Naya Diganta

বাংলাদেশে ক্যান্সার : এখনই ভাবার সময়

বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনাচার পাল্টানোর সাথে সাথে রোগচিত্রের ধরনও পাল্টেছে। গত শতাব্দীতে ছিল সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব। স্বাস্থ্যসচেতনতা, উন্নত জীবনযাত্রা ও রোগ প্রতিরোধী টিকা, সব মিলিয়ে সংক্রামক রোগ এখন ইতিহাস। সংক্রামক রোগের পরিবর্তে এখন বিভিন্ন অসংক্রামক মরণব্যাধির ছড়াছড়ি। বিশ্বে এখন মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ ক্যান্সার। বাংলাদেশে এটি মৃত্যুর কারণ হিসেবে ষষ্ঠ স্থানে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা ১৫ লাখ যা ২০৩৫ সাল নাগাদ দাঁড়াবে ৩২ লাখ ৫০ হাজার ৭২৬ জনে। বাংলাদেশে বর্তমানে ক্যান্সারজনিত মৃত্যু প্রতি বছর দেড় লাখ জন। প্রতি বছর ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে দুই লাখ মানুষ যা সামনের দিনগুলোতে আরো বৃদ্ধির সম্ভাবনা। মৃত্যুর সম্ভাবনা আরো বেড়ে যায় বয়োজ্যেষ্ঠদের ক্ষেত্রে, ধূমপানের অভ্যাসে, পারিবারিক ক্যান্সারের ইতিহাস, মদ্যপান, স্থূলতা, অতিরিক্ত ওজন, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব থাকলে। ভেজাল খাবার, খাবারে ফরমালডেহাইট, শুঁটকি তৈরির প্রক্রিয়ায় ডিডিটির ব্যবহার, বায়ুদূষণ, আর্সেনিকদূষণ- এসব মৃত্যুহার বাড়ানোর ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা রাখে। সাথে সাথে এগুলো ক্যান্সারেরও কারণ।

বাংলাদেশে ফুসফুসের ক্যান্সার- ক্যান্সারের ৪৮.৩ শতাংশ। অন্যান্য ক্যান্সারের মধ্যে রয়েছে- মুখ, স্তন ও জরায়ুমুখের ক্যান্সার। মহিলাদের ক্ষেত্রে স্তন ক্যান্সারের হার সবচেয়ে বেশি। লক্ষণীয়, ক্যান্সার রোগীদের বেশির ভাগের বয়স ৩০-৬৫ বছরের মধ্যে। প্রায় সবাই বিভিন্ন উৎপাদনমুখী কাজকর্মের সাথে জড়িত। অসুস্থতাজনিত কারণে এর ব্যাঘাত ঘটে। ক্যান্সার চিকিৎসার খরচের সাথে এটি যোগ করলে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়। বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী ক্যান্সারজনিত আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১.১৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ সমস্ত ক্যান্সার রোগের ৪০ শতাংশ প্রতিরোধযোগ্য। প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার ধরা পড়লে ৯৫ শতাংশ পুরোপুরি সুস্থ হওয়া যায়। অথচ বাস্তবে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। তিন চতুর্থাংশ রোগী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন রোগ যখন ছড়িয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবে তখন সুস্থতার হার কমে মৃত্যুহার বেড়ে যায়। যারা বেঁচে থাকেন তারাও বিভিন্ন ধরনের শারীরিক দুর্বলতা নিয়ে বাঁচেন। সংসারের ও পরিবারের গলগ্রহ হয়ে থাকেন। অবহেলিত মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হন।


বাংলাদেশে ১৯টি হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ বলতে যা বোঝায়, তা নেই। নেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। ওষুধপত্র বলতে গেলে পুরোটাই কিনতে হয়। এসব ওষুধের জন্য রোগীরা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন কারসাজিতে ওষুধ উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। প্রয়োজনীয় পুষ্টিবিদ, মনোচিকিৎসকের অভাব রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপির সুযোগ থাকলেও রোগের Advance অবস্থায় Palliative চিকিৎসার ব্যবস্থা শূন্যের কোঠায়। ক্যান্সার চিকিৎসার সুবিধা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নাগালের বাইরে। রোগীদের জন্য আধুনিক স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। প্রয়োজন ক্যান্সার রোগীদের জাতীয় নিবন্ধনের নিয়ম; যেন এর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের তথ্য-উপাত্ত তৈরি করা যেতে পারে যার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে জাতীয় ক্যান্সার প্রতিরোধ ও চিকিৎসানীতি প্রণয়ন করা সহজ এবং বাস্তবমুখী হয়। মহিলাদের স্তন ও জরায়ুমুখ ক্যান্সারের মৌলিক প্রতিরোধী কার্যক্রমের অভাব রোগের ব্যাপ্তিকে আরো বিস্তৃত করেছে। রোগ নির্ণয়ের প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ব্যয়বহুল হওয়া, প্রয়োজনীয় ওষুধের দুষ্প্রাপ্যতা, চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়া, চিকিৎসকের স্বল্পতা- সব মিলিয়ে ক্যান্সার চিকিৎসা আমাদের দেশে এখনো সাধারণের নাগালের বাইরে। অপর দিকে এ ব্যাপারে জনসচেতনতার অভাব এ চিত্রকে আরো ভয়াবহ করে তুলেছে। ফলে হাজার হাজার রোগী চিকিৎসার জন্য বহির্মুখী। এটিকে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে? ব্লাড ক্যান্সারের ব্যাপ্তি ও চিকিৎসার সুযোগ সুবিধা খুবই সীমিত। অস্থিমজ্জা সংযোজন এখনো আমাদের কাছে ‘দিল্লি দূর অস্ত’।

ক্রমবর্ধমান ক্যান্সার রোগীর পটভূমিতে এখন প্রয়োজন ক্যান্সার চিকিৎসা বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচির দ্রুত বাস্তবায়ন। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসক, রোগী, সমাজকর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী, স্বাস্থ্যঅর্থনীতিবিদ, ধর্মীয় নেতা, প্রচারণা শিল্পের সাথে জড়িত সবাইকে নিয়ে সমন্বিত কার্যক্রম এখন সময়ের দাবি। সচেতনতা সৃষ্টি, রোগ নিরূপণ, চিকিৎসা এবং পরবর্তী সময়ের জন্য পরামর্শক, মনোবিজ্ঞানী, পুষ্টিবিদ ও সরকারের ঐক্যবদ্ধ চেষ্টাই কেবল পারে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সফলতা আনতে। সাথে সাথে বিনামূল্যে অথবা কমমূল্যে ওষুধ সরবরাহের ব্যবস্থা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঢাল ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যাপ্তি রোধ করতে। জনসচেতনতার দিকটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারেও জোরালো কার্যক্রম প্রয়োজন।

লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com