Naya Diganta

১০ ডিসেম্বর কী হবে

আজ ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসের ৭ তারিখ। যখন নিবন্ধটি লিখছি তখন বারবার কেবল নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বলতা এবং জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কথা মনে আসছে। কারণ শিরোনামের বিষয়বস্তু থেকে মাত্র তিন দিন আগেও আমি স্পষ্ট করে বলতে পারছি না, ১০ ডিসেম্বর বিএনপি রাজধানীর রাজপথে কী চমক দেখাতে যাচ্ছে। অথবা আওয়ামী লীগের পরিণতি-নিয়তি অথবা তাদের বাড়াবাড়ি ঘটনার ওই দিন কোন পর্যায়ে থাকবে। আমরা সবাই যার যার অবস্থান থেকে অনুমান করছি এবং নিজেদের বোধ-বুদ্ধি-আশা-আকাক্সক্ষা অনুযায়ী কিছু একটা কল্পনা করছি। কিন্তু এই মুহূর্তে সারা বাংলাদেশে এমন কাউকে দেখছি না যিনি শত ভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারেন যে, ১০ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের পতন হবে কিংবা পতনের ধারার সূত্রপাত হবে।

মানুষের চিন্তার দুর্বলতা এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অজ্ঞানতার কথা স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন। তিনি বলেন, তোমাদেরকে খুবই সামান্য জ্ঞান দেয়া হয়েছে। তো আল্লাহর দেয়া সেই সামান্য জ্ঞান নিয়ে আওয়ামী লীগ কেন ১০ ডিসেম্বরের বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ নিয়ে এত পেরেশানি দেখাচ্ছে এবং একটি সাধারণ ঘটনাকে টেনে-হিঁচড়ে অসাধারণ বানিয়ে ফেলেছে এবং দেশ-বিদেশের সব পক্ষকে কেন চিৎকার করে জানিয়ে দিচ্ছে, ১০ ডিসেম্বর ওটা হবে এবং ওটা হতে দেয়া হবে না। ফলে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সম্মেলনের তারিখটি দেশ ছাড়িয়ে দিল্লি-লন্ডন-ওয়াশিংটন পর্যন্ত আলোচনার ঝড় তুলেছে। আওয়ামী লীগের চিৎকারের কারণে আমরা এখন জানতে পারছি এবং অনেকে মনে করতে পারছি যে, দিনটি হলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস এবং ওই দিনটিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল।

আওয়ামী উত্তেজনা এবং সরকারি বাহিনীগুলোর দৌড়ঝাঁপ দেখে মনে হচ্ছে, ১০ ডিসেম্বর ভয়ঙ্কর কিছু ঘটবে। তারা বিএনপিকে উদ্দেশ করে হুমকি ধমকি দিয়ে চলছে সমানতালে এবং সেই তালের সাথে তালমিলিয়ে গায়েবি মামলা এবং সারা দেশে ধর-পাকড়ের যে নাটক করছে তার উত্তেজনা বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনা বনাম ব্রাজিলের ফুটবল খেলার উত্তেজনাকে হার মানিয়ে চলেছে। ফলে ১০ ডিসেম্বর নিয়ে পুলিশের ভূমিকা প্রেক্ষাপটকে কল্পনা করে নতুন স্যাঙ্কশনের বা নিষেধাজ্ঞার গুজব ক্রমেই ডালপালা বিস্তার করছে। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৪টি দেশের রাষ্ট্রদূতরা ১০ ডিসেম্বরের বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও শান্তিপূর্ণ করার স্বার্থে নির্বাচনী প্রক্রিয়া অর্থাৎ সভা সমিতি সমাবেশ, সরকারি বাহিনীর কর্মকাণ্ড, সরকারি দলের আচরণসহ রাষ্ট্রের সব সংস্থাকে আন্তর্জাতিক সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার যে চেতনা রয়েছে তার আলোকে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়েছে।

রাষ্ট্রদূতদের উল্লেখিত ঘোষণা, অনড় অবস্থান এবং পরোক্ষভাবে না বলা হুমকির প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দল নড়েচড়ে বসেছে। ইতঃপূর্বে আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম সমাবেশ এবং ঢাকায় ছাত্রলীগের সমাবেশে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার আক্রমণাত্মক কথাবার্তার কারণে আওয়ামী লীগের লোকজন এবং তাদের তাঁবেদার প্রশাসনিক কর্মচারীরা সেভাবে যুদ্ধংদেহী ভাব নিয়েছিল তাতে বিএনপি কিছুুটা হলেও ভড়কে গিয়েছিল। তারা ঢাকা মহানগর পুলিশের সদর দফতরে যায় এবং আলাপ-আলোচনায় নমনীয় ভাব দেখায়। তারা যখন সেখান থেকে বের হয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন তাদের অভিব্যক্তিতে স্পষ্টই হতাশা ফুটে উঠেছিল। কিন্তু রাষ্ট্রদূতদের বিবৃতির পর তারা চাঙ্গা হয়ে ওঠেন এবং তাদের সাবেকী আত্মবিশ্বাস নিয়ে গতকাল অর্থাৎ ৬ ডিসেম্বর যা কিনা বাংলাদেশে স্বৈরাচার পতন দিবস হিসেবে পরিচিত সেই দিন পুরো ১৮০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ফিরে গিয়ে ঘোষণা দেয় যে, নয়াপল্টন বিএনপি অফিসের সামনেই জনসভা হবে।

