Naya Diganta

প্রতীচ্যবাদ ও চৈন্তিক পুনর্গঠন

পণ্ডিতি অধ্যয়ন ও আলাপের বিষয় হিসেবে প্রতীচ্যবাদ এমন এক ক্ষেত্র, যাকে উপেক্ষা করা চলে না। পশ্চিমা দুনিয়াকে বোঝা ও উপস্থাপন করার পদ্ধতিগত প্রস্তাবনা আছে প্রতীচ্যবাদে, আছে নিজস্ব বয়ান ও মেজাজ। প্রতীচ্যবাদ মূলত প্রাচ্যবাদের বিপরীতে প্রাচ্যের মননের একটি প্রতিক্রিয়া। এ ধারায় অ-পশ্চিমা বুদ্ধিজীবী; নৃতত্ত্ববিদ, সমাজবিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ, ধর্মীয় পণ্ডিত, শিল্পী, সাধারণ জনগণ পশ্চিমকে উপলব্ধি করে ও উপস্থাপন করে। পাশ্চাত্য সম্পর্কিত শিক্ষকতা, রচনা ও গবেষণাকর্ম প্রতীচ্যবাদের আওতায় পড়ে। প্রতীচ্যবাদের আবেদন ও অনুপ্রেরণায় পশ্চিমা দুনিয়ার ভেতরে ও বাইরে তৈরি হচ্ছে ক্রমবর্ধমান সাহিত্যসম্ভার। এ ধারার জ্ঞানকর্মের মধ্য দিয়ে অঙ্কিত হচ্ছে পশ্চিমা মন ও আচরণের বিচিত্র ইমেজ, যার আছে বহুমাত্রিক আবেদন। কারণ প্রতীচ্যবাদের কাজ হলো পশ্চিমা মন ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের চিত্রগুলোর ওপর তদন্ত করা। এ তদন্ত আমাদের বিউপনিবেশায়ন ও আত্মতার বিকাশে একান্ত জরুরি।
বিগত শতকের শেষ দিকে প্রতীচ্যবাদ দুনিয়ার বিভিন্ন বিদ্যায়তনে নিজের জানান দিতে শুরু করে। প্রাচ্য ও প্রতীচ্য শব্দদ্বয় পশ্চিমা ও ইসলামী সাহিত্যে প্রায়ই ব্যবহৃত হয়েছে। আধুনিক দুনিয়ায় প্রতীচ্য বলতে ইউরোপ-আমেরিকা আর প্রাচ্য বলতে এশীয় দেশগুলোকে বোঝায়। ভৌগোলিক বিভাজনের পাশাপাশি চিন্তা ও সাহিত্যে প্রাচ্য ও প্রতীচ্য বিভাজন নতুন নয়।
তবে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রাচ্যবাদ বনাম প্রতীচ্যবাদের সাম্প্রতিক উপস্থিতি এক অর্থে নতুন বটে! ক্রুসেড বা তার আগ থেকে মুসলিম দুনিয়ার সাথে পাশ্চাত্যের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলমান। তবে চিন্তা ও সাহিত্যে সপ্তদশ শতক থেকে প্রাচ্যবাদের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত হলেও এর বিপরীতে কোনো চিন্তা-শৃঙ্খলা লক্ষ করা যায়নি। মুসলিম পণ্ডিতদের কেউ কেউ প্রাচ্যবাদী বিভিন্ন কাজের জবাবি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এতটুকুই। ফলে পশ্চিমাদের প্রাচ্য অধ্যয়নের বিপরীতে (বিশেষত ইসলাম অধ্যয়নের বিপরীতে) এর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রতীচ্যবাদ বা পাশ্চাত্যবাদের সাম্প্রতিক ব্যবহার ও চর্চা অনেকের কাছে চমকপ্রদ ব্যাপার হয়ে উঠেছে।


