Naya Diganta
উঠতি বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা

দৃঢ় পারিবারিক বন্ধন গড়ে তুলতে হবে

উঠতি বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা

দেশে গত বছর ৫৩২ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। তাদের মধ্যে স্কুল পর্যায়ের ৩৪০ জন, কলেজ পর্যায়ের ১০৬, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৬ জন। আর মাদরাসা শিক্ষার্থী ৫৪ জন। তবে ২০২১-এর তুলনায় ২০২২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার কমেছে। গত শুক্রবার সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের ‘স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা : সমাধান কোন পথে’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের সাথে শিক্ষার্থীদের মানিয়ে নিতে প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি হতে হয়। তবে পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা না থাকায় পরিস্থিতি মোকাবেলার কৌশল সেভাবে শেখানো হয় না। ফলে ওই বয়সে আত্মহত্যার হার বেশি। আঁচল ফাউন্ডেশনের সমীক্ষায়ও উঠে এসেছে একই চিত্র। এতে বলা হয়েছে, ১৩-১৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। আত্মহত্যা করা ৪০৫ জনের মধ্যে ৭৬ দশমিক ১২ শতাংশ উঠতি বয়সী। তাদের মধ্যে ৬৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ মেয়ে ও ৩৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ ছেলে। আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের ৮ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশের বয়স ৭-১২ বছরের মধ্যে। তাদের মধ্যে ৪৬ দশমিক ৫২ শতাংশ মেয়ে, ছেলে ৫৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
লক্ষণীয়, আত্মহত্যাকারীদের সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী এ পথ বেছে নিয়েছে ‘মান-অভিমান’ থেকে। তাদের বড় অংশের অভিমান পরিবারের সাথে। অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- প্রেমঘটিত, পারিবারিক কলহ, হতাশাগ্রস্ততা, মানসিক সমস্যা, আর্থিক সমস্যা, উত্ত্যক্ত, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হওয়া। আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়া, শিক্ষকের হাতে অপমানিত হওয়া, গেম খেলতে বাধা দেয়া, পরীক্ষায় ব্যর্থতা, মোবাইল ফোন, মোটরসাইকেল কিনে না দেয়ায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে অনেকে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, শিশু-কিশোরদের মন হয় ‘দুর্বল প্রকৃতির’। এ বয়সে ছোট ছোট বিষয়ও তাদের হৃদয় আন্দোলিত করে। বয়ঃসন্ধিকালে মানসিক বিকাশের সাথে অনেকে খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে প্রত্যাশার ক্ষেত্রে ছোটখাটো ঘাটতিতেও অনেকে আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। তবে বাস্তবতা হলো- দেশে এ বয়সে শিক্ষার্থীর সঠিক পরামর্শ পাওয়ার জায়গা অপ্রতুল।
কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহননের প্রবণতা প্রতিরোধে মা-বাবার সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের যতœ ও সচেতনতা তৈরির কোনো বিকল্প নেই। বয়ঃসন্ধিকালীন মনের যতœ বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। ছেলেমেয়েদের খেলাধুলার সুযোগ করে দিতে হবে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলাধুলার পরিবেশ বাড়ানো। এ ছাড়া মোবাইল আসক্তি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পরিবারের সাথে ভালো সময় কাটানোর চর্চা বাড়াতে হবে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে আত্মবিশ্বাসী ও সুস্থ মনন গড়ে তুলতে পদক্ষেপগুলো নেয়া সব অভিভাবকের কর্তব্য। হতাশা, একাকিত্ব ও নেতিবাচক ভাবনা থেকে শিক্ষার্থীদের দূরে রাখতে সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ বাড়ানো এখন অত্যাবশ্যক। সেই সাথে সন্তানের মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করতে এবং তাদের কথা সহানুভূতির সাথে শুনতে অভিভাবকদের জন্য প্যারেন্টিং কার্যক্রম চালু করার এখনই উত্তম সময়। সেই সাথে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষক-কর্মচারীদের আচরণ এবং পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে কৌশলী ও সহানুভূতিশীল হতে প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে আত্মহননের প্রবণতা কমিয়ে আনতে সর্বপ্রথম পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করা সময়ের দাবি। কারণ, সন্তানের সুস্থ মনন গড়ে তোলায় প্রথমে প্রতিটি পরিবারকে যতœবান হতে হয়। এ জন্য স্কুল-কলেজ পর্যায়েও কিছু কর্মসূচি নেয়া আবশ্যক। এর মধ্যে থাকতে পারে, আত্মহত্যা প্রতিরোধী সচেতনতামূলক কর্মসূচি। দারিদ্র্যের কারণে যাতে কোনো ছাত্রছাত্রী আত্মহত্যার পথ বেছে না নেয়; সে জন্য স্কুল-কলেজের ছাত্রকল্যাণ ফান্ডের কার্যক্রম ত্বরান্বিত করে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তাদের আর্থিক সমস্যা সমাধান অনেকাংশে করা সম্ভব বলে আমরা মনে করি। এতে আর্থিক সঙ্কটজনিত আত্মহত্যার হার কমে আসবে।
আমরা মনে করি, টিনএজারদের মধ্যে আত্মহননের প্রবণতা কমিয়ে আনতে প্রতিটি আত্মহত্যার ঘটনায় পরিবারের ভূমিকা খতিয়ে দেখে আইনি বাধ্যবাধকতাও নিশ্চিত করা অতীব প্রয়োজন।