Naya Diganta

ঢাকার কৌশলগত আকাশে ঘনীভূত মেঘ

বাংলাদেশের আকাশে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ঘনীভূত মেঘের আনাগোনা উদ্বেগ ছড়াচ্ছে। দৃশ্যপটের অন্তরালের ঘটনা যারা পাঠ করতে পারেন তারা অনেক আগেই সতর্ক করেছিলেন কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি দেশকে বড় ধরনের কৌশলগত সঙ্কটে ফেলতে পারে। সেটাই সম্ভবত এখন দৃশ্যমান। পাঁচ বছর আগেই ধারণা করা হয়েছিল বিশ্বে প্রভাব বিস্তারে চীন আমেরিকা দ্বন্দ্ব প্রবল হতে পারে। সেটি এখন বাংলাদেশের দোরগোড়ায় এমনভাবে হাজির হয়েছে যে তা প্রতিরোধে বাংলাদেশ কতটা সমর্থ হবে সেই সংশয় দেখা দিয়েছে।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা রিয়ার অ্যাডমিরাল আইলিন লাউবাচার এবং পররাষ্ট্র দফতরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মন্ত্রী ডোনাল্ড লু’র বাংলাদেশ সফর এবং ঠিক এই সময়েই চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিং গ্যাং-এর আকস্মিকভাবে বাংলাদেশে ছুটে আসা কৌশলগত দৃশ্যপটে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির ইঙ্গিত দেয়। তিনি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির তিন সদস্যের একটি শক্তিশালী দল ঢাকায় রেখে গেছেন, যারা এখানে আমেরিকান কর্মকর্তাদের আলোচনা ও কর্মকাণ্ড ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেন।

তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা : বার্মা বিল
বাংলাদেশে ঘটে চলা তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়ের রাজনৈতিক দিকগুলো নিয়ে কেবল এখানকার গণমাধ্যমে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এর কৌশলগত দিক দৃষ্টির অন্তরালে রয়ে গেছে। এটি পুরো এই অঞ্চলের পরিস্থিতি পাল্টে দিতে পারে। এই অঞ্চলকে পরিণত করতে পারে প্রক্সি লড়াইয়ের ক্ষেত্রে। বঙ্গোপসাগরের এই অঞ্চল নিয়ে গুরুতর এক পরিকল্পনা যে অগ্রসর হতে চলেছে সেটি কিছু ঘটনায় অনুমান করা যায়। একটি ঘটনা ছিল মার্কিন সিনেটে অতি সম্প্রতি সামরিক ব্যয় অনুমোদনের একটি আইনে বার্মা আইনের একটি সংশোধনী অন্তর্ভুক্ত করা। গত বছরের অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারে শাসক জান্তার সাথে লড়াইরত গণতন্ত্রপন্থী শক্তিকে সাহায্য করার লক্ষ্যে এই সমন্বয় আনা হয়।

২০২৩ সালের জাতীয় প্রতিরক্ষা অনুমোদন আইনে মিয়ানমারের জান্তা শাসনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং মিয়ানমারের বিরোধী ও প্রতিরোধ গোষ্ঠীকে সহায়তায় মার্কিন সরকারের কর্তৃত্ব বাড়ানো হয়। আলোচ্য বিলটির উদ্যোক্তা মাইকেল হ্যাক ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেছেন, বার্মা আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ক্ষমতাসীন জান্তার সদস্যদের ওপর টার্গেটেড নিষেধাজ্ঞার কোডিফিকেশন এবং সম্প্রসারণ; জান্তার আয়ের অন্যতম উৎস রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি মিয়ানমার অয়েল অ্যান্ড গ্যাস এন্টারপ্রাইজের ওপর সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা এবং জান্তাবিরোধী শক্তির প্রতি সর্বাত্মক সমর্থনের অঙ্গীকার।

