Naya Diganta

ব্রাজিলের বিদায়

১০৫+১ মিনিটে ব্রাজিল শিবিরে স্বস্তি। পাকুয়েতার বাড়ানো বলে নেইমারের গোল। পেলেকে ছুয়ে ফেললেন। দীর্ঘক্ষণ থাকল না ব্রাজিলের হাসি। ১১৬ মিনিটে অরসিচের বুদ্ধিদীপ্ত মাইনাসে বাম পায়ের মাটি কামড়ানো শটে পরাস্ত অ্যালিসন। ১-১ সমতা। প্রথমবারের মতো ব্রাজিলের জালে বল জড়িয়ে অতীতের খরা কাটাল ক্রোয়েটরা। কে জানত টাইব্রেকারে রয়েছে আরো চমক। নিকোলা ভøাসিক, জোসিফ স্টানিসিচ, লুকা মদ্রিচ ও মিস্লাভ অরসিচ গোল করলেন। শুরুতে মিস করলেন রদ্রিগো, এরপর ক্যাসিমিরো ও পেদ্রোর গোলের পর মারকুইনের বল বারে লেগে ফেরত এলে ইতিহাস সৃষ্টি করল ক্রোয়েশিয়া। সেরা কম্বিনেশন নিয়ে কাতার গিয়ে হেক্সা মিশন এভাবে ধুলায় লুটাবে এটা কি ভাবতে পেরেছে ব্রাজিল। গত আসরের রানার্সআপ ক্রোয়েশিয়া যোগ্যতার ভিত্তিতেই নাম লেখাল সেমিফাইনালে। সাথে আরো একটি রেকর্ডও গড়ল লুকা মদ্রিচরা। প্রথমবারের মতো ব্রাজিলের বিপক্ষে জয়ের খাতা খুলল।
২০০২ বিশ্বকাপ জেতার পর টানা চার বিশ্বকাপে নকআউট পর্বে ব্রাজিল থামে ইউরোপের চার দলের বিপক্ষে হেরে। নেইমারের রেকর্ড ছোঁয়া গোলে মনে হচ্ছিল কেটে যাচ্ছে সেই গেরো। কিন্তু লক্ষ্যে রাখা একমাত্র শটেই গোল করে ম্যাচ টাইব্রেকারে নিয়ে গেল ক্রোয়েশিয়া। শেষ পর্যন্ত পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের বিদায় করে টানা দ্বিতীয়বারের মতো গেল সেমিফাইনালে। নির্ধারিত সময়ে ছিল গোলশূন্য সমতা। ১০৬তম মিনিটে ব্রাজিলকে এগিয়ে নেন নেইমার। ব্রুনো পেতকোভিচের গোলে টানা দ্বিতীয় ম্যাচ টাইব্রেকারে নেয় ক্রোয়েশিয়া। সেখানে ৪-২ গোলে জায়গা করে নেয় শেষ চারে।
১৬ মে, ১৯৬২। ওয়েলসের বিপক্ষে প্রীতিম্যাচে জোড়া গোল করেন পেলে। সেই জোড়া গোলে পেলে ব্রাজিলের সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ড গড়েন। ব্রাজিলের কিংবদন্তি আদেমির মেনেজেসের গোলের রেকর্ড ভেঙে দেন পেলে। ১৯৫০ বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতা আদেমির মেনেজেস ব্রাজিলের হয়ে গোল করেছিলেন ৩৩টি। পেলে যখন আদেমির মেনেজেসের রেকর্ড ভাঙেন, তখন ব্রাজিলের হয়ে আদেমিরের গোল ধরা হতো ৩২টি। তবে সম্প্রতি ফিফা নিশ্চিত করেছে, আদেমিরের গোলসংখ্যা ৩৩। নেইমারে গোল ৭৬। পেলের ছিল ৭৭টি। গতকাল তাকে ছুঁয়ে ফেললেন নেইমার।
পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এর আগে চারবার মোকাবেলা করেছে ক্রোয়েশিয়াকে। একবারও ক্রোয়েটরা হারাতে পারেনি সেলেসাওদের। তিনটি ম্যাচে জিতেছে ব্রাজিল, একটি হয়েছে ড্র। বিশ্বকাপে এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো মুখোমুখি হয়েছে দুই দল। এর আগে দুইবারই জয়ী দলের নাম ব্রাজিল। ২০০৬ বিশ্বকাপে তারা ক্রোয়েটদের হারিয়েছিল ১-০ গোলে, এরপর ২০১৪ বিশ্বকাপে উড়িয়ে দেয় ৩-১ ব্যবধানে। সবশেষ দেখা হয়েছিল ২০১৮ সালে প্রীতিম্যাচে। ওই ম্যাচেও ব্রাজিলের কাছে ২-০ গোলে হারেন লুকা মদ্রিচরা। মজার বিষয় হলো ৬ বিশ্বকাপ খেলা ক্রোয়েশিয়া ৫ বারই এক্সট্রা টাইমে খেলা নিয়ে গেছে। শুধুমাত্র ২০১৮ ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে নির্ধারিত সময়ে খেলা শেষ হয়েছে। এবারো অতিরিক্ত সময়ে ভাগ্য সুপ্রসন্ন ক্রোয়েশিয়ার।
