Naya Diganta

‘রাজনীতিকরা’ কি এখন মানুষের মনের মণিকোঠায় আছেন?

সালাহউদ্দিন বাবর

মাত্র কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন থেকে টেলিফোন করেছিলেন বন্ধু নাসিম। দুই বছর আগে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। সে সময়ের কিছু স্মৃতি ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে তার বহু কথা শুনি। প্রায় ৩০ মিনিট ধরে তিনি ফোনে কথা বলেছিলেন। দুই বছর আগে ঢাকায় আসা নিয়ে কথা বললেন নাসিম। ঢাকায় আসার পর তার চোখ নিয়ে বেশ কষ্ট পেতে হয়েছিল। এমনিতেই তার ডান চোখ কিছু দিন থেকে তাকে কষ্ট দিচ্ছিল। ঢাকা আসার পর সে কষ্টটা আরো দুই কারণে বেড়ে যায়। প্রথমত বায়ুদূষণ, বায়ুতে প্রচুর ধূলিকণা, ধোঁয়া, আর দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে ঢাকার রাজপথে উগ্র লাল হলুদ রঙের প্রতিকৃতি, ব্যানার ফেস্টুন, বিভিন্ন দোকানের অত্যুজ্জ্বল সব সাইনবোর্ড। তার অসুস্থ ডান চোখসহ বাঁ চোখেও এমন বায়ু ও রঙের দূষণ তাকে কষ্ট দিয়েছিল। আমরা নানা দূষণ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, কিন্তু রাস্তার পাশে এমন রঙের দূষণ নিয়ে কখনোই কিছু ভাবিনি। এই রঙের দূষণ নীরবে নিভৃতে সবার অলক্ষ্যেও ঢাকাবাসীর চোখের যে ক্ষতি করেছে তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তথা সিটি করপোরেশন এবং সচেতন মানুষ কিছুই ভাবছেন না।

পক্ষান্তরে রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কিন্তু রাজপথে উগ্র রঙ নিয়ে খেলার অন্যতম ‘প্লেয়ার’। নগরবাসী নিশ্চয়ই দেখছেন রাস্তার পাশে রাজনৈতিক নেতাদের উগ্র লাল হলুদসহ অন্যান্য রঙের পেইন্টিংস সংবলিত কত শত ব্যানার টানানো। এসব সবার অলক্ষ্যে মানুষের চোখকে কষ্ট দিচ্ছে এবং পরিশেষে ক্রমান্বয়ে চোখের কী অপরিসীম ক্ষতি হবে সেটি কেউ উপলব্ধি করছে না। বন্ধুবর নাসিম বললেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোতে এমন উগ্র রঙের ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো যথেচ্ছ করা সম্ভব নয়। যেসব জায়গায় সর্বত্র এবং বিপণী ও মলে কোথাও সেটি একেবারেই অসম্ভব, সেখানে যেসব সাইনবোর্ড রয়েছে, সেগুলোর জন্য যথাযথ নির্দেশনা দিয়ে বিধি-বিধান রয়েছে। এসব বিধি-বিধানের সামান্য কোনো ব্যত্যয় ঘটলেই কঠিন ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের দেশেও এমন বিধি-বিধান হয়তো থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু তা আমরা কেউ জানি না, শুনিওনি। তাই মানা তো দূরের কথা।