৬ ডিসেম্বর তারিখে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে জনাব কাদেরের বক্তব্য শুনে সবার ভিরমি খাওয়ার মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়। তিনি গলার সুর গত ৩-৪ দিনের তুলনায় অবিশ্বাস্য নরম করে ফেলেন। প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তার মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও জড়তা লক্ষ করা যায় এবং তাকে দেখে মনে হয়, তিনি হতাশ-বিপর্যস্ত এবং দিকভ্রান্ত। ১০ ডিসেম্বর কী হবে এমনতর প্রশ্নে তিনি বলেন, দিনটি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছুই নেই এবং তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, সমাবেশস্থল নিয়ে বিএনপির সঙ্গে যে বিবাদ চলছে তা অবশ্যই সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হবে!

আমি যখন নিবন্ধটি লিখছি তখন ডিসেম্বর মাসের ৭ তারিখের দুপুর বেলা অতিক্রম করছে। আজকের এই ক্ষণটি পর্যন্ত ১০ ডিসেম্বর সম্পর্কে যা কিছু ঘটেছে তার একটি সংক্ষিপ্ত রূপ উপরে বর্ণিত হয়েছে। আমার নিবন্ধটি সাধারণত প্রতি শুক্রবার প্রকাশিত হয় এবং সেই হিসাবে এটি প্রকাশ কাল ৯ ডিসেম্বর। সুতরাং পাঠকবৃন্দ যখন পড়বেন তখন তাদের সামনে থাকবে পুরো একটি দিন এবং একটি রাত্রি- আর আমি যখন লিখছি তখন আমার সামনে রয়েছে পুরো তিনটি রাত্রি এবং আড়ইটি দিন। সুতরাং মানুষের জ্ঞানবুদ্ধির সীমাবদ্ধতাজনিত জটিলতার জন্য আমার পক্ষে নির্ভুলভাবে বলা অসম্ভব যে, ১০ ডিসেম্বর আসলে কী ঘটবে। তবে আল্লাহ মানুষের মধ্যে যে দার্শনিকতা, অঙ্ক কষার ক্ষমতা এবং পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনান্তে অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছার ক্ষমতা দিয়েছেন যা যুক্তিবিজ্ঞানের ভাষায় অনুমান নির্ভর অনুসিদ্ধান্ত বলে পরিচিত তা ব্যবহার করে ১০ ডিসেম্বর সম্পর্কে আমার পর্যবেক্ষণ পেশ করছি-

প্রথমত, ১০ ডিসেম্বর যাই ঘটুক না কেন তা আওয়ামী লীগের জন্য গলার কাঁটা কিংবা বিষফোঁড়ার চেয়েও যন্ত্রণাদায়ক হবে। যদি তারা বাড়াবাড়ি করে তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের পথ আরো রুদ্ধ হয়ে যাবে। আর যদি বিএনপির দখলে রাজপথ চলে যায় তবে রাজনীতির উল্টো হাওয়ায় আওয়ামী লীগের নৌকার পাল পতপত করে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হতে থাকবে।

দ্বিতীয়ত, বিএনপি যদি পল্টন এলাকায় সমাবেশ করতে পারে তবে দলীয় নেতাদের কর্তৃত্ব বাড়বে। এমনকি দলের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে সরকারের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগ রয়েছে তারাও শক্তিশালী হয়ে পড়বে। অন্য দিকে ১১ তারিখ থেকে আওয়ামী লীগ যদি তাদের গায়েবি মামলার কুদরত দেখাতে আরম্ভ করে এবং ঢাকা ও বড় বড় শহর বাদ দিয়ে কেবল গ্রামগঞ্জে তৎপরতা আরম্ভ করে তবে বিএনপির মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি হবে। অন্য দিকে, যদি আওয়ামী লীগ বিএনপির বড় বড় নেতাকে টার্গেট করে তবে বিএনপি লাভবান হবে।

