Naya Diganta

জ্বালানি খাতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা

জ্বালানি খাতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা।

২০২৩ সাল কঠিন হবে। কম রফতানি সুযোগ এবং উচ্চ আমদানি বিলের দ্বৈত আক্রমণ থেকে বাঁচতে বাংলাদেশ ও নেপালের ভারতের সাথে জ্বালানি বাণিজ্য সম্প্রসারণের সময় এসেছে।

২০২৩ সাল বিশ্ব অর্থনীতির জন্য একটি কঠিন বছর হবে, তা কম-বেশি নিশ্চিত। স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রথমবারের মতো; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং একসময়ের প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন চীন একসাথে মন্দার পর্যায়ে প্রবেশ করছে।

ট্রেডিং ইকোনমিকসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০২২ সালের নভেম্বরে চীনের (অভ্যন্তরীণ) খুচরা বাণিজ্য ৫.৯ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যা আগের মাসে ০.৫ শতাংশ পতনের চেয়ে অনেক দ্রুত এবং বাজারের ৩.৭ পতনের প্রত্যাশার চেয়ে খারাপ।’

ভারত (ও ইন্দোনেশিয়া) এই প্রবণতার ব্যতিক্রম থাকবে। বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) উপ-আঞ্চলিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের জন্য এটাই সেরা বাজি, যা প্রায় তিন বছর ধরে ক্রমাগত অস্থিরতা থেকে গুরুতরভাবে চাপে রয়েছে।

ইউক্রেন সঙ্কটের পর ইউরোপের চাহিদার পুনর্বণ্টন কয়লার দাম শক্তিশালী রাখবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শেল তেলের অপর্যাপ্ত সরবরাহ এবং পেট্রোলিয়াম রফতানিকারক দেশগুলোর সংস্থা ওপেকের প্রত্যাশিত উৎপাদন হ্রাস অপরিশোধিত দামের দৃঢ়তা নিশ্চিত করতে পারে।

জ্বালানি বাজারে তেজি ভাব এবং ডলারের উচ্চমূল্য ২০২৩ সালে ছোট অর্থনীতির জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে। তাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ সীমিত থাকবে।

ভুটান ও নেপাল তাদের ছোট আকার, বিশ্ব অর্থনীতিতে কম এক্সপোজার এবং ভারতীয় রুপির সাথে কারেন্সি পেগিংয়ের কারণে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ থাকবে। তবে তৈরী পোশাক বাজারজাত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল বাংলাদেশের জন্য পরিস্থিতি কঠিন হতে পারে। এখানেই বিশেষ করে জ্বালানি খাতে আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রাসঙ্গিকতা। এ অঞ্চলের জন্য সুযোগগুলো পুরোপুরি কাজে লাগানোর পাশাপাশি ঝুঁকি কমাতে এ ধরনের সহযোগিতার পরিধি প্রসারিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

চীন বড় বাধা
পরিস্থিতি সত্যিই কঠিন, কারণ চীন বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি বড় টান হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। চীনা অর্থনীতি কাঠামোগত প্রতিকূলতার মুখোমুখি হচ্ছে এবং বেইজিং নীতিগত অসঙ্গতির জন্য সংবেদনশীল বলে মনে হচ্ছে। বেইজিংয়ের ক্রমাগত কোভিড আরোপে সরবরাহ শৃঙ্খল বিঘ্নিত হয় এবং এটি সরবরাহের সাথে সম্পর্কিত বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতির পেছনে একটি প্রধান কারণ ছিল। জনগণের প্রতিবাদের মুখে চীন যখন হঠাৎ করে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করার পর নিয়েছে, বিপুল সংক্রমণ, বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ তৈরি করছে।