ইতোপূর্বে ঢাকায় যে সবুজের সমারোহ ছিল, এখন সেই সবুজের ‘রিপ্লেসমেন্ট’ হয়েছে রাস্তায় রাজনৈতিক নেতাদের উগ্র রঙে বাহারি যত পেইন্টিংসহ ব্যানার, ফেস্টুন বিপণী ও ডিপার্টমেন্টাল শপগুলোর বর্নালী সাইনবোর্ড। বিশেষজ্ঞদের মতে, সবুজ রঙ চোখের উপকারী নীল চোখের পক্ষে আরামদায়ক। আর লাল রঙ চোখের জন্য ক্ষতিকর। চক্ষু বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের চোখের কোষ প্রধানত তিন রকম রঙের হয়, লাল, সবুজ ও নীল। চোখের এই রঙিন কোষের সংখ্যা প্রায় ৬০ থেকে ৭০ লাখ, যার মধ্যে ৪৫ শতাংশই সবুজ রঙের। তাই সবুজ রঙ মানুষের চোখের জন্য খুব স্বস্তিদায়ক। লাল রঙের কোষের সংখ্যা সবচেয়ে কম থাকায় এই রঙ চোখের সামনে থাকলে অপটিক্যাল ইলিউশন বা দৃষ্টিভ্রমের মতো সমস্যা তৈরি হয়। আমরা হয়তো অনেকেই জানি না, রঙের সাথে মানুষের ঘুমেরও সম্পর্ক আছে। গবেষণায় দেখা গেছে, চোখের ঘুম-ঘুম ভাব কেড়ে নিয়ে মস্তিষ্ককে সজাগ করে তুলতে পারে একটি বিশেষ রঙ। আর সে রঙটির নাম ‘সায়ান’, সহজ করে বলতে গেলে, সবুজ ও নীল মেশানো যে রঙ হয় সেটা। জীব বিজ্ঞানীদের মতে, এই রঙের মধ্যে এমন একটি গোপন উপাদান আছে, যা কি না এক ঝটকায় মানুষের ঘুম তাড়িয়ে মস্তিষ্ককে সজাগ করে তুলতে পারে। গবেষকরা জানিয়েছেন যে, চোখের সামনে এই সায়ান রঙ বেশি মাত্রায় থাকলে মানুষের ঘুম কেড়ে নেয়। যাই হোক রঙের যে প্রভাব মানুষের জীবনে রয়েছে সেটি স্বীকার করতেই হবে।

বলা হয়েছে, সবুজ রঙ অত্যন্ত উপকারী আর নীল স্বস্তিদায়ক। বিজ্ঞানীরা জানান, সবুজ গাছপালা সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নিয়ে অক্সিজেন ছাড়ে। এ জন্যই প্রকৃতির সবুজের সান্নিধ্য আমাদের ভালো লাগে। তবে শুধু প্রকৃতির সবুজ গাছপালাই নয়, এমন অনেক রঙ আছে, যা মনে প্রশান্তি এনে দেয়। এসব রঙের মধ্যে অন্যতম হলো সাদা, হালকা নীল ও গোলাপি। এই কুল কালারগুলো চোখে অপটিক নার্ভের মধ্য দিয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছে ইতিবাচক উদ্দীপনার সৃষ্টি করে যা মনকে প্রশান্ত করতে সহায়তা করে।
‘সবুজায়ন’ বর্তমান বিশ্বের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ও উপযোগী একটি পদ্ধতি। বর্তমান পৃথিবী উষ্ণতাজনিত কারণে মরুময়তার দিকেই ধাবিত হচ্ছে যা পৃথিবীর সব জীবকুলের জন্য ধ্বংসাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে। ক্রমাগত বৃক্ষনিধনে আমাদের দেশসহ পৃথিবীকে রক্ষার দায়িত্ব কোনো একটি দেশের বা একটি জাতির একার নয়; বরং এই দায়িত্ব সব রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের। আমাদের কিছুসংখ্যক নাগরিকের মধ্যে যেমন সচেতনতা রয়েছে, তেমনি সমাজে এর উল্টো চরিত্রের মানুষের সংখ্যাও কম নয়। তারা পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে মাথা ঘামাতে নারাজ। আগামী প্রজন্ম ঝুঁকির মধ্যে আছে এবং এ জন্য আমাদের বর্তমান প্রজন্মের বিলাসী-বিশৃঙ্খল জীবন যাপন অনেকটাই দায়ী, সেটি বুঝতে তারা নারাজ। তারা এই বিপর্যয়ের দায় এবং আগামী প্রজন্মকে রক্ষার দায়িত্ব সৃষ্টিকর্তার ওপর ছেড়ে দিয়ে অর্থসম্পদ বৃদ্ধি করে বিলাসী জীবন নিয়ে ব্যস্ত। পরিবেশ ও প্রকৃতির সাথে মানুষে মানুষে আচরণগত যেমন পার্থক্য বিরাজ করছে, তেমনি আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার সাথে যুক্ত, তাদেরও অনেকে ‘রিল্যাক্সড এবং রিলেক্ট্যান্ট’। কোনো ব্যক্তি যখন তার নিজের সুরক্ষার ব্যাপারে অসচেতন হয়, তখন ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেই ব্যক্তি, বড় জোর ওই ব্যক্তির পরিবার। কিন্তু কিছু ব্যক্তি যখন একটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব স্কন্ধে নেয়, তখন তাদের গোটা জাতির সুরক্ষার কথা ভাবতে হয়। আমরা বা আমাদের প্রশাসনের দায়িত্বশীলরা জাতি সুরক্ষার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছেন কি? যদি করতেন তবে আজকের এ পরিণতি হতো না।

