Naya Diganta

আমাদের প্রথম আধুনিক কবি

কবি মধুসূদন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ কবি। প্রথম আধুনিক কবি। কবিতার প্রকৃত মজ্জা নিয়ে তিনি জন্ম নেন। কবিতার জন্য অপরিসীম ভালোবাসা, অনন্য ত্যাগ স্বীকার করা যায় তা তিনি প্রমাণ করেছেন তার ব্যক্তি ও কবি জীবনে। জমিদারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও কবিতার জন্য প্রথম তারুণ্যেই বিসর্জন দিয়েছেন জীবন, ভোগ ও প্রথাগত প্রতিষ্ঠার অভিলাষ। ষোলো বছরের যুবক সবেমাত্র কলেজের ছাত্র, স্বপ্ন বাঁধলেন জীবনে কবি হবেন, বড় কবি- মিল্টন, হোমার, ওভিদ, টাসোর মতো বড় কবি। ফলে ধর্মান্তরিত হলেন, রূপান্তরিত হলেন ত্যাজ্যপুত্রে। হয়ে গেলেন আত্মবঞ্চিত এক রিক্ত পথিক। প্রতিভাধরদের দুর্ভোগ পোহাতে হয় যুগে যুগে এমন দৃষ্টান্ত বিপুল। বাংলা সাহিত্যের সর্বপ্রথম এই পরিণতি বরণ করেন তিনি। একাধিক কারণে তিনি বিশিষ্ট, স্বতন্ত্র ও অনন্য।
বাংলা সাহিত্যে আমরা মূলত তিনটি যুগ বিভাজন দেখতে পাই। এর মধ্যে আধুনিক যুগ একটি। সাহিত্যক্ষেত্রে আধুনিক কথাটা যখন উচ্চারিত হয় তখন মধুসূদনের নামটি স্মরণে আসে ও মূল্যবান হয়ে দেখা দেয়, অন্তত সাহিত্যের পাঠক, গবেষক ও সাহিত্যচর্চাশীলদের কাছে। মধুসূদনের কৃতিত্ব হলো তিনি সর্বপ্রথম আমাদের সাহিত্যে আধুনিক বোধ ও চৈতন্যের সূচনা করেন। এ কারণে তিনি সর্বপ্রথম তুখোড় প্রতিভাধর সার্থক আধুনিক কবি ব্যক্তিত্ব। জীবন ও বাস্তবতা অনুষঙ্গে সর্বপ্রথম প্রাসঙ্গিক সাহিত্য প্রতিভা। প্রাচীন যুগের প্রসঙ্গ না তুলে যদি শুধু মধ্যযুগের কথা বলি সেখানে দেখি মধ্যযুগের সাহিত্যে মানুষকে অসহায় করে রাখা হয়েছে প্রায় ৫ শ’ বছর। অর্থাৎ মানুষ দেবতার কাছে অসহায়, মানুষের ভাগ্য অবাস্তব দেবতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আবার প্রণয় উপাখ্যানে দেখা যায় অবাস্তব প্রেম মানুষের মনে কাতরতা, অসহায়তা নির্মাণ করেছে। সেখানে মানুষ ও জীবনের প্রাধান্য অনুপস্থিত। আবার বিষয়বস্তুর দিক থেকে একই উপকরণ বারবার ফিরে এসেছে। ফলে বিষয়বস্তুর এই ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তি মানুষের চিত্তকে করেছে ভারাক্রান্ত। বৈজ্ঞানিক ও নতভাবে মানুষ মূলত অস্তিত্বের কাছে অসহায়। মানবজীবনে নিবিড় সঙ্কট, সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ প্রবলভাবে বিদ্যমান। মানবজীবনের এই অনিবার্য বৈশিষ্ট্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি সর্বপ্রথম সোচ্চার হন এবং সচেষ্ট হন। এভাবে বাংলা সাহিত্যে নতুন স্বাদের উদ্বোধন করেন। এ কর্মক্ষেত্রে তাকে অসম্ভব বিপ্লব ও প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। ক্ষতবিক্ষত অভিজ্ঞতার প্রতাপ ও প্রজ্ঞা দিয়ে তিনি বারবার জীবনকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন তার সাহিত্যকর্মে।

