Naya Diganta

রাঘববোয়ালরা কোথায়

তারা সমবায় ব্যাংক থেকে সবজি চাষের জন্য ২০১৬ সালে ১৬ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। পরিশোধ করেছেন ১৩ লাখ টাকা, তারপরও সমবায় ব্যাংক আরো ১২ লাখ টাকা দাবি করছে। কারণ ওই ঋণের সুদ নাকি ১৫ পারসেন্ট।
এখন ঋণখেলাপি হিসেবে ৩৭ কৃষকের মধ্যে ১২ জনকে আটক করে পুলিশ হাজতে পাঠায় আর বাকি ২৫ জন পলাতক ছিলেন। গত ২৭ নভেম্বর সবাই জামিন পেয়েছেন। উল্লেøখ করা যায়, এরা ১০ থেকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন সবজি উৎপাদনের জন্য। ঋণ গ্রহীতারা ঋণের টাকায় সবজি চাষ করে তা বিক্রি করেছেন বাজারে। এটি মানুষের খাদ্যশস্যের সাথে জড়িত। অর্থাৎ তারা মানুষের জন্য শাক-সবজি চাষ করছেন ও ঋণের টাকা ফেরত দিয়ে আসছেন। তারপরও তাদের বিরুদ্ধে ঋণ ফেরত না দেয়ার অপরাধে মামলা হয়েছে। পুলিশ তাদের আটক করেছে, হাজতে পুরেছে।
আর অন্য দিকের চিত্র দেখুন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবীদের উদ্দেশে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘আপনারা চুনোপুঁটি ধরছেন। যারা অর্থশালী, ক্ষমতাবান, তারা কি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে? এদের ধরবে কে?’


বেসরকারি একটি ব্যাংক থেকে ১১০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে করা মামলায় দুই আসামির জামিন বাতিল প্রশ্নে রুল শুনানিতে হাইকোর্ট এ প্রশ্ন রাখেন। বিচারপতি মো: নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে এ শুনানি হয়।
কি বোঝা গেল? দুটো মামলাই অর্থসংক্রান্ত। গরিব চাষির হাতে হাতকড়া আর জেলহাজতে তারা, আর যারা ১১০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আর ফেরত দেয়নি বা দিচ্ছে না, সেই ঋণী মানুষগুলো আরামে বাস করছেন রাজধানীর সুশোভন দালানকোঠায়। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, সোলায়মান নামের সেই ঋণগ্রহীতা পলাতক। তিনি পালিয়ে বাঁচতে পারছেন। তার হাতে প্রচুর টাকা, যা লুটে আনা টাকা, যা জনগণের টাকা। মাননীয় হাইকোর্ট সেই কথাটিই দুদকের আইনজীবীকে বলেছেন এবং তিনি নির্দেশও দিয়েছেন এই বলে যে- দুদকপ্রধানের সাথে এ নিয়ে কথা বলবেন। অর্থাৎ পরোক্ষে মাননীয় বিচারপতি রাঘববোয়াল ঋণগ্রহীতা, ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে ঋণ নিয়ে লোপাট করেছে সেই অর্থ, যারা নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে হাওয়া হয়ে গেছেন, যারা হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার পরও তা পরিশোধ করছেন না, তারা বুক ফুলিয়ে প্রশাসনের চোখের সামনে থাকছেন; কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে না সরকার না দুদক মামলা করছে, না তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হচ্ছে। তাদের হাতে হাতকড়া পড়ছে না। তাদের বেশির ভাগই হাজতের বাইরে, হয় জামিনে, নয়তো প্রকাশ্য পলাতক অবস্থায় আছেন। তাদের পোরা যাচ্ছে না জেলহাজতে, বা পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে হাতকড়া নিয়ে যায় না। রাজনৈতিক সরকারের ক্ষমতাবানরা তাদের বন্ধু-স্বজন বা সহযোগী। সমাজের নেতা-নেত্রীদের পক্ষপুটে থাকেন তারা। এ জন্য তাদের ছোঁয়া যায় না। এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনও নিঃশব্দে থাকে, সময় পার করছে এবং তারাও ওইসব রাঘববোয়ালদের ঘনিষ্ঠজন হিসেবেই বহাল থাকছে। ওই সব বিশাল অঙ্কের ঋণীরা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হন ও সরকারের সবচেয়ে উপকারী (প্রাণী) মানুষ হিসেবে গণ্য হচ্ছেন।