গবেষণায় উঠে এসেছে, নানা ধরনের দূষণের জন্য বাংলাদেশে প্রতি বছর মারা যায় প্রায় সোয়া লাখ মানুষ। এভাবে প্রতিটি বিভাগের বড় শহরে, শিল্প এলাকায় বায়ু ও পরিবেশ দূষণ বাড়ছে। বিশেষ করে বিচার বিবেচনাহীন কর্মকাণ্ড, ইটভাটায় বর্জ্য পোড়ানো, কলকারখানা ও যানবাহনের কালো ধোঁয়া দূষণের জন্য দায়ী। তাই এসব বোধ জাগ্রত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে সব বড় শহরে বহুসংখ্যক ‘গ্রিন স্পট’ তৈরি করা। বহুদিন থেকে আমাদের দেশে প্রতি বছর, তা বছরের মধ্যভাগে, কোটি কোটি টাকা খরচ করে বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ পালন করা হয়। সে সময় সারা দেশে বহু গাছ লাগানো হয়ে থাকে। কিন্তু ওই পর্যন্ত, এসব বৃক্ষের ইতিবৃত্ত খুবই করুণ। কেবল গাছই লাগানো হয়, কিন্তু কোনো পরিচর্যা নেই। অর্থাৎ কতটা গাছ বাঁচল, কতটা গাছ গরু ছাগলে খেল, বিরূপ আবহাওয়ার কারণে কতগুলো মরে গেল, তার কোনো শুমারি হয় বলে জানি না। হয়তো এভাবেই দেশের গরিব মানুষের ট্যাক্সের পয়সা দরিয়ায় ফেলা হচ্ছে। সেজন্য সত্যিকার সবুজায়ন নীতি গ্রহণ শুধু উচিত নয়, জরুরি। শুধু রাজধানী ঢাকার পরিবেশের কথা ভেবেই পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনের কর্মীরা হতাশ ও শোকে মুহ্যমান। কপ-২৬ এর পর মিসরে হয়ে গেল এবার কপ-২৭ সম্মেলন। আমাদের ভেবে দেখা দরকার, কপ-২৬ এর যেসব সুপারিশ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তার কতটার কী হয়েছে এর পর্যালোচনা করা। অথচ এটি পর্যালোচনা করে কাজ করার সাথে আমাদের জীবন মরণের সম্পর্ক জড়িত।

