সাথে যে হোটেলের চুক্তি তার সবগুলো বাস নির্দিষ্ট হোটেলে যাত্রাবিরতি দেয়। এ ক্ষেত্রে হোটেলগুলো নিজস্ব খাবার তালিকা ও দাম নির্ধারণ করে নেয়। এক হোটেলের খাবারের দামের সাথে অন্য হোটেলের দামের কোনো মিল নেই।’


তদারকি নেই প্রশাসন ও ভোক্তা অধিকারের : এ দিকে হাইওয়ে হোটেলগুলোর খাবারের দাম নিয়ন্ত্রণ কিংবা তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি জেলা প্রশাসন ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের। ফলে হাইওয়ে হোটেলগুলোর কাছে জিম্মি যাত্রীরা। বলা চলে বাস মালিকদের সাথে হোটেল মালিকরা চুক্তিবদ্ধ হয়ে এক রকম আয়োজন করে যাত্রীদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার অংশে ১০৫ কিলোমিটার। এই এলাকাজুড়ে সড়কের পাশে নান্দনিক ৭০টির বেশি হাইওয়ে হোটেল-রেস্তোরাঁ তৈরি করা হয়েছে। এসব হোটেল-রেস্তোরাঁর মূল ক্রেতা বাসযাত্রী। কোনোটি আবাসিক আবার কোনোটি রেস্তোরাঁ। এসব হোটেল-রেস্তোরাঁয় দৈনিক পাঁচ কোটি টাকার খাবার বিক্রি হয়।


টাকা নেন পরিবহন মালিকরা, ফ্রিতে খান চালক-হেলপার : অন্তত ১০টি হোটেল-রেস্তোরাঁর মালিক, পাঁচজন বাসচালক-হেলপার, একাধিক যাত্রী ও হোটেলশ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, হাইওয়ে হোটেল-রেস্তোরাঁর মালিকদের সাথে পরিবহন মালিকদের মৌখিক চুক্তি হয়। চুক্তিতে বলা হয়, হোটেলে যদি তার পরিবহন যাত্রাবিরতি দেয় তাহলে তাকে একটি টোকেন মানি দিতে হবে। অর্থাৎ প্রতি মাসে একটি খরচ দিতে হবে। সেইসাথেতার পরিবহনের চালক-হেলপারকে ফ্রি খাওয়াতে হবে। অনেক সময় হোটেল প্রতিষ্ঠার আগেই পরিবহন মালিকদের সাথে তাদের চুক্তি হয়। তাই আগেভাগেই আর্থিক লেনদেন সেরে ফেলেন। এতে আর্থিক বিনিয়োগের চাপ পড়ে ভোক্তাদের ওপর। তাই হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবারের মূল্য বাড়িয়ে বিনিয়োগ তোলেন মালিকরা।


খাবারের দাম দ্বিগুণ : হাইওয়ে হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোতে শহরের যেকোনো হোটেল-রেস্তোরাঁর চেয়ে খাবারের দাম ?দ্বিগুণ। শহরের হোটেল-রেস্তোরাঁয় আলুর ভর্তার দাম ১০-১৫, শুঁটকি ভর্তা ২০-২৫, গরুর গোশত ১২০-১৫০, মাছ ৮০-১২০, খাসির গোশত ১৪০-১৬০, মুরগির গোশত ৮০-১২০ ও ডাল-সবজি ২০-৩০ টাকা।


অন্য দিকে হাইওয়ে হোটেল-রেস্তোরাঁয় আলু ও ডিম ভর্তা ৪০-১০০, গরুর গোশত ২৮০-৩০০, মুরগির গোশত ২২০-২৫০, মাছ ১০০-৪০০ টাকা। নাশতার জন্য পরোটা ২০-৩০, ডিম ৩০, নান রুটি ৪০-১৫০, সবজি-চিকেন বার্গার ৭০-১৫০, পান ২০-১০০, কাপ দই ৫০-১০০ ও শিঙ্গাড়া-সমুচা ২০-৪০ টাকা। তবে কোনো কোনো হাইওয়ে হোটেলে এসব খাবারের ভিন্নতায় দাম আরো বেশি নেয়া হয়।
যা বলছেন হোটেল মালিকরা : দাম বেশি রাখার কারণ জানতে চাইলে হাইওয়ে হোটেল নুরজাহানের মালিক মোহাম্মদ রিপন বলেন, ‘দাম নির্ধারণ করে হোটেল মালিক সমিতি। তাদের দামের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। আমরা দাম বেশি রাখি কথাটি ঠিক নয়। তবে কোনো কোনো যাত্রী অভিযোগ করলেও অধিকাংশই করেন না।’


কুমিল্লা শহরের কয়েকটি হোটেলের নাম উল্লেখ করে মোহাম্মদ রিপন বলেন, ‘আপনি যদি ওসব হোটেলের সাথে হোটেল নুরজাহান কিংবা হাইওয়ে ইনের তুলনা করেন তাহলে হবে না। কারণ সেখানকার পরিবেশ আর আমাদের পরিবেশ এক নয়। শহরের হোটেলে স্বাস্থ্যসম্মত গোশতের নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। কিন্তু আমরা নিশ্চয়তা দিই। মান ও পরিমাণ বিবেচনা করে আমরা দাম নির্ধারণ করি। শহরের হোটেলের খাবারের পরিমাণ আর হাইওয়ে হোটেলের খাবারের পরিমাণ এক নয়। তাদের সাথে আমাদের তুলনা চলে না।’
হোটেল মালিক সমিতি : এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কুমিল্লা জেলা হোটেল-রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নাছিরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ‘একেকটা হোটেল-রেস্তোরাঁয় একেকটি কোম্পানির বাসকে যাত্রাবিরতি দিতে মাসে অনেক টাকা খরচ হয় হোটেল মালিকদের। একেক বাসের তিনজন স্টাফকে প্রতিবার যাত্রা বিরতিতে ফ্রিতে খাওয়াতে হয়। এই দুই কারণেই মূলত হাইওয়ে হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাবারের দাম বেশি রাখতে হয়। তার ওপর যাত্রীদের ওয়াশরুম ব্যবহার, সেগুলোর জন্য বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল, গ্যাস বিল ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী বেতন দিতে হয়। এ ছাড়া হোটেল ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন তো আছেই। সরকার যদি একটা নীতিমালা করতো, কোন হোটেলে কতটি বাস যাত্রাবিরতি করবে, তা বেঁধে দিত, বাস মালিকরা এ জন্য হোটেল মালিকদের কাছ থেকে কোনো টাকা নিতে পারবেন না, স্টাফদের টাকা দিয়ে খেতে হবে। তাহলে খাবারের দাম অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসত।’


সম্পর্ক নেই দাবি বাস মালিক সমিতির : তবে হাইওয়ে হোটেল মালিকদের সাথে জেলা বাস মালিক সমিতির কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেছেন সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি কুমিল্লা জেলার সভাপতি তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘মূলত আন্তঃজেলার বাসগুলো হাইওয়ে হোটেল-রেস্তোরাঁয় যাত্রাবিরতি দেয়। এ জন্য বাস মালিকদের সাথে হোটেল মালিকদের চুক্তি আছে। চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত হোটেলে থামে বাসগুলো। কেন হোটেলগুলোতে খাবারের দাম বেশি রাখা হয় এ বিষয়ে তারাই ভালো জানেন। এর সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’