এডওয়ার্ড সাঈদের (১৯৩৫-২০০৩) লেখালেখির মধ্য দিয়ে বিগত শতকের নব্বই দশকে এ পরিভাষা প্রতিষ্ঠা পেলেও প্রাচ্য অথবা মুসলিম দুনিয়ার পাশ্চাত্য-অধ্যয়ন অনেক পুরনো। অক্সিডেন্টালিজম বা প্রতীচ্যবাদকে আরবরা বলছে আল ইস্তিগরাব। শব্দটি এসেছে ‘গরব’ থেকে। ‘গরব’ শব্দের প্রকৃত অর্থ হলো- সূর্য অস্ত যাওয়ার স্থান, অর্থাৎ পশ্চিম দিক। সেই ভিত্তিতে আল ইস্তিগরাব (অক্সিডেন্টালিজম) হলো পাশ্চাত্যের জ্ঞান। অষ্টম শতক থেকেই পাশ্চাত্যের জ্ঞান মুসলিম সমাজে পণ্ডিতি ও কূটনৈতিক অধ্যয়নের বিষয় হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিকভাবে, পশ্চিমারা ইসলাম সম্পর্কে অনেক জেনেছেন, অনেক গবেষণা করেছেন, অনেক লিখেছেন; কিন্তু মুসলিম সভ্যতা পশ্চিমকে অধ্যয়ন করেনি, এ ধারণা নিতান্তই ভুল; বরং পশ্চিমাদের ইসলাম অধ্যয়নের আগেই মুসলিমদের পাশ্চাত্য অধ্যয়ন শুরু হয়। মুসলিম দুনিয়ায় পাশ্চাত্যের ধর্ম, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ভূগোল, দর্শন ইত্যাদির আলোচনা নানাভাবে হাজির হয় আহমদ ইবনে ফাদলান (৮৭৯-৯৬০), আবুল হাসান আলি ইবনে হুসাইন আল মাসউদি (৮৯৬-৯৫৬) আবু রায়হান মুহাম্মাদ ইবনে আহমদ আল বেরুনী (৯৭৩-১০৪৮), আবু মুহাম্মদ আলী ইবনে আহমদ ইবনে হাযম (৯৯৪-১০৬৪), মুহাম্মদ ইবনে আবদুল করীম শাহরাস্তানী (১০৮৬-১১৫৩), আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ আল-ইদ্রিসি (১১০০-১১৬৫), আবুল ওয়ালিদ মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ ইবনে রুশদ (১১২৬-১১৯৮), ইয়াকুত ইবনে আব্দুল্লাহ হামাবি (১১৭৯-১২২৯), তাকিউদ্দিন আহমাদ ইবনে আবদুুল হালিম ইবনে তাইমিয়া (১২৬৩-১৩২৮), আহমাদ মুহিদ্দিন পিরি (১৪৬৫/১৪৭০-১৫৫৩/১৫৫৪) প্রমুখের রচনা ও সৃষ্টিকর্মে।


অপর দিকে, মুসলিম সংস্কৃতির সাথে পাশ্চাত্যের মোলাকাতের ঘটনা ঘটে স্পেনে, ফ্রান্সে, সিসিলিতে। পশ্চিমা শিক্ষার্থীরা সেখানে ছিলেন মুসলিম বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থী। ১০৮৫ সালে স্পেনের টলেডো যখন মুসলিমদের হাতছাড়া হলো, সেখানে আরবি ও ইসলামী জ্ঞানোপকরণের বিশাল সঞ্চয় ছিল। এগুলো অচিরেই ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হলো। এতে নেতৃত্ব দিলেন মুসলিম বিদ্যালয়গুলোতে আরবি শেখা খ্রিষ্টান-ইহুদি পণ্ডিতরা। উচ্চতর বিদ্যায়তনে এমন মোলাকাতের নজির পাওয়া যায় ইউরোপীয় সীমানার বাইরেও। নমুনা হিসেবে বলা যায়, পৃথিবীর স্বীকৃত প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় মরক্কোর কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়ের (প্রতিষ্ঠা ৮৫৯ খ্রি.) কথা। সেখানকার শিক্ষার্থী ছিলেন ইহুদি দার্শনিক মাইমোনাইডস (১১৩৫-১২০৪), খ্রিষ্টীয় নবজাগরণের গুরু লিউ আফ্রিকানাস (১৪৯৪-১৫৫৪) প্রমুখ। উভয় পণ্ডিত ইউরোপে গিয়ে শুরু করেন আরবি গ্রন্থের অনুবাদ ও মুসলিম জ্ঞানচর্চার আন্দোলন। যার ফলে সেখানে ইসলাম ও মুসলিম সভ্যতা- অধ্যয়নে এগিয়ে আসেন অনেকেই। পরে এই ধারা কেবলই বিস্তৃত হয়েছে, থামেনি কখনো।
কিন্তু মুসলিম সভ্যতার পচন, অবনমন ও জ্ঞানগত অনগ্রসরতার পর্বে এসে অন্যান্য জাতি ও সভ্যতার অধ্যয়ন গতি হারায়। পশ্চিমা অধ্যয়ন যখন বহুমাত্রিক বিস্তার ও প্রসার লাভ করেছে, তখন মুসলিম জগতে গভীর নিদ্রা। পরে অষ্টাদশ ও উনিশ শতকে এসেও সম্মানজনক কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ইসলাম সম্পর্কে পশ্চিমা অধ্যয়নের জোরালো ও যথার্থ প্রতিক্রিয়া আমরা পাইনি।


শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর (১৭০৩-১৭৬২) রচনায় পশ্চিমা উত্থান ও রেনেসাঁ সম্পর্কে সচেতনতা থাকলেও বিস্তারিত কোনো আলোকপাত মেলে না। এরপর কার্ল গটলিব ফান্ডারের (১৮০৩-১৮৬৫) মোকাবেলায় রহমতুল্লাহ কিরানাভীর (১৮১৮-১৮৯১) বিতর্ক ও গ্রন্থ, আর্নেস্ট রেনানের (১৮২৩-১৮৯২) জবাবে জামালুদ্দীন আফগানীর (১৮৩৮-১৯৯৭) রচনা, উইলিয়াম ম্যুরের (১৮১৯-১৯০৫) মোকাবেলায় স্যার সৈয়দ আহমদের (১৮১৭-১৮৯৮) জ্ঞানকর্ম, জর্জ বার্নার্ড শ’র (১৯৩৬-১৮৫৬) সাথে মাওলানা আবদুল আলীম সিদ্দিকীর (১৮৯২-১৯৫৪) সংলাপ, এলওয়েজ ¯েপ্রঙ্গার (১৮১৩-১৮৯৩) প্রমুখের জবাবে শিবলী নোমানীর (১৮৫৭-১৯১৪) অবতারণা, গোল্ডযিহারের (১৮৫০-১৯২১) জবাবে মুস্তফা সিবাঈর (১৯১৫-১৯৬৪) গ্রন্থ, জোসেফ শাখতের (১৯০২-১৯৬৯) প্রমুখের জবাবে মোস্তফা আজমীর (১৯৩২-২০১৭) গবেষণাকর্ম শক্তিশালী নজির হলেও একান্ত বিরল। এসবের কোনো ব্যাপক ও প্রয়োজনীয় ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যায় না। যদিও পশ্চিমা সভ্যতার নানামুখী সমালোচনায় মুফতি আবদুহু (১৮৪৯-১৯০৫) আল্লামা ইকবাল (১৮৭৭ -১৯৩৮) মাওলানা মওদূদী (১৯০৩-১৯৭৯), সায়্যিদ কুতুব শহীদ (১৯০৬-১৯৬৬), আবুল হাসান আলী নদভী (১৯১৩-১৯৯৯), মুহাম্মদ আরকৌন (১৯২৮-২০১০) প্রমুখ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানসম্ভার রেখে গেছেন। এগিয়ে যাওয়ার পথে এসব সম্ভার ও তার প্রভাব-প্রতিক্রিয়াকে বিবেচনা-পুনর্বিবেচনার জরুরি কাজ প্রতীচ্যবাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে!
