Naya Diganta
বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস

নিউমোনিয়া রুখে যাক সব শিশু বেঁচে থাক

বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস
বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস


বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ নিউমোনিয়া আর নিউমোনিয়ায় যত শিশু মারা যায় তার ৪৬ শতাংশই অপুষ্টির কারণে ঘটে থাকে। অপুষ্টি ছাড়াও বায়ুদূষণ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ। বাংলাদেশে বছরে ২০ হাজারের বেশি শিশু শুধু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং সচেতনতা সৃষ্টি করতে গত ১২ নভেম্বর বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে পালিত হলো বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস।
এক জরিপে দেখা যায়, নিউমোনিয়ার জন্য প্রতি ৩৯ সেকেন্ডে একটি শিশু মৃত্যুবরণ করে। বিশ্বের মৃত্যুর অষ্টম প্রধান কারণ হলো নিউমোনিয়া। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশ এবং উন্নয়নশীল অনেক দেশেই নিউমোনিয়ার কারণে শিশুর মৃত্যুহার অনেক বেশি।
হাসপাতালে নবজাতক ও জন্মের এক মাসের মধ্যে যত শিশু শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় এদের ৩০ শতাংশের রক্তে অক্সিজেনের স্বল্পতা বা হাইপোক্সিমিয়া হয়ে থাকে। এ ছাড়া এই বয়সের যে শিশুরা নিউমোনিয়া সমস্যা ছাড়াও হাসপাতালে ভর্তি হয়ে থাকে তাহলে ৫ শতাংশের রক্তে অক্সিজেন স্বল্পতা রয়েছে।
২০২১ সালে পৃথিবীর নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে ৭৩ মিলিয়ন মানুষ হাইপোক্সিমিয়ায় ভুগেছে। এর মধ্যে শুধু ২২ মিলিয়ন ভুগেছে কোভিডের সময়। ৭৩ মিলিয়নের মধ্যে ১৯ মিলিয়ন ছিল বয়স্ক এবং ৩২ মিলিয়ন ছিল শিশু। অক্সিজেন স্বল্পতা শুধু শ্বাসকষ্টের রোগীর হয়ে থাকে তা নয়, অন্যান্য অসুখেও মানুষের মধ্যে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, যে শিশু পুষ্টিহীনতার শিকার সে শিশুর নিউমোনিয়া বেশি হয়ে থাকে। পুষ্টির ঘাটতি নেই এমন শিশুর শুধু নিউমোনিয়া নয়, অন্যান্য রোগও কম হয়ে থাকে। শিশুর পুষ্টির ঘাটতি মেটাতে মায়ের বুকের দুধ গুরুত্বপূর্ণ। শালদুধ পান করানোসহ নিয়মিত বুকের দুধ খাওয়ানো হলে শিশুর মধ্যে পুষ্টিহীনতার ঘাটতি দূর হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছরের কম বয়সী ৮ লাখ ৮ হাজার শিশু নিউমোনিয়ায় মারা গেছে। ৬৫ বছরের বেশি বয়সী ও আগে থেকে বিভিন্ন অসুস্থতা রয়েছে এমন ব্যক্তিরাও নিউমোনিয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন।
নিউমোনিয়ার জীবাণু শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে শ্বাসনালীর মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করে এবং বায়ুথলিতে এসে বাসা বাঁধে। ফলে, বায়ুথলিগুলোতে শ্লেষ্মা, পুঁজ ও অন্যান্য তরলের সৃষ্টি হয় ও জমা হয়। যার কারণে শ্বাস-প্রশ্বাস কষ্টকর হয়।

কারণ : নিউমোনিয়া বিভিন্ন জীবাণু সংক্রমণের কারণে হতে পারে, যেমন- ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক। শিশুদের নিউমোনিয়ার কারণগুলো বয়স অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন হয়। অর্থাৎ, শ্বাসতন্ত্রের সিনসিটিয়াল ভাইরাসজনিত নিউমোনিয়া, নিউমোকক্কাস, ট্রেপ্টোকোকাস নিউমোনিয়া এবং হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। মাইকোপাজমা নিউমোনিয়া এক থেকে ১৩ বছর বয়সের শিশুদের মধ্যে দেখা যায়। বেশির ভাগ ভাইরাল নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে অ্যাডেনো ভাইরাস, রাইনো ভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, শ্বাসযন্ত্রের সিনসিটিয়াল ভাইরাস এবং প্যারা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের কারণে হয়।
সাধারণত ব্যাক্টেরিয়াজনিত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুরা দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং যারা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয় তাদের লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে দেখা দেয় এবং কম মারাত্মক হয়।

