Naya Diganta

মা

সংসারের শত ঝামেলা উপেক্ষা করে মেরিনা মাকে দেখতে যাবে বলে তড়িঘড়ি রওনা হয়। মেরিনা কলাবাগানে থাকে। তার মায়ের বাড়ি মিরপুরে। গাড়ি থাকলে এই দূরত্ব তেমন কোনো ব্যাপার নয়। মেরিনার গাড়ি আছে। তাতে কী ! স্বামী আর শাশুড়ির কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে যে সামান্য সময় সে হাতে পায়, তা পথের জ্যামেই শেষ হয়ে যায়। মায়ের কাছে খুব অল্প সময়ই সে বসতে পারে। এই নিয়ে মায়ের মনে অনেক হাহাকার আর কষ্ট। মেরিনাকে দেখে মায়ের আনন্দ আর ধরে না। মা যেন আকাশের চাঁদ দেখতে পান। নিজের অসুস্থতার কথা ভুলে গিয়ে কন্যাকে কী খাওয়াবেন তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
মেরিনার বাবা নেই। তারা দুই বোন। ছোটবোন এরিনা ডিভোর্সি। দুটো বাচ্চা নিয়ে মায়ের ফ্ল্যাটেই থাকে। মায়ের অসুস্থতার সুযোগে এরিনা মাকে ফুসলিয়ে সব সম্পত্তি দুই বোনের নামে লিখিয়ে নিয়েছে। মায়ের সরল মন। মা ছোট কন্যার প্রলোভনে পড়ে যান। সব সম্পত্তি দুই কন্যাকে সমান ভাগে ভাগ করে দেন। কিন্তু এরিনা এমন ভাগ মানতে নারাজ। সে চায়, মা তাকে বেশি দেবে। কিন্তু মা তা করেননি। মা নিজের ইনসাফ ঠিক রেখেছেন। সব সম্পত্তি সমান দুই ভাগে ভাগ করে রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন। মা তাই এরিনার চক্ষুশূল হয়ে যান। অসুস্থ মায়ের সেবাযতœ করা তো দূরের কথা, মায়ের খাওয়া-দাওয়ারও খোঁজ খবর নেয় না এরিনা। বরং নিজের রুমের দরোজা বন্ধ করে কেএফসির চিকেন ফ্রাই, ফকরুদ্দিনের মোরগ পোলাও বাচ্চাদের নিয়ে খায়। বাচ্চাদের স্কুল ছুটির পর এসব খাবার নিয়ে এরিনা বাড়ি ফেরে। সে বাসায় রান্নাবান্না করে না। বাবার বাড়ি ভাড়ার টাকায় দিব্বি শুয়ে বসে খায়। বাচ্চাদের নিয়ে ফাস্টফুড রিচফুড খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করে। মা রান্নাঘরে গিয়ে খাবার খোঁজেন। কোথাও মায়ের জন্য কোনো খাবার রাখা নেই। মা এদিক ওদিক তাকাতেই দেখেন, ময়লার বিনে শুধু মুরগির ঠ্যাং আর ঠ্যাং। ঘরে খাওয়ার কিছু না থাকায় মা একটি পেয়ালায় মুড়ি নিয়ে সরষের তেল দিয়ে মেখে খান। মুড়ি খেয়ে আর কয়দিন থাকা যায়। ফলে ক্রমশ মায়ের শরীর আরো খারাপ হতে থাকে। মাঝে মাঝে গভীর রাতে এরিনা কী মনে করে যেন মায়ের শিয়রের কাছে এসে দাঁড়ায়। মা তখন চমকে ওঠেন। এত রাতে শিয়রের কাছে এরিনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয় পান মা। মনে হয় এরিনা এই বুঝি গলা টিপে ধরবে তার। কারণ প্রায়ই ঝগড়া করে এরিনা মাকে ধিক্কার দিয়ে বলে,

