Naya Diganta

ম্যালেরিয়া থেকে দূরে থাকুন

বিশ্বব্যাপী ম্যালেরিয়া নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। বিশ্বের প্রায় ২০০ মিলিয়ন মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। মারা যায় প্রায় সাড়ে ছয় লাখ, যার বেশিরভাগই শিশু।
দেশে ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা দিন দিন কমছে। এক দশক আগেও যেখানে ৭০-৮০ হাজার জন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হতেন সেখানে এ সংখ্যা কমে ২৬ হাজারে নেমে এসেছে। মৃতের সংখ্যাও কমে এসেছে। আগে যেখানে পাঁচ শতাধিক জন মারা যেত এখন তা কমে ২০১২ সালে ১১ জন, ২০১৩ সালে ১৫ জন মারা যান। ঈর্ষণীয় এ অগ্রগতির পেছনে বিশেষ করে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবানে পরিবার প্রতি দু’টি কীটনাশকযুক্ত মশারি বিতরণ, বাড়ির কাছে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক ও সহযোগী সংস্থা এবং সরকারি মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মী ও কম্যুনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে দ্রুত রোগ নির্ণয় পদ্ধতির বহুল ব্যবহার ও পজিটিভ রোগীদের দ্রুত আর্টিমিসিনিনসহ কার্যকরী ওষুধ এসিটি (আর্টিমিথার লুমেফেনট্রিন) মুখে প্রয়োগ এবং জটিলতাসহ ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় ইনজেকশন আর্টেসুনেট ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।
মাঠপর্যায়ে প্রায় ১৩ জেলায় কীটনাশক প্রয়োগকৃত মশারি ব্যবহার করা হচ্ছে। জনগণ মশারি ব্যবহারে সুফল পেয়েছেন। গরম আবহাওয়াতে যথাযথ নিয়মে এসব মশারি ব্যবহার করার জন্য সার্বক্ষণিকভাবে জনগণকে জানানো ও উদ্বুদ্ধ করতে হবে। যদিও মশারি ব্যবহারের সুনিশ্চিত বিজ্ঞানভিত্তিক আফ্রিকার মতো তথ্য এশিয়াতে নেই। পূর্বের মতো রোগ নির্ণয়ে হাসপাতালে গিয়ে রক্তকাঁচ পরীক্ষার চেয়ে অতি সহজে বাড়ির কাছে মাঠকর্মীর কাছে র‌্যাপিড ডায়াগনোস্টিক টেস্ট (আরডিটি) পরীক্ষায় প্রজাতিসহ ম্যালেরিয়া দ্রুত নির্ণয় করে ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়ায় কো-আর্টেম প্রয়োগ ও ভাইভেক্স ম্যালেরিয়ায় তিন দিনের ক্লোরোকুইন ও ১৪ দিনের প্রাইমাকুইন দেয়া হচ্ছে। ১২১টি নতুন মাইক্রোসকোপ কেন্দ্র ও আরডিটি রোগ নির্ণয় পদ্ধতি, ম্যালেরিয়ার সব ওষুধ ও মশারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, গ্লোবাল ফান্ডের অর্থায়নে বিনা পয়সায় দিচ্ছেন। ‘এসিটি’ ও ইনজেকশন আর্টিসুনেট প্রয়োগের সিদ্ধন্তের পূর্বে প্রায়োগিক গবেষণা কাজে ‘ম্যালেরিয়া রিসার্চ গ্রুপ’ ও স্বাস্থ্য বিভাগ যৌথভাবে কাজ করে। ম্যালেরিয়ার নিম্নমুখী সংখ্যা বিষয়ে তথ্য উপাত্ত নিশ্চিত করার জন্য এরই মধ্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কয়েক হাজার বেসরকারি চিকিৎসাকর্মী ও হাসপাতাল থেকে ও তথ্য সংগ্রহ করা প্রয়োজন। এরই মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতর তা সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে।
বর্তমান ক্রম সংকুচিতসংখ্যক রোগীর মধ্যে জাতীয় ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি, ‘ম্যালেরিয়া প্রাক-নির্মূল কর্মসূচি’ গ্রহণের বিশেষজ্ঞতা যাচাই করেছে। বিশেষ করে উত্তর-পূর্বের আটটি জেলায় সীমিতসংখ্যক রোগী থাকাতে প্রাক-নির্মূল কর্মসূচি এ এলাকায় করা সম্ভব। এর জন্য মশার সামগ্রিক বিষয়ে বায়োলজিক্যাল আবশ্যিক তথ্য সংগ্রহ আবশ্যক, যার আলোকে পর্যালোচনা কর্মকাণ্ড গ্রহণ করতে হবে।