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন উদ্যোগটি অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী প্রতিরোধ লড়াই এখন গুরুত্বপূর্ণ পর্বে প্রবেশ করেছে। জাতীয় ঐক্য সরকারের নেতৃত্বে যে প্রতিরোধ যুদ্ধ চলছে তাতে ৫২ শতাংশ ভূমির ওপর জান্তা সরকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র্র এবং যুক্তরাজ্যের মতো তার অন্য মিত্ররা মিয়ানমারের সশন্ত্র প্রতিরোধ লড়াই সর্বাত্মকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় ঐক্য সরকার একটি সমান্তরাল সরকারে পরিণত হতে চলেছে মিয়ানমারে। আসিয়ানের অধিকাংশ সদস্য অনানুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্ক তৈরি করছে এই সরকারের সাথে। ধারণা করা হচ্ছে, পশ্চিমা মিত্ররা অদূরভবিষ্যতে মিয়ানমারের বৈধ সরকার হিসাবে জাতীয় ঐক্য সরকারকে স্বীকৃতি দিতে পারে। আর মিয়ানমারে তাদের এজেন্ডা এগিয়ে নিতে আশপাশের দেশগুলোতেও তাদের প্রভাব সংহত করার চেষ্টা করছে।

চীন-মার্কিন স্বার্থদ্বন্দ্ব ও নো ফ্লাই জোন
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোতে এমন সব ঘটনা ঘটছে যাতে বিশ্বশক্তিগুলো কোনোভাবেই তাদের এজেন্ডায় ছাড় দেবে না। এই অঞ্চলের স্বার্থগত বিষয়গুলো কতটা ব্যাপক ও গভীর সেটি অনুমান করা যায় নতুন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিন গ্যাং-এর প্রথম বিদেশ সফরের যাত্রাবিরতি বাংলাদেশে করে ২ ঘণ্টাব্যাপী বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করার মধ্য দিয়ে।

এই অঞ্চলে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থগত দ্বন্দ্বের গভীরতার বিষয়টি লু’র বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেবার দিন বিবিসি ও রয়টার্সের সাবেক আঞ্চলিক সংবাদদাতা সুবির ভৌমিকের এক লেখায় ফুটে ওঠে। তিনি দি ফেডারেল এ প্রকাশিত এক লেখায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশে উচ্চ পর্যায়ের মার্কিন ও চীনা কর্মকর্তাদের সফর এবং মিয়ানমারের পশ্চিম সীমান্তে মিয়ানমারের সামরিক ও বিদ্রোহী বাহিনীর মধ্যে লড়াইয়ের নতুন উত্থানের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে নববর্ষের সূচনা হয়েছে। এই সঙ্ঘাতে মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা বিমানশক্তির ব্যাপক ও নৃশংস ব্যবহার করেছে। পেন্টাগন ও পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তাদের বাংলাদেশে সফর এই জল্পনাকে উসকে দিয়েছে যে, মিয়ানমারে গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনের সুবিধার্থে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ না করা হলেও যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত মিয়ানমারের ওপর বসনিয়া-টাইপ নো-ফ্লাই জোন কার্যকর করার বিষয় সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে। মিয়ানমারের ওপর বিমান উড্ডয়নমুক্ত অঞ্চল কার্যকর করার জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের লজিস্টিক সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র যদি প্রস্তাবিত নো-ফ্লাই জোন নিয়ে এগিয়ে যায় তাহলে ঢাকা চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বের মধ্যে আটকে যাবে।’

সুবির ভৌমিক লিখেছেন, ন্যাটোর (প্রধানত যুক্তরাষ্ট্র) আরোপিত বসনিয়া ধরনের একটি নো-ফ্লাই জোন, বেসামরিক ও জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর লড়াইকে পুনরায় ভারসাম্যপূর্ণ করবে। এতে রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী পরাজয়ের মুখে পড়তে পারে। একই অবস্থায় পড়তে পারে চিন, সাগাইং এবং কাচিন প্রদেশে। সেখানে আরাকান আর্মি এবং কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মির মতো বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলো প্রদেশের বেশির ভাগ অঞ্চলের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়েছে। এখন পর্যন্ত, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বড় আকারের বিমানশক্তি ব্যবহার করে এই প্রদেশগুলোতে কোনোভাবে অবস্থান বজায় রাখতে পেরেছে। মিজোরামের সীমান্তে চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট এবং বামার পিডিএফ যৌথভাবে পরিচালিত ক্যাম্প ভিক্টোরিয়াতে বোমা পড়লে, ভারতীয় মিজোরামে একটি বড় শরণার্থী অনুপ্রবেশের চ্যালেঞ্জিং সম্ভাবনা জেগে ওঠে যেখানে ইতোমধ্যেই মিয়ানমার থেকে ২০ হাজারেরও বেশি শরণার্থী রয়েছে।