এই যে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে গরিব চাষি ঋণগ্রহীতার সাথে ভুয়া কাগজের মাধ্যমে নেয়া ধনী ঋণীর মধ্যে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্য। এটি কিন্তু আমাদের সমাজেরই সাংস্কৃতিক রূপ ও রাজনৈতিক বৈষম্যেরই প্রতিফলন। সমাজের যারা দুর্বৃত্ত শ্রেণীর লোক, যারা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় চলেন এবং দলীয় পদ পান, তাদের সাথে সরকারের রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাদের দহরম-মহরম। ঋণদাতা তাদের বিরুদ্ধে কোনোরকম সমন জারি করে না। কোনো মামলা করার আগেই তাদের ঋণ পুনঃতফসিল হয়ে যায়। কিংবা খারাপ ঋণ হিসাবের তালিকায় চলে যায়, যা আর কোনো দিন ফিরে আসবে না। ওই ঋণগ্রহীতা ঘুষ দিয়ে এ সব করেন। যিনি ঘুষ দেন তিনি দাতা, আর যিনি ঘুষ নেন তিনি গ্রহীতা। আর এই গ্রহীতারাই ওই লুটেরাদের প্রধান সাহায্যকারী, লুটের সহকারী, তারা তাদের রক্ষার জন্য নানা কিসিমের আইনি পথ উন্মুক্ত করেন।
নীতি আর দুর্নীতির সাথে রাজনৈতিক সংস্কৃতির মহব্বত কেমন, সেটি বোঝা যায় ঋণ পুনঃতফসিলকরণের ক্ষেত্রে ও ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে ঋণ দাতা এবং গ্রহীতার সম্পর্কের চেহারা দেখলেই। যিনি ঋণ দিচ্ছেন হাজার হাজার কোটি টাকা, তিনি ব্যাংকার। তিনি কি ঋণ দেয়ার আগে কাগজপত্র ঠিক আছে কি না তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন না? নিশ্চয়ই দেখেন। তিনি জেনে শুনে বুঝেই ঋণ দেন। ঘুষের বিনিময়ে তিনি ঋণদাতা। অর্থাৎ ঋণ যে লুটেরা নিয়ে যাচ্ছে এবং তা কোনো দিনই ফেরত আসবে না, এই সত্য তিনি ও তার ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জেনেবুঝেই অনুমোদন করে। তাদের একটি অজুহাত রেডি থাকে। তা হলো, রাজনৈতিক কিংবা অরাজনৈতিক সরকারের প্রভাবশালীদের অনুরোধে বা নির্দেশে ওই সব ঋণ দেয়া হয়েছে; কিন্তু রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক সরকারের সেই প্রভাবশালীরা তা স্বীকার করবেন না এবং ব্যাংকার যদি ঋণ দিতে অস্বীকার করেন? তাহলে তার চাকরি যাবে কিংবা তাকে অন্য কোথাও বদলি করা হবে কিংবা নানান হয়রানির মাধ্যমে তাকে কাবু করা হবে।