আসলে পরিবেশসংক্রান্ত বিষয়ের সাথে দেশের সর্বস্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। সব মানুষের মধ্যে এই বোধ জাগাতে হবে যে, পরিবেশের অবক্ষয় রোধ করতে না পারলে আমাদের অস্তিত্ব বিলীন হতে পারে। তা ছাড়া পরিবেশের অবনতি রোধের এমন কর্মসূচির সাথে দারিদ্র্য বিমোচন করার সাথে বৃক্ষরোপণ ব্যাপক সহায়ক। বৃক্ষ মানুষের পরম ও প্রকৃত বন্ধু। বৃক্ষ মানুষকে মহৎ করে তোলে, শুদ্ধতা অর্জনের জন্যও বৃক্ষবান্ধব হওয়ার বিকল্প নেই। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যদি বৃক্ষপ্রেমী হিসেবে তৈরি করা যায় তবে তার বহু ইতিবাচক দিক রয়েছে। যেমন দারিদ্র্য বিমোচনের কথা বলা হয়েছে। যদি মানুষ শাল, সেগুনসহ মূল্যবান সব কাঠের গাছ রোপণ করে, তবে তার রিটার্নে প্রচুর অর্থ আসতে পারে। সেই সাথে পরিবেশ সুরক্ষায় অবদান রাখবে। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যদি বৃক্ষরোপণ করার ক্ষেত্রে সজাগ করা যায় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে দেশ ভরে উঠবে সবুজে সবুজে। বৃক্ষরোপণে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবেও উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। এতে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায় বৃক্ষরোপণের কোনো বিকল্প নেই।

এই মর্মে বহু অভিযোগ রয়েছে, দেশের সংবিধান সুরক্ষার সাথে জড়িত ব্যক্তি ও ব্যক্তিবর্গ, এ ব্যাপারে তাদের হেলা অবহেলার কোনো শেষ নেই। পরিবেশ রক্ষার জন্য সংবিধানের যে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে, তা নিয়েও বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বলা যায়, এ ক্ষেত্রেও অপরিসীম অবজ্ঞা অবহেলা করা হচ্ছে। সংবিধানের সেই অনুচ্ছেদটি এখানে সন্নিবেশিত করা হলে সেটি খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে করি না। শাসনতন্ত্রের ১৮ক ধারায় রয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভ‚মি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ কিন্তু আজকে বিশ্বে পরিবেশ, জলবায়ু নিয়ে যে মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন, যেসব দেশ এই বিপর্যয়ের শীর্ষে রয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। দেশের কর্তৃপক্ষ বহু আগে থেকে এ নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তবে আজ দেশ এমন অবস্থার মুখোমুখি হতো না।

যাক, ফিরে আসি রাজধানী ঢাকার রাজপথের দুষ্ট রঙবাহারের প্রসঙ্গে। উগ্র লাল ও হলুদ রঙেরা যত্রতত্র যেভাবে নীরবে আঁখি গোলকের ক্ষতি করছে, এমন সব ব্যানার প্রতিকৃতির একটি ভিন্ন ব্যাখ্যাও করা যায়। সবাই জানেন, আগে রাজনৈতিক নেতাদের অবস্থান ছিল মানুষের মনের গহিনে। তারা সেখানে স্থান করে নিয়েছিলেন দশ ও দেশের প্রতি তাদের অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি, ন্যায়নিষ্ঠতা, অপরিসীম ভালোবাসার গুণে এবং জনগণের কল্যাণে ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। কিন্তু এখন সেই ‘চল’ অচল হয়ে গেছে। রাজনীতিক নেতাদের যে গুণাবলির কথা ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে, আজকে রাজনীতিকদের অবস্থান যোজন যোজন দূরে। তাই জনগণের মনে নয় রাস্তাতেই তাদের রঙবেরঙের প্রতিকৃতি ঝুলছে। এসব প্রতিকৃতি নিয়ে তারা যাই মনে করুন না কেন। এগুলো কারো মনে কোনো আগ্রহ-অনুরাগ সৃষ্টি করে না। ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী, বঙ্গবন্ধু, জিয়া চলে গেছেন বহু আগে। কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাদের স্মৃতি কেউ ভুলে যায়নি, যাবেও না। এ দেশের ইতিহাসে তারা অমর অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

ndigantababar@gmail.com