চীনের জন্য উদ্বেগের বিষয় হলো, নো-ফ্লাই জোন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন করলে তা চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোরের কার্যক্রম ব্যর্থ করে দিতে পারে। এই করিডোর বরাবর চীনের অর্থায়নে কিয়াউকফিউ গভীর সমুদ্রবন্দরকে চীনের ইউনান প্রদেশের সাথে সংযুক্ত করে তেল-গ্যাস পাইপলাইন তৈরি করা হচ্ছে। জান্তা উৎখাত এবং মিয়ানমারের সেনাবাহিনী- তাতমাদাও মারাত্মকভাবে দুর্বল হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে ভারত মহাসাগরে চীনের স্থল থেকে সমুদ্রে প্রবেশের পথ অবরুদ্ধ করতে পারে। চীনকে আটকে রাখার জন্য এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল কৌশলগত লক্ষ্য মনে করা হয়। মিয়ানমারের ওপর নো-ফ্লাই জোন তৈরির প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো লজিস্টিক্যাল সহায়তা প্রতিষ্ঠা ও বজায় রাখা। এ ক্ষেত্রে এয়ার কভারেজ প্রদানের জন্য বঙ্গোপসাগরে মিয়ানমারের উপকূলে একটি বিমানবাহী রণতরী যথেষ্ট হতে পারে। তবে যদি নো-ফ্লাই জোন একটি টেকসই প্রচেষ্টা হয়ে ওঠে তবে তার জন্য কিছু ধরনের স্থলভিত্তিক সরবরাহব্যবস্থারও প্রয়োজন হবে। বলা হচ্ছে, এ কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশের বন্দর এবং সংলগ্ন স্থল অঞ্চলগুলোতে রসদ বজায় রাখার জন্য অ্যাক্সেস চাইতে পারে।

মিয়ানমারের সম্ভাব্য নো-ফ্লাই জোনের জন্য লজিস্টিক সহায়তা দিতে যুক্তরাষ্ট্র ঢাকার ওপর আরো চাপ বাড়াতে পারে যার অংশ হিসাবে জিসুমিয়া এবং আকসা চুক্তি সইও রয়েছে। এ ব্যাপারে সম্মত না হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী দলের আন্দোলন এবং অন্যান্য ধরনের হস্তক্ষেপের চেষ্টা করতে পারে। রিয়ার অ্যাডমিরাল আইলিন লাউবাচার এবং ডোনাল্ড লু’র বাংলাদেশ সফরকে ওয়াশিংটনের এই আয়োজনের অংশ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ কারণে মিয়ানমারের ব্যাপারে বাংলাদেশের বিশেষ সম্পৃক্ততার চাপ বাড়ছে।

আমেরিকান এসব উদ্যোগ আয়োজনে চীন বেখবর মনে করার কোনো কারণ নেই। নতুন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফ্রিকা যাওয়ার পথে ঢাকায় হঠাৎ যাত্রাবিরতি করেন। সিপিসির আন্তর্জাতিক বিভাগের উপ-প্রধান চেন ঝু-এর নেতৃত্বে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) একটি প্রতিনিধিদলও তার সাথে বাংলাদেশ সফরে আসেন।

ভারতীয় গোয়েন্দা পরিষেবার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত সুবির লিখেছেন, ‘এটা সম্ভব যে চীনারা মার্কিন পরিকল্পনার বাতাস পেয়েছে এবং তাদের চেকমেট করতে চাইছে। তাদের বাংলাদেশে খেলার জন্য কয়েকটি কার্ড রয়েছে- বিশেষ করে মূল অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর জন্য বিশাল উন্নয়ন সহায়তা, যার অনেকগুলো এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। ঢাকা বিমানবন্দরে গভীর রাতে বৈঠকের সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন তার চীনা প্রতিপক্ষের সাথে বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন বলে জানা গেছে এবং নির্বাচনের বছরে চীনের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো ত্বরান্বিত করতে ঢাকা পরিস্থিতির সুবিধা নিতে পারে। কিন্তু চীনারা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে বাধ্য হবে শুধু যদি তারা নিশ্চিত হয় যে ঢাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের সমর্থন করার প্রলোভন প্রতিহত করবে। নির্বাচনী বছরে হাসিনা সরকারের কূটনৈতিক দক্ষতার বিশাল পরীক্ষা হবে কারণ তার দেশ বৃহত্তর চীন-মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আকৃষ্ট হওয়ার ঝুঁকি নিতে পারে।’