লক্ষণ : শিশুদের মধ্যে লক্ষণগুলো অনেক ক্ষেত্রেই সুনির্দিষ্ট নাও হতে পারে। শিশুদের মধ্যে সংক্রমণের কয়েকটি সাধারণ লক্ষণ হলো-
ক. জ্বর
খ. দুর্বল ভাব
গ. দ্রুতগতির, ঘনঘন ভারী শ্বাস-প্রশ্বাস।
ঘ. শ্বাসের সাথে শোঁ শোঁ শব্দ
ঙ. খাওয়ানোতে অসুবিধা হওয়া
চ. ক্লান্তি বা ঝিমুনি ভাব

চিকিৎসা : নিউমোনিয়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাড়িতেই চিকিৎসা করা যায়। তবে, কখনো কখনো শিশুদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করতে হতে পারে।
হাসপাতালের চিকিৎসার মধ্যে শিরায় বা ইন্ট্রাভেনাস অ্যান্টিবায়োটিক এবং শ্বাসযন্ত্রের থেরাপি (শ্বাস-প্রশ্বাসের চিকিৎসা) অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। গুরুতর ক্ষেত্রে আইসিইউতে চিকিৎসার দরকার হতে পারে।

প্রতিরোধে করণীয় : শিশু বা বাচ্চাদের এই সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস করতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে-
ক. শিশুর প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে স্তন পান করানো অপরিহার্য
খ. ঘরের পরিবেশ শুষ্ক, উষ্ণ গরম ও ভালো বায়ু চলাচল থাকা আবশ্যক
গ. সর্দি, ফ্লু বা অন্যান্য সংক্রমণ রয়েছে এমন ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ এড়িয়ে চলতে হবে
ঘ. সময়মতো টিকা দিয়ে দিতে হবে
শিশুর প্রচুর পরিমাণে বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন। যদি ব্যাকটিরিয়াজনিত নিউমোনিয়া হয় তখন অ্যান্টিবায়োটিকের দরকার হবে। ওষুধগুলো সময়মতো নিতে হবে, যা শিশুকে দ্রুত সুস্থ হতে ও সংক্রমণ ছড়ানো রোধ করতে সহায়তা করবে। শিশুর তাপমাত্রা প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় কমপক্ষে একবার দেখতে হবে। যদি তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের (৩৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) বেশি হয়, তবে জ্বর হ্রাসের জন্য প্যারাসিটামল খাওয়াতে হবে।

মনে রাখবেন : শিশুর বয়স যদি তিন মাসের কম হয়, শিশু যদি একেবারে খাওয়া ছেড়ে দেয়, কিংবা শ্বাস নেয়ার গতি দুই মাসের কম বয়সী শিশুর মিনিটে ৬০ বার, দুই মাস থেকে এক বছরের পর্যন্ত শিশুর প্রতি মিনিটে ৬০ বারের বেশি এবং এক থেকে ১৩ বছর বয়সী শিশুর মিনিটে ৪০ বারের বেশি হলে, শ্বাস নেয়ার সময় বুকের পাঁজর দেবে যায় কিংবা শিশুর ঠোঁট, জিহ্বা নীল হয়ে গেলে শিশুকে অবশ্যই জরুরিভাবে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। কারণ এসবই মারাত্মক নিউমোনিয়া বা মারাত্মক রোগের লক্ষণ। অর্থাৎ যদি শ্বাসকষ্ট হয় বা ঠোঁট, জিহ্বা নীলাভ বর্ণ ধারণ করে তবে জরুরিভাবে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ কিংবা নিকটতম হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
ডা: কামরুজ্জামান কামরুল : সহকারী অধ্যাপক, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা শিশু হাসপাতাল