পৃথিবীতে ঊনবিংশ শতাব্দী বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষ করে ইউরোপে অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তন দেখা যায়। সে পরিবর্তন এসেছিল সাহিত্যেও। আধুনিক কবিদের মধ্যে আধুনিকতার ঢেউ লেগেছিল তাদের জীবন ও রুচিতে। বঙ্কিমচন্দ্র ইউরোপীয় সাহিত্য-সংস্কৃতিতে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন, বিশেষ করে ইংরেজি সাহিত্যধারা প্রভাবিত হন এবং রচনা করেন বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’- এটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক উপন্যাস, প্রকাশিত হয় ১৮৬৫ সালে। এর আগেই মধুসূদন বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক মহাকাব্য ‘মেঘনাদ বধ’ ও প্রথম সার্থক নাটক ‘কৃষ্ণ কুমারী’ প্রকাশ করেন ১৮৬১ সালে।
কবিতায় আনেন নতুন স্বাদ, শব্দ প্রয়োগ, ছন্দ ও বিষয়বস্তু সবকিছুতেই একটি নতুন পরিবর্তন সাধন করেন। ফলে বাংলা কবিতা মানুষের কাছে আধুনিক মননের এক বিস্ময়কর চমক নিয়ে আবির্ভূত হয়। মধুসূদনের কারণে বাংলা কবিতা সর্বপ্রথম আবৃত্তিযোগ্য হয়ে ওঠে। তবে যৌবনের প্রথম উচ্ছ্বাসে বেশ কিছু ইংরেজি কবিতা রচনা করেন, ঈধঢ়ঃরাব খধফু নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তবে এসব লেখা তার জীবনে তেমন কোনো সুফল বয়ে আনেনি। তিনি মূল কাজটা করেন বাংলা ভাষায়। তাই বলা যায় কবিতা, নাটক, মহাকাব্য এই তিনটি ক্ষেত্রেই মানুষকে অসম্ভব গ্রাহ্য করে একটি সত্যিকার মূল্যবোধ ও বাস্তবতা প্রতিষ্ঠা করেন। যেমন ‘কৃষ্ণ কুমারী’ নাটকে জীবনের নিগূঢ় চিত্র ফুটে উঠেছে। বিসংবাদ ও সঙ্ঘাতের মধ্য দিয়ে নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের বিপন্ন জীবনের ছবি দেখা যায়। এক অনিবার্য অসহায়তা মানুষকে করেছে বিহ্বল, করুণ পরিণতির মুখোমুখি। এ ঘটনা সর্বকালের মানুষের জন্য একটি অনিবার্য সত্য বহন করে।
মধুসূদনের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম ‘মেঘনাদ বধ’ মহাকাব্য। গ্রিক ও ইংরেজি সাহিত্যে অধীত বিদ্যার অভিজ্ঞতা এ গ্রন্থ রচনায় তিনি সচেতনভাবে প্রয়োগ করেন। স্টাইল ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে অনেক সাদৃশ্য পাওয়া যায়। ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্য বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম অধিক মূল্যবান এ কারণে- এ কাব্যে প্রবল সর্বনাশের মধ্যেও মানবের ব্যক্তিত্ব ও জীবনের বন্দনা উচ্চকিত হয়েছে। প্রবল প্রতাপশালী রাবণ নিজ পুত্র হত্যা প্রত্যক্ষ করছেন। পুত্র হত্যার শোক তাকে ব্যথিত বিচলিত করছে না। তার একমাত্র উৎকণ্ঠা তার দেশে পরদেশী শত্রু বাহিনী রামেরা। অস্তিত্ব বোধের এমন দৃষ্টান্ত বিশ্বসাহিত্যেও বিরল, যদিও ‘চাঁদ সওদাগর’ চরিত্রটি অনুরূপ দৃষ্টান্তের কথা স্মরণ করে দেয়। সুতরাং বিবিধ বিচারে এ কথা বলা প্রাসঙ্গিক কবি মধুসূদন বাংলা সাহিত্যের সর্বপ্রথম মানব ও জীবনবাদী কবি।