তাৎপর্যপূর্ণ ভারতের ভূমিকা
সুবির ভৌমিকের মতে, অনেক কিছু নির্ভর করবে ভারতের ভূমিকার ওপর এবং শেখ হাসিনাকে সাহায্য ও সমর্থনের আবেদনের প্রতি কিভাবে দিল্লি প্রতিক্রিয়া দেখাবে তার ওপর। বাংলাদেশে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের জন্য রাশিয়া যে সহায়তা করছে তার জন্য মার্কিন-নিষেধাজ্ঞাধীন একটি রাশিয়ান জাহাজ ভিড়তে দিয়ে ভারত তাকে সাহায্য করার কথা ছিল। সেটি করেনি দিল্লি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরে প্রস্তাবিত নো-ফ্লাই জোন নিয়ে এগিয়ে গেলে তা দিল্লি ও ঢাকা উভয়কেই বিপত্তির মুখে ফেলতে পারে।

বাংলাদেশে ভারতের ভূমিকা নিয়ে বিখ্যাত সাময়িকী ডিপ্লোম্যাটে একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা লিখেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও বিজ্ঞান অনুষদের ফেলো অনু আনোয়ার। তার মতে, দুই দেশের গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ঢাকা সফর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং বাংলাদেশকে নিজস্ব প্রভাব বলয়ে আনার প্রচেষ্টাকে প্রতিফলিত করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন এই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য তীব্র প্রতিযোগিতায় রয়েছে, তবে এর চূড়ান্ত সুবিধাভোগী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা চীন নয়- এটি হলো ভারত। নয়াদিল্লি নীরবে এই ভূরাজনৈতিক যুদ্ধে নিজেদের সম্পদের অপচয় না করে বেইজিং ও ওয়াশিংটনকে একে অপরের বিরুদ্ধে খেলাচ্ছে।

অনু আনোয়ার লিখেছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, ঢাকা দিল্লিকে সন্তুষ্ট করার জন্য ভারতের দাবির চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে গেছে। ভারতের এক নম্বর দাবি- উত্তর-পূর্ব বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন সমূলে উৎপাটন করা হয়েছে। সেটি করা হয়েছে, অনেকটা নয়াদিল্লির সন্তুষ্টির জন্য। বাংলাদেশ ভারতের নজরদারি রাডার হোস্ট করেছে, ভারতের দরিদ্র উত্তর-পূর্বকে মূল ভূখণ্ডের সাথে সংযোগকারী একটি অর্থনৈতিক করিডোরে প্রবেশাধিকার দিয়েছে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বাংলাদেশীদের জীবনের সব ক্ষেত্রে ভারতের প্রবেশাধিকার প্রদান করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ভারতের রেমিট্যান্সের তৃতীয় বৃহত্তম উৎস হয়ে উঠেছে, বৃহত্তর অংশে ভারতীয়দের বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানে শীর্ষ ব্যবস্থাপনার পদ গ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়েছে।

অনুর মতে, এর বিপরীতে, বাংলাদেশে চীনের প্রবেশ নতুন এবং প্রধানত শি জিনপিংয়ের স্বাক্ষরিত উদ্যোগ বিআরআই ২০১৩ সালে চালু হওয়ার পরে উদ্ভাসিত হয়েছে। চীন যদিও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে তবে, বাংলাদেশে তার সামগ্রিক প্রভাব সীমিতই রয়ে গেছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে তার বিশাল বিনিয়োগ এবং বাণিজ্যের বাইরে, বেইজিংয়ের এখনো বাংলাদেশের রাজনীতি এবং নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করার মতো উল্লেখযোগ্য সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনকে একে অপরের বিরুদ্ধে খেলাচ্ছে, আর এই খেলায় জাপান এবং রাশিয়াকেও নিয়ে এসেছে।