বিএনপির সবচেয়ে বেশি লাভ হবে যদি আওয়ামী লীগ নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় অফিস অথবা বিএনপির পছন্দের জায়গায় সমাবেশ করতে বাধা দেয়। সে ক্ষেত্রে ঢাকা শহরের শত শত স্পটে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়বে এবং প্রকৃতিগতভাবে প্রতিটি স্পটে ৪-৫ জন নতুন নেতা ঘটনার দিন তৈরি হয়ে যাবে যাদের সবাই হবে সাহসী এবং আত্মত্যাগী। পরিস্থিতির কারণে সৃষ্টি হওয়া নতুন নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের জন্য ভয়ঙ্কর ফিউশন হয়ে উঠবে। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় লোকজন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলেও পরিস্থিতির কারণে অথবা কৌতূহলবশত তারা রাস্তায় নেমে আসবে।

বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের জন্য শুক্রবার দিনটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হবে। সরকারের বেশির ভাগ শক্তি যদি বিএনপির অফিসসমূহ, ঢাকার প্রবেশপথসমূহ এবং আওয়ামী লীগের অফিস মন্ত্রীপাড়া ও ভিআইপি প্রটোকলে ব্যস্ত থাকে তখন বাদ জুমা যদি ইসলামপন্থীরা মিছিল বের করে তবে তা সামাল দেয়া অসম্ভব। ইসলামপন্থীদের শুক্রবারের যেকোনো কর্ম-পরবর্তী দিন অর্থাৎ ১০ ডিসেম্বরের বিএনপির সমাবেশ বেগবান করে তুলবে। অন্য দিকে ইসলামপন্থীদের পাহারা দিতে গেলে বিএনপির নেতাকর্মীরা যদি বসে যায় তবে তারা নিজ ইচ্ছায় সরে না গেলে অথবা শাপলা চত্বরের হেফাজতের পরিণতি না ঘটালে সরকারের উপায় থাকবে না।

তৃতীয়ত, বিএনপি যদি একটি নির্দিষ্ট স্থানে জড়ো হয় তবে পরিস্থিতি হবে শান্তিপূর্ণ এবং ৪৮ ঘণ্টা পর তাদের জড়ো হওয়ার ক্ষমতা হ্রাস পাবে। কিন্তু তারা যদি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে জড়ো হয় এবং নির্দিষ্ট টার্গেটের দিকে এগোতে থাকে তবে সঙ্ঘাতের আশঙ্কা বেড়ে যাবে। এ অবস্থায় ইন্টারনেট বিদ্যুৎ ইত্যাদি নিয়ে লুকোচুরি করলে বহু গুজব ডালপালা বিস্তার করবে এবং পরিস্থিতির ওপর কারো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।

চতুর্থত, ১০ ডিসেম্বর যথারীতি সূর্য উদিত হবে কিন্তু কাকডাকা ভোরে কোনো পথচারী রাজধানীর বুকে অন্যান্য দিনের মতো নির্ভয়ে হাঁটবে না। একই দিন সূর্য অস্ত যাওয়ার পর পুরো শহরে থাকবে থমথমে ভাব। নিউমার্কেট, গাউসিয়া, সায়েদাবাদ, মোহাম্মদপুর-গুলিস্তান প্রভৃতি এলাকার দোকানপাট শপিংমলের মালিক কর্মচারীরা এই অদ্ভুত মন্দা উপভোগ করতে গিয়ে ক্ষণে ক্ষণে শিহরিত হতে থাকবেন। পত্রিকা অফিসগুলো সে দিন নিদারুণ ব্যস্ত হয়ে পড়বে এবং সমাজে সাংবাদিকদের কদর বাড়বে। আওয়ামী সমর্থক তাঁবেদাররা রাস্তায় নামবে না এবং সদর রাস্তার বাড়িঘরের জানালা দিয়ে নারী শিশু বালক বালিকারা বারবার উঁকিঝুঁকি দেবে। টেলিভিশনের পর্দা এবং রিমোটগুলো গরম হয়ে যাবে এবং সামাজিক মাধ্যমগুলোতে খোঁচাখুঁচি চরমে পৌঁছাবে।

পঞ্চমত, পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতরা বৈঠকে বসবেন। ভারতের রাষ্ট্রদূতও বাইরে বের হবেন। রাষ্ট্রের স্পর্শকাতর ইউনিটগুলো সতর্ক অবস্থানে থাকবে। অন্য দিকে, পুলিশের জন্য দিনটি হবে রোজ কিয়ামতের আলামতের মতো। তারা ঘটনার দিন কাউকে তেমন একটা চিনতে পারবে না। প্রচণ্ড অস্থিরতা নিয়ে তারা ছুটোছুটি করবে এবং ক্ষণে ক্ষণে পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য চেষ্টা করতে গিয়ে মন্ত্রণাদাতাদের মন্ত্রণা ভুলে যাবে।

ষষ্ঠত, সারা দেশে সন্ধ্যার পর মিছিল হবে। তবে সেটা আওয়ামী লীগ করবে নাকি বিএনপি করবে তা দেখার ভার দেশবাসীর ওপর ছেড়ে দিয়ে আজকের নিবন্ধ শেষ করলাম।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য