আমাদের দেশে সরকারের লোকেরা এভাবেই চাকরিজীবীদের হেনস্তা করেন। তারা হেনস্তা হওয়ার চেয়ে ঋণ দিয়ে ঘুষ খেয়ে নিজেরাও কোটিপতিত্ব বরণ করতেই সুখ পান। তাই ব্যাংকপাড়ার লোকেরা সুখী। কারণ তাদের প্রাপ্তির খামতি নেই। দুর্ভোগ কেবল ক্ষুদ্র ঋণীদের, যারা রাজনৈতিক শক্তির অধিকারী নয়। তারা রাজনৈতিক শক্তির অধিকারী হলে, সবজি চাষিদের হাজতে-জেলে পোরার কাজটি না কোর্ট না পুলিশ, কেউ করত না। তারা শুধু খাদ্য উৎপাদক, তাই তাদের শক্তি কেবল বাহুতে, রাজনৈতিক আঙিনায় তাদের প্রভাব নেই। তাদের কোনো ব্যাংকারই ভয় পান না। এই যে নীতিহীনতা, এই যে ডিসক্রিমিনেশন/ বৈষম্য এটি দেশের প্রধান সংস্কৃতি। আমরা মানসিকভাবে অসৎ, নৈতিকভাবে অসৎ, কর্মক্ষেত্রে অসৎ, রাজনীতির ক্ষেত্রে অসৎ... আমাদের মন-মানসিকতা অসততায় ভরপুর। আমি যাদের কথা বলছি তারা গ্রামের উৎপাদক নয়, শহরের শ্রমজীবী নয়, শিল্পকারখানার শ্রমিক নয়, তারা ওই শ্রেণীর বাইরের সামাজিক মানুষ। আজ তাই প্রমাণ করে ব্যাংকের ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার কাজ। তা প্রমাণ করেছে নৈতিকতা সম্পর্কিত কর্মশালা বা সেমিনারের আয়োজক ও উপস্থিত বক্তারা। সমাজে যে নীতি ও আদর্শের তীব্র সঙ্কট, তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করছেন তারা। আমাদের সমাজের, স্বাভাবিক সমাজের স্তরগুলোতে নীতি-আদর্শ বলে কিছু নেই। সততা বিতাড়িত, রাজনীতি সেই বিতাড়িত সততারই আউটফল। এই অধঃপাতই আমাদের সমাজের সর্ব অঙ্গে ঘা সৃষ্টি করেছে। আমাদের রাজনীতিকরা অবলীলায় মিথ্যার চর্চা করছেন। তারা লজ্জিত হচ্ছেন না। যারা সমাজকে শিক্ষা দেবেন, যারা দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির শিক্ষক তারাই যদি অসৎপন্থা নেন, তাহলে সমাজের নিচের অংশ কি শিখবে?
মূলত রাজনৈতিক সংস্কৃতির অসততার জন্যই দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের টাকা লোপাট হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর অর্থ ঋণের নামে লুটে নিয়ে পাচার হচ্ছে বিদেশে। শুরুটা কবে থেকে হয়েছে তা বলব না। তবে হলমার্কের নামে নেয়া ঋণ লুটেরার চেহারা দেখা গিয়েছিল। যা সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে দেয়া হয়েছিল। সেই চার হাজার কোটি টাকার অবৈধ, অন্যায় ঋণের মাধ্যমে সমাজের লুটেরাদের দৃষ্টি উন্মোচিত হয়েছিল বলেই মনে হয়। কেননা, আমরা সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে বলতে শুনেছি ‘চার হাজার কোটি টাকা? ওটা কোনো টাকা হলো?’ তার এই ব্যঙ্গাত্মক অভিব্যক্তিই লুটেরাদের সাহস বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।


গত ১৪-১৫ বছরে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো লুটে নিতে থাকে ওই সব প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত লোকেরাই। মালিক অংশীদার হিসেবে তারা যেমন অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা ফেরত দেননি, তেমনি আত্মীয়স্বজনদের মাধ্যমেও একই কাজ করেছেন। কখনো আমদানির নামে, কখনো শিল্প গড়ার মেশিনারিজ আমদানির ঋণপত্রের মাধ্যমে, কখনো নামে-বেনামে শিল্প স্থাপনের নামে। এভাবে লুটেরারা শিল্প খাতের বারোটা বাজিয়েছে। কলকাতায় ধরা পড়েছেন পিকে হালদার, যিনি হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়ে গিয়ে পলাতক হয়েছিলেন। এখন শোনা যাচ্ছে, দেশের ৪৪টি রাজনৈতিক শিল্প গ্রুপের হাতে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ। একজনের হাতেই ১০টি আর্থিক ও ব্যাংক। তারাই নামে-বেনামে, ভুয়া কাগজের মাধ্যমে ঋণের নামে মাত্র সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন। ওই শিল্প গ্রুপকে কেউ কিছু বলতে পারে না। এমনকি রাজনৈতিক সরকারও। কেননা, রাজনৈতিক সরকারের সাথেই তাদের দহরম-মহরম।


ঠিক এরই ফাঁকে ১৪-১৫ বছরের কয়েক লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। কেউ বলেন, আট লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে, কেউ বলেন ১১ লাখ কোটি টাকা। কোন অঙ্কটি সঠিক তা আমরা জানি না। তবে, ওই তথ্যে সত্য আছে। ওই টাকা কারা নিয়ে গেছে, সেই তথ্য না জানলেও চলে, কারণ গোটা রাজনীতি ও তার অনৈতিকতাই এর প্রমাণ দেয়। রাজনৈতিক অনৈতিকতার দরুনই একটি বা একাধিক শিল্প গ্রুপ দেশের অর্থনৈতিক পরিণতিকে খাদের কিনারে নিয়ে এসেছে। আজকে যতই বলা হোক যে, আমাদের রিজার্ভ সঙ্কট নেই, আমাদের খাদ্য সঙ্কট নেই, তা হলে প্রতি বছর কেন লাখ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়? রিজার্ভ যদি চাপের মধ্যে নাই থাকে, তাহলে অনেক পণ্যের আমদানি বন্ধ করেছেন কেন? কেন ব্যাংকগুলো ঋণপত্র খুলে পণ্য আমদানি করতে সহায়তা দিচ্ছে না? কেন তাহলে আইএমএফের কাছে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ নিচ্ছে সরকার?
এই সব ‘কেন’র জবাব সরকারকে দিতে হবে। কেন না, সরকার জনগণের বলে দাবি করে এই সরকার। এই সরকার নিজেদের গণতান্ত্রিক সরকার বলেও দাবি করছে; কিন্তু আচরণ করছে অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী সরকারের মতো। এই রকম স্বৈরাচারিতাই হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণীদের বর্ম হিসেবে কাজ করে।
মহামান্য উচ্চ আদালতের পরোক্ষ নির্দেশও যে নির্দেশ সেটি মনে রাখতে হবে দুদককে। বড় বা রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদের ধরুন। তাদের কাছে থাকা টাকাগুলো ফেরত এনে যে সঙ্কটের খাদ সৃষ্টি হয়েছে, তা সামাল দিন। এর কোনো বিকল্প আপাতত নেই। সেই সাথে বন্ধ করুন বেসরকারি ও সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়ার অনৈতিক ও লুটেরা ব্যবস্থা। গত ১২-১৩ বছরে মাত্র ৯০ হাজার কোটি টাকা সরকার বা পিডিবি পেমেন্ট দিয়েছে ওই সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের- তাদের কয়েকটি আবার ভারতীয় মালিকের কেন্দ্র। তারা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেছে ব্যবসার জন্য, তাদের কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার জন্য নয়। তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়ার অর্থ হচ্ছে- তাদের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ। সেটি কি সরকার অনুধাবন করে, নাকি এ দেশের স্বার্থকে বলি দেয়ার জন্যই জনগণের টাকা খোলামকুচির মতো ব্যয় করছে? একদিন না একদিন তাদের সেই জবাব দিতে হবে, হবেই।