ডিপ্লোম্যাটের প্রতিবেদনের তাৎপর্যপূর্ণ অংশটিতে বলা হয়েছে, কমবেশি বিতর্কিত নির্বাচনের পর গত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার। এই বছরের শেষের দিকে পরবর্তী নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু নিশ্চিত হয় তার জন্য পশ্চিমা সব দেশ আওয়ামী লীগের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হওয়া সত্ত্বেও ভারত তা অনুসরণ করেনি। বরং বাইরের চাপ থেকে আওয়ামী লীগকে রক্ষার জন্য যা যা করা যায় তা করছে। ভারত জানে গণতন্ত্রের বিষয়ে বাংলাদেশের সরকারকে চাপ দিয়ে তার পক্ষ থেকে যেকোনো নিরঙ্কুশ হস্তক্ষেপ করলে নয়াদিল্লি আওয়ামী লীগের সমর্থন হারাবে। শাসক মহলে এমন একটি ধারণা তৈরি হচ্ছে যে, শুধুমাত্র ভারতই সরকারকে বাঁচাতে পারে, যার ফলে নয়াদিল্লির ওপর ঢাকার নির্ভরতা বাড়ছে। আর ভারতও জানে যত দিন আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকবে, দিল্লি যা চাইবে তার চেয়ে বেশি পাবে।

বাংলাদেশের সামনে অনেক ঝুঁকি
বাংলাদেশের অনেক বিশেষজ্ঞ কৌশলগত সঙ্ঘাতের বিষয় বিবেচনায় না এনে লু এবং আইলিনের সফর সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, ডোনাল্ড লু’র সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ইতিবাচক অগ্রগতি বয়ে আনবে। কিন্তু কয়েক দিন যেতে না যেতেই সরকারি দলের উচ্ছ্বাস থেমে গেছে।

বাংলাদেশ যদি যুক্তরাষ্ট্রকে শেষ পর্যন্ত ‘না’ করে তা হলে অনেক ফ্রন্টে ঝুঁকি আসতে পারে। বিশ্বব্যাংক আইএমএফ ডব্লিউটিও সুইফট ইত্যাদি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় আমেরিকান প্রভাবে। জাতিসঙ্ঘ এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোতেও রয়েছে একচ্ছত্র পশ্চিমা প্রভাব। বাংলাদেশের ৮০ শতাংশের বেশি পণ্য রফতানি হয় এই বলয়ে। প্রবাসীদের কর্মসংস্থানের বড় অংশ রয়েছে এসব দেশে। বৈদেশিক বাণিজ্যের রেটিং ও অন্যান্য নিয়ন্ত্রক কর্মকাণ্ডের ওপরও রয়েছে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণ। এক কথায় জ্বালানি তেল ও অন্যান্য খনিজসম্পদের বড় কোনো মজুদ না থাকায় মৌলিকভাবে বৈশ্বিক ব্যবস্থার সমন্বয়ের ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশের অর্থনীতি। এ অবস্থায় সরকার পশ্চিমের সাথে বৈরিতায় গিয়ে চীন-রাশিয়ার বলয়ে টিকতে পারবে কিনা সেই সংশয় রয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের মতো চীন-রাশিয়া বলয়ে দিল্লি অবস্থান নিলে বাংলাদেশের জন্য ঝড়-টর্নেডো মোকাবেলা কিছুটা হলেও সহজ হতে পারে। কিন্তু চীনের সাথে ভারতের যে কৌশলগত দ্বন্দ্ব তাতে যুক্তরাষ্ট্রের একেবারে বিরুদ্ধে গিয়ে বাংলাদেশে দিল্লি অবস্থান গ্রহণ করবে কিনা সেটি নিশ্চিত নয়।