প্রতীচ্যবাদের কাজের ধরন গতানুগতিক নয়। পশ্চিম গোলার্ধ ও পূর্ব গোলার্ধে সাংস্কৃতিক ভিন্নতা এক বাস্তবতা। উভয়ের ঐতিহ্য ও রীতিনীতি এতটাই আলাদা, যা ভুল অনুমানভিত্তিক কুসংস্কার জন্ম দেয়। উভয় সংস্কৃতি-সভ্যতায় সংঘর্ষের ব্যাপারটি এই বাস্তব ভিন্নতা ও বাড়াবাড়িমূলক ভুলের ফসল। পশ্চিমা সাহিত্য, চলচ্চিত্র ও মিডিয়াতে কীভাবে প্রাচ্যকে, বিশেষত ইসলামকে চিত্রিত করা হয়, তার মধ্যে এর নমুনা দেখা যেতে পারে। রাজনীতি ও বিদেশনীতিতে এর উদাহরণের অভাব নেই। ইসলামকে চাতুর্যের সাথে উপস্থাপন করা প্রাচ্যতত্ত্বে প্রায় নিয়মে পরিণত হয়। এর মধ্য দিয়ে মুসলিমদের সম্পর্কে এমন দৃষ্টি তৈরি করা হয়, যা তাদেরকে দেখে ‘ঝুঁঁকিপূর্ণ প্রতিপক্ষ ও প্রতিক্রিয়াশীল’ হিসেবে। এ মূল্যায়নের কেন্দ্রে থাকে ‘তারা’ ও ‘আমরা’ এবং উভয়েই জন্মগতভাবে ভিন্ন। এখানে আমরা মানে পশ্চিমা আর তারা মানে প্রাচ্যিয় বা মুসলিম। ‘পশ্চিমের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে উন্নত হওয়া ছাড়া যাদের নিয়তি অন্ধকার।’ এই মানসিকতা লুকিয়ে আছে পশ্চিমা জ্ঞানকাণ্ডে ও বয়ানে। প্রতীচ্যবাদ এর বিরুদ্ধে চালায় পাল্টা বুদ্ধিবৃত্তিক অভিযান।


প্রতীচ্যবাদকে অনেকেই পশ্চিমা সংস্কৃতির চিন্তারিক্ত, অপরিবর্তনীয়, সাদামাটা সমালোচনার চর্বিতচর্বণ হিসেবে দেখাতে চান; কিন্তু এটি মূলত সেই বিবরণ, যাতে উঠে আসে প্রাচ্যের মানুষের দৃষ্টি দিয়ে দেখা পশ্চিমা দুনিয়া। পশ্চিমের সংস্কৃতি ও বৈশিষ্ট্যগুলোকে কীভাবে তারা উপলব্ধি করে, এর বিবরণে রচিত প্রাচ্যের ভাষ্যগুলোকে চিন্তারিক্ত ও অবাস্তব মনে করা পশ্চিমা সেই মানসিকতার ফসল, যা দিয়ে প্রাচ্যের ওপর সে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব কল্পনা করে নেয়।
পশ্চিমা দুনিয়ায় প্রতীচ্যবাদের বয়ানকে বাড়াবাড়িমূলক অনড় অপবাদ হিসেবে দেখানো হচ্ছে প্রায়ই। কিন্তু তাদের বোঝা উচিত, প্রাচ্যে পাশ্চাত্য বিচার যেভাবে গড়ে উঠেছে, তার সাথে ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার সংযোগ রয়েছে বিশেষভাবে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার নিগড়ে থাকা ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ বা আফ্রিকার নানা অংশ পাশ্চাত্যকে কীভাবে দেখবে, সেই পথ নির্মাণ করে দেয় ঔপনিবেশিকতা। এখানে স্থানীয় জনগণের ওপর তারা চাপিয়ে দিয়েছিল নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি, সামাজিক রীতিনীতি ও ঐতিহ্য। ফলে উত্তর-ঔপনিবেশিক দুনিয়ায় উপনিবেশিত মানুষ যদি ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার আলোকে ব্রিটিশদের নিপীড়ক হিসেবে অভিযুক্ত করে, সে দায় কার?