তিন পার্বত্য জেলা, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের কিছু উপজেলায় মশার তথ্য সংগ্রহ ও পর্যালোচনার পাশাপাশি উঁচু ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী চিহ্নিত করে তাদেরও প্রতিরোধ ও দ্রুত চিকিৎসার আওতাধীন আনা জরুরি।
উঁচু ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী যেমন- জুম চাষি, বাঁশ-গাছ কাটার শ্রমিক, বন বিভাগে কর্মরত কিংবা অল্প সময়ের জন্য কাজ করতে আসা লোকজন কিংবা ভ্রমণকারীদের জন্য বিভিন্নমুখী প্রতিরোধ কর্মসূচি, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার জরুরি। এখনো পার্বত্য জেলার কিছু এলাকায় রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ। এসব রোগীর জন্য মোবাইল ক্লিনিক কিংবা নিবিড়ভাবে সেবা প্রদানের জন্য মাঠ কর্মীর সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন।
এমডিজি পরবর্তী ২০১৫ সালের পরে ম্যালেরিয়াসহ সমন্বিত প্রাথমিক স্বাস্থ্য প্রদানের জন্য কম্যুনিটি ক্লিনিকসমূহ যথাযথ ও কার্যকরভাবে পরিচালনা করা প্রয়োজন। সমতল অঞ্চলে ৬০০০ জনগণের জন্য নির্ধারিত একটি কম্যুনিটি ক্লিনিকের পরিবর্তে পাহাড়ি অঞ্চলের তুলনায় কমসংখ্যক জনগণের জন্য (যেমন ২০০০-২৫০০ জনের জন্য) একটি কম্যুনিটি ক্লিনিক প্রয়োজন হতে পারে। এর জন্য প্রায়োগিক গবেষণা জরুরিভাবে প্রয়োজন। একি সাথে ম্যালেরিয়া অঞ্চলে ইউনিয়ন পর্যায়ে স্থাপিত স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের আওতাধীন স্বাস্থ্য কেন্দ্রসমুহে যথাযথভাবে সমন্বিত প্রথম স্তরের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য সরকারের আন্তরিক নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন আবশ্যিক।
অতীতের ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির তুলনায় বর্তমানে অনেক নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ আছে। জীবাণুবাহিত সাধারণ জনগণকেও অত্যন্ত সূক্ষ্ম মলিকুলার পদ্ধতির মাধ্যমে পিসিআর শনাক্তকরণ করা যেতে পারে।
আর্টিমিসিনিনের কার্যকারিতা শেষ হওয়ার পূর্বেই এসব জীবনসংহারী ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়ার জীবাণুুু ব্যাপক আকারে ধ্বংস করার জন্য এখন মাস ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রিশন নিয়ে পাইলট গবেষণা জরুরি । পরবর্তীতে সীমিতসংখ্যক রোগী হলে তাদের ব্যাপারে স্বাস্থ্য বিভাগ সহজেই ব্যবস্থা নিতে পারবে। একই সাথে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় ক্লোরোকুইনের সাথে ১৪ দিনের প্রাইমাকুইন যক্ষ্মার চিকিৎসার মতো ‘ডট্স’ পদ্ধতির মাধ্যমে চিকিৎসা গ্রহণ নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
ম্যালেরিয়া নির্মূল সম্ভব। তার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার, আর্থিক সংকুলান, অর্জিত সফলতা ধরে রাখার জন্য কর্মকাণ্ড সমূহ চালু রাখা, জনগণকে সম্পৃক্ত করে মশা নিয়ন্ত্রণ উল্লেখযোগ্য।
লেখকদ্বয় : অধ্যাপক এম এ ফয়েজ, সাবেক মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও ডা: খালিসা আফরোজ, ডেভ কেয়ার ফাউন্ডেশন, ঢাকা