অন্য দিকে পশ্চিমা বলয়ে অবস্থান নিলে (কোয়াড বা আইপিএসে যোগদান) চীনের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হবার ঘোষণা ঢাকায় চীনা রাষ্ট্রদূত আগেই দিয়েছেন যার প্রতিধ্বনি চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও করা হয়েছে। যতদূর জানা যায়, চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় এসে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন যে, বাংলাদেশের কক্সবাজার বা বঙ্গোপসাগরে যেকোনো আমেরিকান অবস্থানের সুযোগ দিলে বেইজিং তা মেনে নেবে না। একই ধরনের বার্তা ক্রেমলিন থেকেও আসার কথা জানা যাচ্ছে। এর মধ্যে সেন্টমার্টিনকে ঘিরে এক ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়েছে। চীনারা যদি কট্টর অবস্থান নেয় তাহলে আমেরিকানদের জন্য মিয়ানমারে বিমান উড্ডয়নমুক্ত অঞ্চল গঠন অথবা বাংলাদেশ অঞ্চলের মধ্য দিয়ে যেকোনো সামরিক পরিষেবা পাঠানোর বিষয়টি চীন রাশিয়ার সাথে সরাসরি সঙ্ঘাত ডেকে আনবে। আর এ ধরনের নীতি গ্রহণে সামরিক প্রতিষ্ঠানের সমর্থনের বিষয়টি এসে যাবে। সেটি অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি বিষয়। এটি বিবেচনা করে মিয়ানমারের ভেঙে পড়া অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা পরিষেবার বেতনভাতার সমর্থন চীনের পক্ষ থেকে দেয়া হয়। ভেনিজুয়েলাতেও বেইজিং একই ধরনের সমর্থন দিয়েছে বলে জানা গেছে।

তবে বাংলাদেশের মতো দেশের আমেরিকার বিপক্ষে চীন-রাশিয়া বলয়ে যাবার অর্থ হবে এক ধরনের বৈশ্বিক বিচ্ছিন্নতাকে বরণ করা। মিয়ানমার বা উত্তর কোরিয়ার মতো না হলেও কাছাকাছি এক ধরনের পরিস্থিতি এতে তৈরি হতে পারে। এ পরিস্থিতি রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে অনেক বড় বিপদে ফেলতে পারে। সম্ভবত এ কারণেই কোনো কোনো নিরাপত্তা বিশ্লেষক বাংলাদেশ যে এখন গভীর কৌশলগত বৈশ্বিক দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার মধ্যে পড়েছে সেটি উল্লেখ করেছেন। এ ব্যাপারে বিশেষভাবে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল অব: আ ল ম ফজলুর রহমান। পরিণামদর্শী নীতি বিশেষত মুক্ত নির্বাচন ও কার্যকর গণতন্ত্র চর্চা না করা হলে বাংলাদেশ বৈশ্বিক খেলোয়াড়দের দাবার ঘুঁটিতে পরিণত হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে যে গণতন্ত্র বা মানবাধিকার চর্চার কথা বলছে তা কেবলই এ দেশের মানুষের কল্যাণের ভাবনা থেকে উৎসারিত এমনটি নাও হতে পারে। যেকোনো দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন দেশটিকে চীন রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ করে তোলে। এ কারণেও বাইডেন প্রশাসন বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র চর্চা ও মানবাধিকারকে সমর্থনের নীতি নিয়েছে। সম্ভবত এজন্য ডোনাল্ড লু, বাংলাদেশে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন এগিয়ে আসার সাথে সাথে সমাবেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সরকার ও বিরোধী দলকে শান্তিপূর্ণভাবে একসাথে কাজ করার ওপর জোর দিয়েছেন।

লু সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতির উল্লেখ করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ‘সহিংসতা ও ভয়ভীতি’ ছাড়া একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন যুক্তরাষ্ট্রকে জানান যে, সরকার হিসেবে তারা একটি ‘অবাধ, সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য’ নির্বাচন চায় আর এতে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। তবে লু যে কথাটি বলেননি সেটি হলো যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে এটি করা হবে সেটি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চেয়েছে কিন্তু এর সন্তোষজনক জবাব পাননি। তিনি গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকারের বিষয়টি বলেছেন, কিন্তু প্রকাশ্য ফোরামে সুপ্ত রেখেছেন এই অঞ্চলে আমেরিকার কৌশলগত লক্ষ্যের বিষয়গুলো। সম্ভবত তিনি ঢাকায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান রহমানের বাসায় গিয়ে যে আলোচনা করেছেন সেখানে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলে নিয়েছেন। বাকি সময়ের কর্মকাণ্ড অনেকখানি ছিল আনুষ্ঠানিক বিষয়-আশয়।

mrkmmb@gmail.com