মুসলিম দুনিয়ার সাথে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্ঘাতের অতীত অনেক পুরনো। ক্রুসেড হয়েছিল হাজার বছর আগে। পশ্চিমারাই সেখানে ছিল আক্রমণকারী। সেই ক্রুসেডের উত্তরাধিকার কি বহন করছেন না পশ্চিমা দুনিয়ার অনেকেই? ফিলিস্তিন, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন কিংবা আফগানিস্তানের মতো রক্তাক্ত মানচিত্রসমূহে বারবার ঘুরেফিরে হাজির হয়েছে ক্রুসেডের স্মরণিকা। সভ্যতার সঙ্ঘাত তত্ত্বের আড়ালে মুসলিমদের শত্রু স্থির করে দমন, পীড়ন ও দলনের যে ধারা চলমান, তার ভেতরকে বা অতীতকে যখনই খনন করা হচ্ছে, বেরিয়ে আসছে ক্রুসেডের হাড়গোড়! ফলে অনেকেই পাশ্চাত্যের পরিচালিত সভ্যতার সঙ্ঘাতকে বিচার করতে গিয়ে ক্রুসেডকে বাদ দিতে পারছেন না, এটি স্বাভাবিক।


তবে এটিও সত্য, ক্রুসেডের প্রশ্নে অনেকেই নির্বিচারবাদী। সাধারণভাবে পাশ্চাত্যের সব কিছুকেই ক্রুসেডের সাথে একাকার করে দেয়ার প্রবণতাও রয়েছে। অনুরূপভাবে পাশ্চাত্যের যে কেউ মানেই সে লোভী, ভোগবাদী, পুঁজিবাদী এবং অহঙ্কারী হিসেবে দেখার প্রবণতা রয়েছে। যেন এর বাইরে আর কোনো চিত্র নেই। অন্যের সম্পদ ও জ্ঞান চুরি করেই তারা নিজেদের গড়েছে কিংবা বস্তুবাদই তাদের জীবনবোধের ঈশ্বর, এমনতরো মূল্যায়নের মধ্যে পুরো সত্য ধরা পড়ে না। অবাস্তব নির্বিচারকে অবলম্বন করে অক্সিডেন্টালিজম এগোতে পারবে না, এটি মনে রাখতে হবে। এই অবস্থান ভুল যে, পশ্চিম যদি গোঁড়ামির মধ্য দিয়ে প্রাচ্যকে অধ্যয়ন করে থাকে, তাহলে প্রাচ্যকেও একই কাজ করতে হবে।
দুনিয়ার বুদ্ধিবৃত্তিতে পশ্চিমা বয়ানের একাধিপত্যকে মোকাবেলা করার জন্য অক্সিডেন্টালিজমকে একটি সূক্ষ্ণ ও প্রভাবক বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। যাতে সে প্রজন্মের মেধা ও মননে আপন চিহ্ন রাখে ও অবস্থান তৈরি করে। কিন্তু সত্য হলো- অক্সিডেন্টালিজম এখনো কোনো বিজ্ঞানে রূপায়িত হয়নি। যাতে সে ইউরোপীয় সভ্যতার বিষয়ভিত্তিক অধ্যয়নকে গবেষণার শৃঙ্খলায় রূপান্তরিত করবে। পশ্চিমা সভ্যতা, এর উৎস, পরিবেশ, এর গঠন, বিকাশ, অগ্রগতির নানা ধাপ, এর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সমালোচনার বৈজ্ঞানিক ডিজাইন এখনো অনুসন্ধান করছে প্রতীচ্যবাদ। অন্যান্য বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যেমন পথ ও প্রক্রিয়া রয়েছে, সেটি না থাকলে প্রতীচ্যবাদ বস্তুনিষ্ঠতা রোজগার করতে পারবে না এবং নিজের প্রভাবক ক্ষমতাকে সম্প্রসারিত করতে পারবে না। কেননা, সে সমালোচনা করতে চায় এমন এক সভ্যতাকে, যা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক , মনস্তাত্ত্বিক, সৃষ্টিতাত্ত্বিক, জ্ঞানতাত্ত্বিক এবং নৈয়ায়িক তত্ত্ব ও চিন্তাশৃঙ্খলার দীর্ঘ এক ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করেছে। এমতাবস্থায় নিজস্ব নিরপেক্ষ ও যথার্থ দৃষ্টিকোণই পারে অক্সিডেন্টালিজমকে ভাগ্যবান করতে।
কল্পিত ও খণ্ডিত মাত্রা ও বয়ানগুলোকে নস্যাৎ করার জন্য তাকে কল্পিত ও খণ্ডিত মাত্রা ও বয়ান থেকে বেরিয়ে আসার নিরলস চেষ্টা করতে হবে। পশ্চিমা বয়ানগুলোর প্রান্তিকতা, প্রতারণা, কৌশল, দুর্বলতা ইত্যাদিকে নির্দেশ করার কাজ তাকে করতে হবে বলেই জানতে হবে এসব বয়ান ও জ্ঞানশৃঙ্খলার সবলতাকে। কিন্তু প্রতীচ্যবাদের উদ্দেশ্য কেবল এটিই নয়। প্রাচ্য, বিশেষত মুসলিম দুনিয়ার জ্ঞান ও মনের মুক্তি নিশ্চিত করতে হলে পাশ্চাত্যের সমালোচনাই যথেষ্ট নয়। জরুরি হলো নিজেদের জ্ঞানীয় ও চৈন্তিক পুনর্পঠন, পুনর্গঠন।
লেখক : কবি, গবেষক
ই-মেইল:71.alhafij@gmail.com