-আশি বছরের বুড়ি, বুড়ি মরে না। দুনিয়াতে এত মানুষ মরে। তুই মরতে পারিস না ? আজরাইল তোকে চোখে দেখে না? এই কথা থেকেই মা বুঝতে পারেন, সে যে মায়ের মৃত্যু কায়মনোবাক্যে কামনা করে। একদিন এরিনা একটি গ্লাসে পড়াপানির কথা বলে সেই পানি একরকম জোর করে মাকে খাওয়ায়। মা একটু খেয়ে আর খেতে পারেন না। তেতো লাগে। মা মুখ ফিরিয়ে নেন। সেদিন থেকে এরিনার ওপর থেকে মায়ের বিশ্বাস উঠে গেছে। পানি খেতে না চাওয়ায় সে মায়ের সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করে। আর পানির গ্লাসটি শোকেসে তালা দিয়ে রাখে। মা আতঙ্কে থাকেন না জানি ওই পানি আবার কখন খাওয়াতে আসে। মা মারা গেলে এই ফ্ল্যাটটি সে একাই ভোগ করতে পারবে। এই ভাবনা থেকেই সে মায়ের মৃত্যু কামনা করে। সম্পত্তি নিয়ে ঝগড়া করে কয়েকবার সে মাকে প্রহারও করেছে। লোকে শুনলে মেয়েকে খারাপ বলবে মা তাই এ কথা কারো কাছে প্রকাশ করেননি। তবে একবার শুধু মার খেয়ে মা মেরিনার বাসায় চলে গিয়েছিলেন। তখন মেরিনা ব্যাপারটা জেনেছে। মেরিনার মায়ের বিশ্বাস ছিল, সম্পত্তি পেয়ে গেলে ছেলেরা বাবা-মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার করে। মেয়েরা হয়তো করে না। কিন্তু মায়ের সেই ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। মেয়েরাও যে সম্পত্তি একবার পেয়ে গেলে এভাবে বদলে যেতে পারে, এটা মায়ের জানা ছিল না। মা তাই কাঁদতে কাঁদতে মেরিনাকে বলেছিল, কোনো বাবা মা যেন তার মতো ভুল না করে। অর্থাৎ জীবিতাবস্থায় সন্তানদের সম্পত্তি লিখে না দেয়। যদি সম্পত্তি লিখে দিতেই হয় তবে যেন উইল করে দেয় এবং উইল করতে হবে এই শর্তে যে, যার সম্পত্তি তার মৃত্যুর পরে সব পাবে।

মা মেরিনার বাসায় যাওয়ার পর মেরিনা মায়ের সেবা যতেœ কোনো ত্রুটি করেনি। মেরিনার বাসায় যাওয়ার পর মা কয়েক দিন শুধু পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। মায়ের চেহারার একহারা দুঃখীভাবটা মুছে দিতে অরিন্দম চেষ্টা করেছে মেরিনা। পুরোপুরি না পারলেও কিছুটা যেন সে পেরেছে। ঘড়ি ধরে তিনবেলা ঠিক সময়মতো মায়ের খাবার দিয়েছে। চুল বেঁধে দিয়েছে। মা মেহেদি পরতে ভালোবাসেন। মেরিনা তাই মাকে মেহেদি পরিয়ে দিয়েছে। শুধু মায়ের মুখে একটু হাসি ফোটানোর জন্য মেরিনা মাকে সময় দিয়েছে। মায়ের সাথে গল্প করেছে। মা তার সব দুঃখের কথা মেরিনার কাছে বলে যেন খালাস হতেন। মায়ের কষ্টের কথাগুলো শুনে মেরিনা মায়ের মুখের পানে তাকিয়ে থাকত আর ওর চোখের কোণে জ্বলজ্বল করত অশ্রুকণা। মা তখন বলতেন, এই যে তুমি আমার জন্য যা করছ তার প্রতিদান তুমি আল্লাহ পাকের কাছে পাবে। মা একদিন মেরিনাকে বলেছিল,
- মা, আমার একা থাকতে খুব ভয় করে। আমার টাকা-পয়সা যা কিছু আছে সব কিছু নিয়ে আমি না হয় তোমার কাছে চলে আসি। তুমি রাখবে আমাকে? মেরিনা মাকে হ্যাঁ না কিছুই বলতে পারেনি। শুধু করুণ নয়নে মায়ের মুখপানে চেয়ে থেকেছে। কারণ সে-ই তো একজন নির্যাতিত নারী। সে আবার নিজের মাকে রাখবে কিভাবে? স্বামীর কাছে মাকে রাখার অনুমতি চেয়েও পায়নি। হয়তো স্বামী তার মা আর পরিবারের ভয়ে অনুমতি দেয়নি। মাকে নিজের কাছে রাখতে না পারার দুঃখ বুকে পুষে মেরিনা এক সপ্তাহ পর মাকে আবার বাসায় দিয়ে আসে। এবার সে লুকিয়ে মায়ের সাথে একটি মোবাইল ফোন কিনে দেয়। আর মাকে বলে,

