Naya Diganta

রাসূল সা:-এর মর্যাদা ও আমাদের দায়িত্ব

(পঞ্চমাংশ)
আমাদের উচিত প্রত্যেকের ঘরে রাসূল সা:-এর জীবনী সংরক্ষণ করা এবং যথাসম্ভব পাঠ করে তাকে সত্যিকার অর্থে জানা, চেনা, বোঝা, হৃদয়ে স্থান দেয়া, ভালোবাসা বৃদ্ধি করা এবং চলাফেরা বা বিশ্রামের সময় তাকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করা, যাতে করে তিনি মনে স্থান পেতেই থাকেন। কত কষ্ট, কত পরিশ্রম তিনি করেছেন তার ২৩ বছরের নবুওয়্যতের জীবনে, যা সত্যিকার অর্থে অতুলনীয়। কত অত্যাচার, অবিচার, জ্বালা-যন্ত্রণা, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, অপমান-অবহেলা তিনি নীরবে সহ্য করেছেন, তাও অতুলনীয়।
আমাদের মধ্যে এমন অনেক উঁচুস্তরের মু’মিন-মু’মিনা আছেন যারা রাসূল সা:-এর দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা, পরিশ্রম, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, অত্যাচার-নির্যাতন এসব ঘটনা চিন্তাভাবনা করতে করতে অশ্রুজলে সিক্ত হয়ে যান। যাদেরকে বলা যেতে পারে আশিকে রাসূল।
পরিপূর্ণ মুমিন আমাদের হতেই হবে যথাসাধ্য চেষ্টা করে। এ প্রসঙ্গে রাসূল সা:-এর একটি বাণী অবশ্যই আমাদের জানতে হবে, তিনি ঘোষণা দিয়েছেন- তোমাদের মধ্যে কেউ পরিপূর্ণ মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি তার কাছে তার পিতা-মাতা, সন্তানাদি এবং সব মানুষ অপেক্ষা অধিক প্রিয় পাত্র হই। এ হাদিস থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, আমরা রাসূল সা:-কে অবশ্যই বিশ্বাস করব, তাকে জানতে, চিনতে ও বুঝতে চেষ্টা করব। তার তেইশ বছর নবুওয়্যতের জীবনের কার্যকলাপ, তার ওপর অমানুষিক অত্যাচার-অবিচার ও নির্যাতন, তাকে হত্যার জন্য রাতের বেলা ১০-১২ জন যুবকের তার বাড়ি ঘেরাও করা, সহচরগণকে নিয়ে তার বন্দী জীবনযাপন পানাহার ব্যতীত, ধর্র্মযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ ইত্যাদি অবগত হওয়ার পর নিঃসন্দেহে তার প্রতি আমাদের সর্বাধিক ভালোবাসা সৃষ্টি হয়ে যাবে, ইনশা আল্লাহ।
অবশেষে আমাদের মনে রাখতে হবে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল সা: আমাদের জন্য সর্বাধিক কল্যাণ, শান্তি এবং উভয় জীবনের অর্থাৎ ইহকাল ও পরকালের জন্য একমাত্র মুক্তির উৎস, যদি আমরা তাঁদের আদেশ ও নিষেধ যথাযথভাবে পালন করে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে পারি।
অনেকের কাছে রাসূল সা: ছিলেন প্রাণাধিক। উদাহরণস্বরূপ- ওহুদের যুদ্ধে যখন রাসূল সা:-এর প্রতি বৃষ্টিসম তীর বর্ষণ হয়েছিল তখন অনেক সাহাবায়ে কেরাম ঢালের মতো তার চার দিকে দাঁড়িয়ে নিজেরা তীরবিদ্ধ হলেন; কিন্তু প্রাণাধিক রাসূলকে রক্ষা করলেন।