এই মন্দা চীনা পণ্যগুলোর বিশ্বব্যাপী উৎসকে প্রভাবিত করবে তবে উপমহাদেশে ততটা নয়। অত্যধিক ব্যয়বহুল অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বেইজিংয়ের দেয়া ঋণ আমদানি স্থিতিশীল রাখবে। কিন্তু উচ্চ আমদানি এবং তারপরে ঋণ পরিশোধে উচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের দ্বৈত আক্রমণ আরো খারাপ হতে পারে। এ ধরনের উচ্চাভিলাষী অনেক প্রকল্প শ্বেতহস্তি হিসাবে প্রমাণিত হতে পারে। এমন দুঃসাহসিক কাজের জন্য শ্রীলঙ্কাকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে।

ভুটান চীনা প্রভাব থেকে প্রায় মুক্ত। নেপাল আংশিকভাবে উন্মুক্ত। সামগ্রিকভাবে এই দুটি দেশে চীনের এক্সপোজার এখনো কম, কারণ তাদের আমদানি রফতানির বড় অংশই চলে ভারতের সাথে।

গত এক দশকে চীনা ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য বেইজিং একটি শীর্ষ আমদানি গন্তব্য। ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানিও গত কয়েক বছরে কৌশলগত গুরুত্ব অর্জন করেছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশে ভারতীয় রফতানি দ্বিগুণ হয়েছে, যেখানে চীন থেকে আমদানি বেড়েছে ৬০ শতাংশ। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পরিবর্তন ঘটেছে বাংলাদেশের রফতানি ক্ষেত্রে। ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে (আইটিসি ডেটা) বাংলাদেশী পণ্যের রফতানি গন্তব্য হিসেবে ভারতের র‌্যাংকিং অষ্টাদশ থেকে সপ্তম স্থানে উন্নীত হয়েছে। ত্রয়োদশ স্থানে আটকে ছিল চীন।

পেট্রোলিয়াম বাণিজ্য সম্প্রসারণ করা উচিত
জ্বালানি নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সরবরাহে যে কোনো ব্যাঘাত (যেমনটি বাংলাদেশ মোকাবেলা করছে) আরো প্রবৃদ্ধির সুযোগ কেড়ে নিতে পারে এবং তারল্য সঙ্কট আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে।

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ১৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ শিলিগুড়ি-পার্বতীপুর ডিজেল পাইপলাইনটি ২০২৩ সালের মার্চ মাসে চালু হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ভারত ২০১৯ সালে নেপালের সাথে ৬৯ কিলোমিটার আন্তঃদেশীয় মতিহারি-আমলেখগঞ্জ ডিজেল পাইপলাইন স্থাপন করেছে।

শিলিগুড়ি-পার্বতীপুর ডিজেল পাইপলাইনের যান্ত্রিক ইনস্টলেশন সম্পন্ন হয়েছে। এটি এখন প্রাক-কমিশনিং পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বার্ষিক এক মিলিয়ন টন (এমটিপিএ) ক্ষমতাসম্পন্ন পাইপলাইন পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে আসামের নুমালিগড় রিফাইনারি (এনআরএল)। বাংলাদেশ এখনো পার্বতীপুরে প্রয়োজনীয় স্টোরেজ সুবিধা তৈরি করতে পারেনি। এটি পাইপলাইনের ক্ষমতার এক-চতুর্থাংশে প্রাথমিক উত্তোলন সীমাবদ্ধ করবে। এনআরএল সড়ক পথ ও অভ্যন্তরীণ নৌপথেও জ্বালানি প্রেরণের উপায় খুঁজছে।

২০২৪ সালের শেষে সক্ষমতা সম্প্রসারণ (তিন এমটিপিএ থেকে নয় এমটিপিএ) সম্পন্ন হওয়ার পরে এনআরএল-এর রফতানি সম্ভাবনা বাড়বে। তবে প্রতিবেশীদের অবকাঠামোর অভাব ভারতের লক্ষ্য অর্জনে একটি বড় বাধা। নেপাল ভারতকে ৫০-৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ আরো দুটি আন্তঃদেশীয় পাইপলাইন নির্মাণের অনুরোধ জানিয়েছে, যাতে পরিবহন ও স্টোরেজ সুবিধার অভাব দূর করা যায়। বাংলাদেশ পার্বতীপুর পাইপলাইনের রংপুর পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার সম্প্রসারণে আগ্রহী। ভারত আরো ভালো বাজারে প্রবেশাধিকার পাবার জন্য এসব প্রস্তাবের কয়েকটি গ্রহণ করতে পারে।