- মা, এটা আপনার কাছে রাখবেন। যখন খারাপ লাগবে আমার সাথে কথা বলবেন।
ও বাড়িতে মাকে রেখে মেরিনা যখন চলে আসছিল তখন তার মনে হচ্ছিল সে যেন যমদূতের কাছে মাকে রেখে এসেছে।
কয়েক দিন পর মেরিনা মায়ের সেবাযতেœর জন্য একজন গৃহকর্মী দিয়ে আসে। এতে করে মেরিনা কিছুটা স্বস্তিবোধ করে। কারণ মা এখন যেমন সেবা পাবেন তেমনি একাকিত্বও ঘুচবে। আজকাল একটি ফ্ল্যাটে একা একজন গৃহকর্মীকে নিয়ে থাকাও বিপজ্জনক। এরিনা রোজ সকালে দুই বাচ্চা নিয়ে স্কুলে চলে যায়। মা তখন একা থাকেন। পৃথিবীতে একাকিত্বের মতো কষ্ট আর নেই। একাকিত্বের যন্ত্রণা যে কী তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না। মেরিনার খুব ইচ্ছে হয় মাকে নিজের কাছে এনে রাখতে। কিন্তু স্বামী আর শাশুড়ির জন্য পারে না। মেরিনার শাশুড়ি প্রায়ই কথায় কথায় মেরিনাকে বলে, মানুষ মেয়ের বাড়িতে থাকে কী করে ! মেয়ের বাড়িতে থাকা শরমের কথা। এ কথা তিনি মুখে বললেও নিজে ঠিকই কন্যাদের বাড়িতে মাসের পর মাস বেড়ান। মেরিনা শাশুড়ির ইঙ্গিতপূর্ণ কথা ঠিকই বুঝতে পারে। বুঝতে পেরেও না বুঝার ভান করে। মাকে নিজের কাছে এনে রাখার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তাই পারে না। তাইতো সেদিন সে মাকে কোনো উত্তর দিতে পারেনি। একজন ছেলে এবং একজন মেয়ের মধ্যে পার্থক্য এখানেই। ছেলেরা ইচ্ছে হলেই দাপটের সাথে নিজের মাকে কাছে এনে রাখতে পারে। কিন্তু মেয়েরা তা পারে না। স্বামী ভদ্রলোক মুখে যতই মিষ্টি কথাই বলুক না কেন আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয় এসব বাড়তি ঝামেলা তার পছন্দ নয়।
অনেক দিন পর মেরিনা আজ মাকে দেখতে যাচ্ছে। মা মিষ্টি খেতে পছন্দ করেন। মেরিনা তাই পথে একটি মিষ্টির দোকানে নামে। অমনি এক অশীতিপর ভিক্ষুক মেরিনার পিছু নেয়। তবে মিষ্টির দোকানে ভয়ে সে প্রবেশ করে না। দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে ঘ্যান ঘ্যান সুরে বলে,

-আফা, আমারে একটা মিষ্টি দে।
দোকানি কাস্টমারের অসুবিধার কথা চিন্তা করে কুত্তা খেদানোর মতো দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় ভিক্ষুককে। ভিক্ষুক ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে খানিকটা দূরে সরে দাঁড়ায়। কিন্তু ওর লোভাতুর দৃষ্টি পড়ে থাকে শোকেসের থরে থরে সাজানো মিষ্টিগুলোর দিকে। ওদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে খানিকক্ষণ পর আবার সে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। মেরিনা মিষ্টি কিনে দোকান থেকে বের হলে এবার সে মেরিনার পিঠে আলতো করে স্পর্শ করে বলে,
-আফা, একটা মিষ্টি আমারে দে। গায়ে হাত দেয়াতে মেরিনা বিরক্ত হয়। ঘাড় বাঁকিয়ে ভিক্ষুকের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে। ভিক্ষুকটি যেন তার অনেক দিনের চেনা। মেরিনার তখন মনে পড়ে যায়, এ তো সেই লিলির মা। যে ছোটবেলায় তাদের বাড়িতে ঠিকা ঝিয়ের কাজ করত। মেরিনা মনে মনে বলে, লিলির মা এখনো বেঁচে আছে! মেরিনা ভিক্ষুককে চিনতে পেরেও সময়স্বল্পতার জন্য তড়িঘড়ি করে গাড়িতে উঠে পড়ে। কারণ এখানে দেরি হলে মাকে সে সময় দিতে পারবে না। বাসায় ফিরে তাকে কৈফিয়ত দিতে হবে। ভিক্ষুকের কথায় তাই সে বিরক্তবোধ করে। ভিক্ষুক তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
- একটা মিষ্টি আমারে দিলি না আফা।
মেরিনা বাসায় গিয়ে মাকে মিষ্টি খাওয়ায়। ভিক্ষুকের কথা মাকে বলে না। মেরিনা জানে, ভিক্ষুকের কথা বললে মা এই মিষ্টি খাবেন না।
দুদিন পর মেরিনা টিভিতে নিউজ দেখে চমকে ওঠে। কলাবাগানে গৃহকর্ত্রীকে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে খুন করে পালিয়েছে গৃহকর্মী। মায়ের ছবি দেখে শরবিদ্ধ পাখির মতো লুটিয়ে কাঁদে মেরিনা।