Naya Diganta

জন্মদিন উদযাপন-এক বৈচিত্র্যময় আনন্দ উৎসব বনাম বিড়ম্বনা

হৃদয়স্পর্শী শুভেচ্ছাবাণী, চিত্তাকর্ষক উপহারসামগ্রী, উষ্ণ আলিঙ্গন, প্রমোদ, উল্লাস এবং বাহারি রঙের মোমের আলোতে আলোকিত জন্মদিনের সুস্বাদু কেক কেটে সবাই মিলে আস্বাদন করার মধ্যে এক অনাবিল আনন্দ রয়েছে বৈকি। রূপ, রস, গন্ধে ভরা নয়নাভিরাম এই ধরণীতে আগমনের দিনটিকে ফি বছর উৎসবমুখর পরিবেশে স্মরণ করার বিষয়ে কোনো আপত্তি থাকার অবকাশ নেই বটে, তবে স্থান, কাল, বয়স ও পরিস্থিতি ভেদে কদাপি এ উৎসব উদযাপনে বিভ্রাট, বিপত্তি এবং বিড়ম্বনার সৃষ্টি হতে পারে। তাই গত ১২ নভেম্বর আমার তীব্র আপত্তি উপেক্ষা করে এই পড়ন্ত বেলায় সন্তান ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের আয়োজিত আমার জন্মদিন উদযাপন নিয়ে দু’কলম লেখার ইচ্ছা সংবরণ করতে পারলাম না।

জন্মদিন পালনের ইতিহাস বহু প্রাচীন। জানা যায়, পুরাকালে গ্রিকবাসী দেবতাদের অর্ঘ্য দেয়ার মাধ্যমে তাদের জন্মোৎসব পালন করত। অন্যদিকে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ সময়কালে মিসরের অধিবাসীরা ফেরাউনকে দেবতা হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার লগ্নতে নতুন রূপে তার জন্মদিবস উদযাপন করলেও তাদের মধ্যে নিজেদের জন্মদিন পালন করার কোনো প্রচলন ছিল না। আধুনিক যুগের জন্মদিবস পালনের ঠমকে খানিকটা দ্বাদশ শতাব্দীর রোম সাম্রাজ্যের রাজ পরিবারের সদস্যদের জন্মোৎসব আয়োজনের সাথে সাদৃশ্য রয়েছে। পরবর্তীতে রেমকদের হাত ধরে এ তিথির আগমন ঘটে অন্যান্য দেশে।

বর্তমান সময়ে বাহারি কেক, বর্ণময় মোমবাতি ও সুশোভিত আলোকসজ্জায় আচ্ছাদিত জন্মদিন উদযাপনের সূচনা অষ্টাদশ শতাব্দীর জার্মানিতে। বাংলাদেশ তথা ভারত উপমহাদেশে আধুনিকতার নামে মদ্যপান ও উদ্দাম নৃত্য সংযোজিত জন্মদিবস পালন প্রবর্তন অপেক্ষাকৃত নবীন। ইংরেজশাসিত এই উপনিবেশে দিবসটি উদযাপন ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশেই চালু হয়ে থাকে। প্রারম্ভে, ধনী ও উচ্চ শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ধীরে ধীরে তা সমাজের বিভিন্ন স্তরে, অনেক ক্ষেত্রে বিড়ম্বনাপূর্ণ ও কষ্টসাধ্য হলেও এক অপরিহার্য রেওয়াজে পরিণত হয়।

শৈশব-কৈশোর, তারুণ্য, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব এবং বার্ধক্যের আবির্ভাবে জন্মতিথি পালন অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের জীবনে আজ এক সাংবাৎসরিক পার্বণের রূপ নিয়েছে। সেই সাথে জীবনকালের বিভিন্ন অধ্যায়ে এই অনুষ্ঠান আয়োজনে রয়েছে তারতম্য ও বৈচিত্র্য। শিশু যেমন রঙ-বেরঙের বেলুন ও সুস্বাদু কেক এবং খেলনার প্রতি হয়ে থাকে প্রলুব্ধ, তেমনি কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের প্রত্যাশা আধুনিকতম এবং অভিনব ক্রীড়াসামগ্রী ও চিত্তাকর্ষক উপহার লাভ, গল্পগুজবের মধ্যে সময় কাটানো। যুবক-যুবতীরা, বিশেষ করে অবিবাহিত নর-নারীরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন সর্বশেষ ফ্যাশন উদ্ভাবিত ভ‚ষণে সজ্জিত হয়ে পরিমল সুগন্ধির আবরণে সুরভিত হয়ে নিজেদের আকর্ষণীয় ও সর্বোত্তম রূপে তুলে ধরার প্রতিযোগিতায়। অন্য দিকে, এ প্রকার উৎসবে প্রৌঢ়দের মধ্যে খানিকটা আনন্দ দৃশ্যমান হলেও উল্লাসের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। জীবনে চলার পথের বৃহত্তম অংশটুকু পার করে দিয়ে তারা অনেকটাই ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত। তাই হয়তো আনন্দ উচ্ছলতার আধিক্যে দেহ মন আগের মতো উথলিয়ে উঠে না। সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক মঞ্জুরকৃত আয়ুষ্কালের অবশিষ্ট সময়টুকু পাওয়া-না পাওয়া আর দেয়া-না দেয়ার হিসাব কষে জীবনকে আরো কিছুটা অর্থপূর্ণ করার কাজে যত্নবান হওয়াই উত্তম বলে তাদের কাছে প্রতীয়মান হয়।

জন্মতিথি পালনে জীবন সন্ধ্যায় উপনীত হওয়া বৃদ্ধের অনুভূতি বেশ কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। মানবপ্রাণীর শৈশব ও বার্ধক্যের মধ্যে রয়েছে শিশুসুলভ আচরণের বিস্তর মিল। আর তাই তাদের আনন্দ, আবেগ, উচ্ছ্বাস, আকাক্সক্ষা ও প্রগল্ভতা অনেকটাই অভিন্ন। জন্মদিন উপলক্ষে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে কেতাদুরস্ত পরিচ্ছদ পরিধান করে সুস্বাদু কেক ও মজাদার খাবার এবং আড্ডাতে বিভোর হতে তারাও পিছিয়ে নেই। তবে জন্মদিনের সঠিক তারিখটি নিয়েও রয়েছে সব বয়সীর মধ্যে আরেক বিভ্রাট।

শুরুতেই বলেছিলাম, জন্মদিন উদযাপনের সাথে জড়িত রয়েছে বহুবিদ বিড়ম্বনা যার উৎস গ্রথিত আছে সামাজিক বৈষম্য ও ধর্মীয় মতভেদে। একদিকে ধনাঢ্য পরিবারের জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে প্রাচুর্য ও অপচয়ে নিন্দিত, ছড়াছড়ির প্রতিযোগিতা যখন নেত্রগোচর, তখন তাদের অনুসরণে এ দিবস পালনে দরিদ্র পরিবারের কোনো কোনো সদস্যের আত্মাভিমান, একগুঁয়েমি ও নির্বুদ্ধিতা তাদের করে তোলে অধিকতর দরিদ্র। বিভিন্ন ধর্মের বিধিবিধান অনুযায়ী শিষ্টাচারসম্মত জন্মোৎসবের প্রতি কোনো প্রকার নিষেধাজ্ঞা আরোপিত না হয়ে থাকলেও, প্রায় সব ধর্মপ্রচারকই এহেন দিবস পালন নিরুৎসাহিত করে থাকেন। কেননা, ইসলাম ধর্মের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সা:সহ ইহুদি ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের প্রিয়তম নবী হজরত মূসা আ:, ঈসা আ:, এমনকি হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ধর্মগুরু শ্রীকৃষ্ণ এবং গৌতম বুদ্ধের জীবদ্দশায় ও তাদের জীবনাবসানের বহু শতবর্ষ পরবর্তীকালেও জন্মদিবস পালন করার কোনো নির্দেশ বা রীতি খুঁজে পাওয়া যায় না।

পরিশেষে, সার্বিক বিচারে সব তর্ক-বিতর্ক উপেক্ষা করে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সুরে সুর মিলিয়ে স্লোগান তোলা ব্যতীত গত্যন্তর নেই, ‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার জন্মদিবস পালন করা চাই’। আমি ব্যক্তিগতভাবে অপচয় ও অহমিকা পরিহার করে মার্জিত ও শালীনতাপূর্ণ পরিবেশের মধ্যে পরিবারের সদস্য, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের উপস্থিতিতে এহেন উৎসব আয়োজন দূষণীয় মনে করি না, কেননা আপনজনদের অংশগ্রহণে আনন্দোৎসব বৃদ্ধি করে ভ্রাতৃত্ববোধ, ঘনীভূত হয় সহমর্মিতা। অন্য দিকে, বিলাসিতা, অপচয়, প্রাচুর্য প্রদর্শন ও অশালীনতা সীমালঙ্ঘনেরই নামান্তর, যা ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বিস্তৃত করে প্রসার ঘটায় বৈরিতার। সমাজে সৃষ্টি হয় উচ্ছৃঙ্খলতা ও অস্থিরতা। আমাদের ব্রত- আমরা জীবনকে উপভোগ করব শৃঙ্খলাবদ্ধ সীমার মধ্যে অসীমকে খুঁজে, কেননা উচ্ছৃঙ্খল ও সীমাহীন আনন্দ হয় ক্ষণস্থায়ী ও বিপর্যয়কর।