কোনো পরিবর্তন ছাড়াই ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে শেষ আটের ম্যাচে মাঠে নেমেছে ব্রাজিল। নকআউট পর্বের প্রথম ধাপে দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে অসাধারণ ফুটবল উপহার দেয়া একাদশের ওপরই আস্থা রেখেছেন ব্রাজিল কোচ তিতে। অন্য দিকে ক্রোয়েশিয়া দলে দু’টি বদল এনেছেন কোচ জলাতকো দালিচ।
আল রাইয়ান স্টেডিয়ামে প্রথমার্ধে ব্রাজিল তাদের সেই চিরচেনা রূপ দেখাতে পারেনি। ছিল না ছন্দ এবং সঙ্ঘবদ্ধ আক্রমণ। আগ্রাসী ফুটবলের কিছুই দেখতে পারেনি কোটি কোটি ভক্তরা। বরং অনেকটাই এলোমেলো ফুটবল খেলেছে। পাসিং টেকনিক ট্যাকটিস এককথায় সবদিক থেকেই পিছিয়ে ছিল ক্রোয়েশিয়ার চেয়ে। বিপরীতে ক্রোয়েশিয়া বারবার আক্রমণের চেষ্টা করেও ব্রাজিলের দুর্ধর্ষ ডিফেন্স ভাঙতে পারেনি।
পঞ্চম মিনিটে গোলের জন্য প্রথম শট নেয় ব্রাজিল। ভিনিসিয়াস জুনিয়রের শট সহজেই ঠেকান ক্রোয়েট গোলরক্ষক দমিনিক লিভাকভিচ। ১৩ মিনিটে নিজেদের প্রথম ভালো সুযোগ পায় ক্রোয়েশিয়া। বল পায়ে নিজেদের অর্ধ থেকে প্রায় ডিবক্স পর্যন্ত চলে যান ইয়োসিপ ইউরানোভিচ। কিন্তু বক্সের ভেতর বল পেয়েও মিলিতাওকে কাটিয়ে শট নিতে পারেননি ইভান পেরিসিচ।
২০তম মিনিটে পেনাল্টি স্পটের কাছে ভিনিসিয়সের শট ব্লক করেন বোর্না সোসা। কয়েক সেকেন্ড পর নেইমারের দুর্বল শট ঠেকিয়ে দেন ক্রোয়েট গোলকিপার। ২৭তম মিনিটে নেইমারের নেয়া ফ্রিকিকটি ছোট ডি সীমানায় ধরতে ব্যর্থ হন ভিনিসিয়াস। ৩০তম মিনিটে পেরিসিচের দূরপাল্লার শট যায় ক্রসবারের অনেক ওপর দিয়ে। ৪২তম মিনিটে সুবিধাজনক জায়গায় ফ্রি কিক পায় ব্রাজিল। কিন্তু গোলরক্ষক বরাবর শট নিয়ে হতাশ করেন নেইমার। ল্যাতিন ও ইউরোপের এমন মহারণে প্রথমার্ধে গোল করতে পারেনি কোনো দল।
ব্রাজিল ও ক্রোয়েশিয়া ম্যাচে প্রায় সমান পজিশন নিয়ে খেলেছে। ব্রাজিল গোলের লক্ষ্যে তিনটি শট নিলেও তা ক্রোয়েট গোলরক্ষককে পরীক্ষায় ফেলতে পারেনি। অন্য দিকে ক্রোয়েশিয়া গোলে শট নিতে না পারলেও তিনটি ভালো সুযোগ তৈরি করেছিল, যা থেকে একটি গোল হওয়ার ভালো সুযোগ ছিল। অগোছালো ব্রাজিলের সামনে গোছালো ক্রোয়েটরা থাকলেও গোলশূন্য ড্রতে শেষ হয় প্রথমার্ধ।
৬৬ মিনিটে পাকুয়েতার শট গোললাইন অতিক্রমের আগেই উড়ে এসে কর্নারের বিনিময়ে রক্ষা করেন মিডফিল্ডার লিভাকোভিচ। ৭৯ মিনিটে দু’জনকে ডজ দিয়ে মারকুইসের মাটি কামড়ানো শট সরাসরি ক্রোয়েট কিপারের কোলে। ৮৬ মিনিটে মিলিতানোর বুদ্ধিদীপ্ত শট ডান পোস্টের ইঞ্চিখানেক দূর দিয়ে বেরিয়ে যায়। দ্বিতীয়ার্ধে বারবার আক্রমণ করেও গোলবঞ্চিত ছিল নেইমার বাহিনী।
ক্রোয়েট গোলরক্ষক ১০টি দারুণ সেভ করেন। টাইব্রেকারেও একটি সেভ করেন।