রাসূল সা:-কে প্রেরণ করার উদ্দেশ্য আল্লাহ তায়ালা এভাবে প্রকাশ করেন, আল্লাহর বাণী- ‘তিনিই আল্লাহ তায়ালা, যিনি হিদায়েত এবং সত্য ধর্ম নিয়ে তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন যেন তিনি সব ধর্মের উপর (যা বাতিল করা হলো) সত্য ধর্মকে বিজয়ী করেন, আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহ তায়ালাই যথেষ্ট।’ (সূরা : আল ফাতহ্ : ২৮) এ আয়াত থেকে প্রমাণ হয় যে, ইসলাম ধর্ম ছাড়া বিশ্বে প্রচলিত সব ধর্ম আল্লাহ বাতিল করেছেন। ফলে ইসলাম ধর্মই একমাত্র সত্য ধর্ম যা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য। আল্লাহর বাণী- ‘ইন্নাদ্বীনা ইন্দাল্লাহিল ইসলাম’। অর্থ : ‘ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্ম।’ (সূরা: আল ইমরান: ১৯) আল্লাহ আরো বলেছেন-‘কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করতে ইচ্ছা করলে তা কখনো কবুল করা হবে না এবং সে আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (সূরা : আল ইমরান : ৮৫)
একসময় তাহাজ্জুদ সালাত ফরজ ছিল। রাসূল সা: মিরাজে আল্লাহর দর্শন লাভের পর প্রথমে দৈনিক পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করা হলো; কিন্তু মূসা আ:-এর পরামর্শক্রমে পালায় পালায় রাসূল সা: ফেরত এসে আল্লাহর কাছে সালাতের ওয়াক্তগুলো কমানোর আরজি পেশ করতে থাকলেন। দয়ালু আল্লাহ তায়ালা তা কবুল করে সর্বশেষ পঞ্চাশ ওয়াক্তের পরিবর্তে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত নির্ধারণ করে দিলেন, যা আমাদের জন্য মিরাজ উপলক্ষে আল্লাহর কাছ থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত, কারণ সালাত সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বাধিক আদায়কৃত ইবাদত। তা ছাড়া সালাত জান্নাতের চাবি এবং মু’মিনদের মিরাজ। তার মানে সফল মুসল্লিরা সবাই জান্নাতবাসী, কারণ সফল সালাতের মাধ্যমে তারা অর্জন করেছেন জান্নাতের চাবি। রাসূল সা: মিরাজ থেকে ফেরার পর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ হলো এবং তাহাজ্জুদ সালাত অন্য আয়াতের মাধ্যমে ফরজ থেকে নফল ইবাদতে রূপান্তরিত হলো।
রাসূল সা:-এর অনেক বাণী ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়- এককথায় বিশ্বশান্তির জন্য যথেষ্ট সহায়ক ও অবশ্য করণীয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, সে বাণীগুলো এবং তার সাথে কার্যক্রম আজ অবহেলিত। ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি বিশ্বে অশান্তি এবং পোহাচ্ছি চরম দুর্ভোগ, বিশেষ করে আল্লাহর আজাব ও গজব, যা আমাদেরই অর্জন। উদাহরণস্বরূপ- ‘কোভিড-১৯’ যা সারা বিশ্বকে আক্রমণ করেছে প্রায় দু’বছরাধিকাল ধরে। জানি না কখন এর অবসান হবে এবং তা আদৌ আমরা দেখে যেতে পারব কি না।
দয়া করে আল্লাহর শেখানো মহামূল্যবান দোয়াটি মুখস্থ করে ফেলুন এবং সুযোগমতো পড়তে থাকুন- ‘হে আমার প্রতিপালক! দয়া করে বৃদ্ধি করে দিন আমার (উপকারী) জ্ঞান।’ সূরা : ত্বহা : ১১৪


হে আল্লাহ! আপনি সীমাহীন শক্তিধর, যা ইচ্ছা করেন তাই করতে পারেন। যথা ইচ্ছা করেছেন সৃষ্টি করেছেন পিতৃ-মাতৃহীন আদম আ:-কে ৬০ হাত লম্বা ও সুন্দরতম আকৃতি এবং হাজার বছর আয়ু দিয়ে, যেমনি করে আপনি ঈসা আ:-কে পিতৃহীন অবস্থায় মারিয়াম আ:-এর গর্ভে ৯ মাসের শিশু আকারে আপনার খাস কুদরতে দান করলেন, ইউনুস আ:-কে মাছের উদর থেকে, ইব্রাহিম আ:-কে অতুলনীয় নরককুণ্ড থেকে (উভয়কে) ৪০ দিন পর সম্পূর্ণ নিরাপদ অবস্থায় উদ্ধার করলেন। এমনি করে আপনার অসীম কুদরতের হাজার হাজার ঘটনা আমরা দেখতে পাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি আপনার অভূতপূর্ব আজাব ও গজব বিশ্বব্যাপী ‘করোনা’ আকারে।
হে আল্লাহ! দয়া করে আমাদেরকে সৌভাগ্য দান করুন, যাতে করে আমরা আপনার প্রিয়তম বন্ধুর হাতে হাউজে কাউসারের শরবত পান ও তার সুপারিশ লাভ করতে পারি সে মহান কঠিন দিনে যে দিন একমাত্র আপনি ছাড়া আর কোনো সাহায্যকারী আমাদের জন্য থাকবে না। বাবা সন্তান থেকে, স্বামী স্ত্রী থেকে, সন্তান বাবা থেকে পালিয়ে বেড়াবে আত্মরক্ষার কঠিন চিন্তাভাবনায়।


হে আল্লাহ! দয়া করে আমাদেরকে তাওফিক দিন রাসূল সা:-কে পুরোপুরি চিনতে, জানতে, ভালোবাসতে, তার আদর্শ অনুকরণ ও অনুসরণ করতে, সর্বোপরি তার আদেশ ও নিষেধাজ্ঞা যথাযথভাবে পালন করতে। হে আল্লাহ! আপনি আপনার প্রিয়তম বন্ধু রাসূল সা:-কে বিশ্বশান্তির দূত হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন। বর্তমান অশান্ত পৃথিবী, যা আমাদের অর্জন আপনার ও আপনার রাসূলের অবাধ্য হয়ে, দয়া করে তা শান্ত করুন। অত্যাচার, অবিচার, ব্যভিচার, পাপাচার, দুর্নীতি ইত্যাদিতে ভরপুর পৃথিবীতে বসবাসকারী জর্জরিত জনগোষ্ঠীকে আপনি আপনার বিশেষ রহমতে নিরাপত্তা দিন। আমিন।
রাসূল সা: সম্পর্কে উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনা দ্বারা তার প্রাথমিক পরিচয় কিছুটা তুলে ধরা হয়েছে। রাসূল সা:-এর জীবনী বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন ভাষায় লিখেছেন, সারা বিশ্বে যার সংখ্যা যেকোনো লোকের লিখিত জীবনীর সংখ্যা অপেক্ষা অনেক অনেক বেশি হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ^াস।
লেখক : সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ ও চেয়ারম্যান এবং প্রতিষ্ঠাতা অংশীদার, আজিজ হালিম খায়ের চৌধুরী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস