Naya Diganta

‘তুমি চলে গেলে এ শহর কেন কাঁদে’

আলী ইমাম। ২১ নভেম্বর ২০২২ পৃথিবী ছেড়ে চলে যান চিরদিনের জন্য। তাঁর জন্ম ৩১ ডিসেম্বর ১৯৫০

টাঙ্গাইলের মাহমুদ কামালের কাছ থেকে আমি এইমাত্র কনফার্ম করে নিলাম তারিখটা। ওটা ছিল ২০২০ সালের ৩ মার্চ। মাহমুদ কামালরা খুব জমজমাট করে টাঙ্গাইলে সাহিত্যের উৎসব করে। দেশের ও পাশের দেশ ভারত থেকেও কবিরা, সাহিত্যিকরা এসে দু-তিন দিন ধরে হইহই করে কবিতাযাপন করে, সাহিত্য উদযাপন করে। এর আগেও একবার গিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে কয়েকজন আর কলকাতা মৃণাল ফোন করে জানতে চেয়েছে আমিও যাচ্ছি কি না। বলেছি, পড়েছি কামালের হাতে যখন তখন না গিয়েই বা উপায় কী! যাবো। কিন্তু যাবো বললেই তো যাওয়া যায় না। কারণ আমি তখন সাভারের সিআরপিতে রেবেকার সেবায় ব্যস্ত, পর্যুদস্তও। ছয় মাস ধরে আছি পক্ষাঘাতগ্রস্তদের এই হাসপাতালে- সিআরপিতে। খুব ক্রিটিক্যাল রেবেকার অবস্থা। এ একটু ভালোর দিকে যায় তো চোখের পলকে খারাপ। রেবেকাকে আমি চোখে চোখে রাখি। প্রয়োজনে যখন অল্পসময়ের জন্য যাই, তখন স্বস্তিতে থাকি না রেবেকার কথা ভেবে। রেবেকার আবার কিনা হয়ে যায়, পরিচারিকা আর নার্সের সাথে তার সময়টা ঠিকঠাক কাটছে তো! সিআরপিতে আমার অবস্থাটা আরো অনেকের মতো মাহমুদ কামালও জানত। সে-ই চার দিকে খোঁজখবর নিয়ে ঠিক করল যে আমি যাবো আলী ইমামের সাথে ওর গাড়িতে। আলী ইমাম সকালে সিআরপি থেকে আমাকে তুলে নেবে এবং বিকেলে ফেরার সময় আমাকে নামিয়ে দিয়ে যাবে। আলী ইমাম সিআরপি রেবেকাকে নিয়ে আমার সংগ্রামের বিষয়টি জানত! চিনতও রেবেকাকে, যেহেতু রেবেকা ছিল বেতার-টিভির একজন স্পেসাল গ্রেডের রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী। কামালের সাথে কথা হওয়ার পর আলী ইমাম আমাকে ফোন করেছিল, বলেছিল, খুবই ভালো হলো জাহিদ ভাই, বহুদিন আপনার সাথে আড্ডা মারি না, আমাদের টাঙ্গাইলে যাওয়া-আসাটা দারুণ হবে। আপনি সকালে তৈরি থাকবেন। আমি সিআরপি থেকে আপনাকে তুলে নেবো, বিকেলে নামিয়ে দিয়ে যাবো। রেবেকা এখন কেমন আছেন?

আলী ইমাম একজন প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক, মিডিয়াব্যক্তিত্ব, ছয়-সাত শ’ বইয়ের রচয়িতা, অসম্ভব স্মৃতিধর, অমায়িক, ভদ্র ও সবার ওপরে মহা আড্ডাবাজ। ও আমার কবিতা আর গানের খুব গুণগ্রাহী ছিল। আমার কবিতা থেকে বিস্ময়করভাবে লাইনের পর লাইন বলতে পারত; যা আমার নিজের পক্ষে ছিল এবং আছে অকল্পনীয়। আমার আত্মজীবনিক কবিতা ‘বসতি’ থেকে আওড়াতো, ‘মুক্তিযুদ্ধে ছুয়েও দেখিনি কোনো অস্ত্র, ভীরু বলে ভয় ছিল, তবুও তোমার জন্য করেছি তো বহু যুদ্ধ কেবল স্বপ্নের মধ্যে, হে স্বদেশ! তবু কেন যুদ্ধ-উত্তর এই বাংলাদেশে আমি শুধু ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটি! বলত, জাহিদ ভাই, আপনি কি জানেন, সমগ্র বাংলাদেশের গভীর ইতিহাসটি এই দু-তিন পঙ্ক্তির মধ্যে আপনি গুঁজে রেখেছেন !’ আর আড্ডার মধ্যেই মাঝে মধ্যে গেয়ে উঠত, আমার এ দু’টি চোখ পাথর তো নয়’ কিংবা ‘কথা দাও, কথাগুলো ফেরত নেবে না’!

আলী ইমাম, সে দিনের টাঙ্গাইল ভ্রমণ আমাদের অপরূপ হয়েছিল। গাড়িতে চার-পাচ ঘণ্টা আল্লাহর দুনিয়ার সব গল্প আর স্মৃতিকে তুলে এনেছিলাম আমরা। আলী ইমাম, মনে আছে, তুমি, মুনতাসির মামুন আর আমি আরো বহুদিন আগে তিতাস চৌধুরীর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার না কি চাঁদপুরের কলেজের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম অতিথি হয়ে। দারুণ জমেছিল পথে পথে আমাদের আডডা। তিতাসকে নিয়েও জমেছিল খুব। আর আমাদের রেডিও-টিভির আড্ডার কথা বেশি আর কী বলব। আমার মনে হয়, দুনিয়ায় কিছু মানুষ জন্মায় যারা রেডিও-টিভিতে চাকরি করবে বলেই, আড্ডা মারবে বলেই এবং পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে বেড়াবে বলেই জন্মায়। আমরা কিন্তু তা-ই করতে পেরেছি। আশা করা যায়, জান্নাতুল ফিরদৌসেও আমাদের আড্ডার সমস্যা হবে না।
আলী ইমাম, তুমি জানো আমি কাউকেই বিদায় জানাই না। মনে আছে, সেদিন সিআরপিতে আমাকে নামিয়ে দিয়ে যাওয়ার সময় বলেছিলে, জাহিদ ভাই, আবার শিগগির দেখা আর আড্ডা হচ্ছে তো। তোমার মুখটি একটু যেন বিষণœ হয়েছিল। আমি বলেছিলাম হবে। না, ঠিক বলিনি, হলো না! কিন্তু হবে। আমি তো অদৃশ্যে বিশ্বাসীদেরই একজন। হয়তো সে জন্যই বিদায়ের ব্যথাকে দেখি আমি, বিদায়কে দেখি না! আলী ইমাম,আমার আরেকটি লিরিক তুমি মাঝে মধ্যে গুনগুন করতে, সুবীরের গাওয়া, ‘তুমি চলে গেলে এ শহর কেন কাদে’! পরম করুণাময় তোমাকে জান্নাতুল ফিরদৌস দান করুন!