Naya Diganta

খেরসনের পুনর্দখল ইউক্রেনের কাছে কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ?

রাশিয়া বলছে তারা খেরসন শহর থেকে ৭০,০০০ বেসামরিক লোককে সরিয়ে নিয়েছে

খেরসনের দিকে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। অন্যদিকে শহরটির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে তাদের প্রতিরক্ষা জোরদার করছে রুশ সৈন্যরা।

ইউক্রেনের দক্ষিণের এই শহরটি নিয়ন্ত্রণের জন্য দুই পক্ষই ভীষণভাবে তৎপর। তবে সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন খেরসনের যুদ্ধ খুবই রক্তক্ষয়ী এক লড়াই হবে।

খেরসন কোথায়, এর ভৌগলিক অবস্থান কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
যুদ্ধের আগে খেরসনের জনসংখ্যা ছিল কম-বেশি ৩ লাখ ৮০ হাজার। কৃষ্ণ সাগর উপকূলের কাছে এই শহরটির অবস্থান নিপ্রো নদীর তীরে ।

এটি ক্রাইমিয়া উপদ্বীপের খুব কাছে যেটি ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের কাছ থেকে দখল করে নিজের অংশ করে নিয়েছে। ক্রাইমিয়ায় এখন রাশিয়ার বেশ কতগুলো সামরিক ঘাঁটি রয়েছে।

‘খেরসন হলো ক্রাইমিয়ার প্রবেশদ্বার’ বলেন মারিনা মিরন, লন্ডনে কিংস কলেজের প্রতিরক্ষা বিষয়ক গবেষক।

‘এই যুদ্ধে ইউক্রেনের এখন মূল লক্ষ্য ক্রাইমিয়ার পুনর্দখল। সুতরাং খেরসনের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে নিতে পারলে সেই লক্ষ্য অর্জনে তাদের জন্য পথ খুলে যাবে।’

খেরসনের ভৌগলিক অবস্থান কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন সাবেক ব্রিটিশ সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ফোবস্‌ ম্যাকেঞ্জি, যিনি গোয়েন্দা বিষয়ক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাকেঞ্জি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসেসের প্রধান নির্বাহী।

‘নিপ্রো নদীর নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই নদীটি ইউক্রেনের একদম কেন্দ্র বরাবর বয়ে গেছে’ তিনি বলেন।

খেরসনের প্রতীকী গুরুত্ব
সামরিক গুরুত্বের পাশাপাশি প্রতীকী গুরুত্বও উল্লেখযোগ্য। শহরটি ইউক্রেনের একমাত্র আঞ্চলিক রাজধানী যেটি রাশিয়া দখল করে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।

মার্চের প্রথম দিকে রাশিয়া খেরসন দখল করে নেয়। সম্প্রতি খেরসন এবং ইউক্রেনের আরো তিনটি অঞ্চলকে রাশিয়া তাদের নিজের অংশ বলে ঘোষণা করেছে।

সুতরাং মিজ মিরন বলেন, ইউক্রেনের সৈন্যরা খেরসন পুনর্দখল করতে পারলে একটি বার্তা যাবে যে যুদ্ধের হাওয়া এখন ইউক্রেনের পালে।

‘ইউক্রেনে পশ্চিমা বিশ্বকে দেখাতে পারবে যে তাদেরকে দেয়া আর্থিক এবং সামরিক সহযোগিতা বিফলে যাচ্ছে না।’

তবে রুশ সৈন্যরাও খেরসনের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে মরিয়া। সম্প্রতি ইউক্রেনীয় সৈন্যদের পাল্টা হামলায় তারা দেশের পূর্বাঞ্চলে প্রায় ৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার জায়গা হারিয়েছে।

‘রাশিয়ার এখন একটি বিজয় খুবই দরকার’ বলেন মিজ মিরন। ‘রাশিয়াকে দেখাতে হবে তারা ইউক্রেনীয়দের পাল্টা হামলা প্রতিরোধে সক্ষম।’

কত দ্রুত শুরু হবে খেরসনের লড়াই?
উত্তর এবং দক্ষিণ থেকে খেরসন শহরে রুশ সৈন্যদের সরবরাহ লাইন ছিন্ন করার লক্ষ্যে নিপ্রো নদীর ওপর সেতুগুলোতে ইউক্রেনের সৈন্যরা সম্প্রতি বেশ কয়েক দফা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে।

উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্ব দিক থেকে ধীরে ধীরে তারা খেরসনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ‘ইউক্রেনের পরবর্তী সময়ের প্রধান টার্গেট নিপ্রো নদীর উজানের শহর বেরিস্লাভ’ বলেন মিজ মিরন।

‘ওই শহরটির নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলে সেখানে থেকে তারা খেরসনের ওপর সহজে হামলা চালাতে পারবে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এমনটা ঘটতে পারে।’

তবে গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের স্থলযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক বেন ব্যারি মনে করেন ইউক্রেনীয় সৈন্যরা খুবই ধীর গতিতে খেরসন শহরের দিকে এগুচ্ছে।

‘তাদেরকে এখনো খেরসনের উত্তরে রুশ ফ্রন্ট-লাইন ভেঙ্গে ঢুকতে হবে’ তিনি বলেন। ‘জায়গাগুলো এখন বেশ কর্দমাক্ত। ফলে তাদের অগ্রাভিযানের গতি কমে যেত পারে। এমনকি রুশ প্রতিরোধ ভেঙ্গে খেরসন শহরে ঢোকা তাদের পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে।’

রাশিয়া কি খেরসন থেকে সরে যাচ্ছে?
রাশিয়া বলছে তারা খেরসন শহর থেকে ৭০,০০০ বেসামরিক লোককে সরিয়ে নিয়েছে। এমনকি প্রশাসনিক কর্মকর্তাদেরও সরিয়ে নেয়া হচ্ছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

রাশিয়া খেরসনে যে বেসামরিক প্রশাসন নিয়োগ দিয়েছে তার উপ-প্রধান কিরিল স্ট্রেমুসভ বলেছেন নিপ্রো নদীর পশ্চিম তীরে খেরসনের কিছু জায়গা থেকে রুশ সৈন্যরা পিছিয়ে যেতে পারে। ‘সম্ভবত আমাদের সৈন্যরা নদীর পূর্ব তীরে চলে যেতে পারে।’

তবে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী সন্দেহ করছে এ ধরণের সৈন্য প্রত্যাহারের কথা আসলে রুশদের একটি কৌশল হতে পারে।

ম্যাকেঞ্জি ইন্টেলিজেন্সের হিসাব মতে পাঁচ থেকে ১০ হাজার রুশ সৈন্য খেরসন শহরের প্রতিরক্ষায় মোতায়েন রয়েছে।

গবেষণা সংস্থা দি ইন্সটিটিউট অব স্টাডি অফ ওয়ার বলছে রুশ সৈন্যরা খেরসন শহরের ভেতর ছাড়াও শহরের উত্তর-পশ্চিমে তাদের অবস্থান শক্ত করছে।

‘নানা ধরণের পরস্পরবিরোধী খবর রয়েছে’ বলছেন বেন ব্যারি। ‘রাশিয়া খেরসন থেকে তাদের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সরিয়ে নিচ্ছে, কিন্তু একই সময়ে তারা সেখানে ছত্রীসেনা এবং নৌসেনা মোতায়েন করছে।’

কত রক্তক্ষয়ী হবে খেরসনের যুদ্ধ?
ফোবস্‌ ম্যাকেঞ্জি মনে করেন খেরসন পুনর্দখলে অভিযান শুরু করলে ইউক্রেনের সৈন্যদের অনেক মূল্য দিতে হতে পারে। ‘ঘরে ঘরে লড়াই হবে। ফলে বহু মানুষ মারা যাবে’ তিনি বলেন। ‘সম্ভাব্য চিত্র খুবই ভয়ঙ্কর।’

তবে বেন ব্যারি মনে করেন রাস্তায় রাস্তায়, ঘরে ঘরে লড়াই নাও হতে পারে।

‘দু পক্ষেরই বিভিন্ন বিকল্প রয়েছে’ তিনি বলেন। ‘রুশ সৈন্যরা ইউক্রেনীয়দের অগ্রযাত্রা ঠেকিয়ে রাখতে লড়াই চালিয়ে এক পর্যায়ে পিছু হটে যেতে পারে। ইউক্রেনীয়রা শহরে না ঢুকে শহরটি ঘেরাও করে রুশদের সরবরাহ লাইন বন্ধ করে দেয়ার কৌশল নিতে পারে।

‘আসলে কোন পক্ষ কী কৌশল নেয়ার কথা ভাবছে তা ধারণা করা এখন প্রায় অসম্ভব।’