বিদ্যুতে নতুন সুযোগ
এই উপ-অঞ্চলে বিদ্যুৎ বাণিজ্য নতুন কিছু নয়। ভুটান থেকে আমদানি করা জলবিদ্যুৎ ভারতে বিদ্যুতের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নেপাল জলবিদ্যুৎ সক্ষমতা অর্জনের সাথে সাথে বারত সম্প্রতি নেপাল থেকে ৪০০ মেগাওয়াটেরও বেশি বিদ্যুৎ আমদানির বিধান তৈরি করেছে। বিদ্যুৎ এখন নেপালের তৃতীয় বৃহত্তম রফতানি রাজস্ব উপার্জনকারী হয়ে উঠেছে।

ভারত এখন বাংলাদেশকে ১,২০০ মেগাওয়াটের সামান্য কম বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। ২০২০ সালে বাংলাদেশে বিদ্যুতের প্রাপ্যতার প্রায় ১০ শতাংশ ছিল আমদানি করা।

২০২২ সালে ঢাকা যখন বৈদেশিক মুদ্রা সঙ্কটের কারণে ব্যয়বহুল গ্যাস এবং তরল জ্বালানি থেকে উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করতে বাধ্য হয় তখন এই চুক্তির গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ২০২৩ সালে বিদ্যুতে আমদানির অংশ নাটকীয়ভাবে বাড়বে। কারণ আদানি পাওয়ার ঝাড়খণ্ডে ১৬০০ মেগাওয়াট প্ল্যান্ট থেকে বাংলাদেশে সরবরাহ শুরু করবে। ভারতের প্রথম ইউনিট এবং ট্রান্সমিশন সুবিধা প্রস্তুত রয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা সাবস্টেশনের কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরবরাহ শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে। দ্বিতীয় ইউনিটটি ২০২৩ সালের মার্চের মধ্যে চালু হওয়ার কথা।

যদি চারটি দেশ একটি সাধারণ বা যৌথ বিদ্যুৎ গ্রিড তৈরি করে তবে বাণিজ্যের পরিধি ব্যাপকভাবে বাড়তে পারে। ভারত ও ভুটানের মধ্যে এ ধরনের আন্তঃদেশীয় গ্রিড রয়েছে। বাংলাদেশ ও নেপালেরও একরকম গ্রিড ব্যবস্থায় যোগ দেয়ার সময় এসেছে।

একটি যৌথ বিদ্যুৎ গ্রিড (সিনক্রোনাস গ্রিড) একটি সাধারণ কোডের অধীনে পরিচালিত হয়। এতে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোকে গ্রিড পরিচালনায় একই প্রযুক্তিগত এবং বাণিজ্যিক মান বজায় রাখতে হয়। কিন্তু প্রযুক্তিগত মান ও নিয়ন্ত্রক কাঠামোর অসামঞ্জস্যতার কারণে, ভারত নেপাল ও বাংলাদেশের সাথে অ্যা-সিনক্রোনাস (সীমিত একমুখী অপারেশন) মোডের মাধ্যমে বিদ্যুৎ বাণিজ্য করে।

বিবিআইএন দেশগুলোর টেকসই সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ভারতে পুনর্নবীকরণযোগ্য উৎপাদনের অংশ বৃদ্ধি এই অঞ্চলে বিদ্যুৎ বাণিজ্যের নতুন সুযোগ তৈরি করছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে ২০ মেগাওয়াট লোয়ার সুবনসিরি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম দুটি ইউনিট চালু হওয়ার সাথে সাথে উত্তর-পূর্ব ভারতে বিদ্যুৎ-উদ্বৃত্ত হবে। সময়ের সাথে সাথে উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ বাড়তে থাকবে কারণ এ অঞ্চলে আরো প্রকল্প রয়েছে।

লেখক : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে গবেষণা সহকারী