Naya Diganta

সর্বত্র দ্বৈত ব্যবস্থায় জনস্বার্থ পরাভূত

বাংলাদেশের সংবিধানে যেসব মৌলিক অধিকারের বিষয় উল্লিখিত হয়েছে এর মধ্যে অনন্য ও অন্যতম হলো অনুচ্ছেদ ২৭ এ বিবৃত আইনের দৃষ্টিতে সমতা অর্থাৎ দেশের সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। অনুচ্ছেদটির মর্মার্থ হলো শ্রেণী, পেশা, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, শপথের অধীন-শপথবিহীন, পদাধিকারী-পদবিহীন, ক্ষমতাসীন-ক্ষমতাহীন, ধনী-দরিদ্র, অগ্রসর-অনগ্রসর, নারী-পুরুষ ভেদ, ধর্ম, গোষ্ঠী, গোত্র, বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের আশ্রয় লাভের ক্ষেত্রেও সমঅধিকারী। সংবিধান স্বীকৃত এ মৌলিক অধিকারটির কারণেই উল্লিখিত ভেদাভেদ সত্ত্বেও দেশের প্রচলিত আইনে সংঘটিত অপরাধের বিচার সবার ক্ষেত্রে সমআইন ও সমাদালতে অনুষ্ঠিত হয়। এখানে ভেদাভেদের ভিত্তিতে শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে ভিন্নতর কিছু প্রত্যাশার সুযোগ বারিত। রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে প্রজাতন্ত্রের কর্মে যারা নিয়োজিত তাদের বিষয়ে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১(২) এ উল্লিখিত হয়েছে সব সময়ে জনগণের সেবা করার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য। অনুচ্ছেদটির দফা (১) এ উল্লিখিত হয়েছে সংবিধান ও আইন মেনে চলা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিক দায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের কর্মের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্ম অর্থ অসামরিক বা সামরিক ক্ষমতায় বাংলাদেশ সরকার সংক্রান্ত যেকোনো কর্ম, চাকরি বা পদ এবং আইনের দ্বারা প্রজাতন্ত্রের কর্ম বলে ঘোষিত হতে পারে এরূপ কোনো কর্ম।’

রাষ্ট্র ও সরকার সংশ্লেষে যেসব ব্যক্তি জনগণের অর্থে লালিত রাষ্ট্রীয় কোষাগার হতে বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে থাকেন তারা সবাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের মধ্যে যারা শপথের অধীন তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রজাতন্ত্রের অপরাপর কর্মচারীদের চেয়ে অধিক। শপথের অধীন ব্যক্তিরা শপথ গ্রহণ ব্যতিরেকে পদে আসীন হন না আবার পদ হতে বিদায় নেয়ার সাথে সাথে শপথ হতে অবমুক্ত হন। শপথের অধীন ব্যক্তিদের মধ্যে সংসদ সদস্য ব্যতীত অপরাপর সবাইকে শপথগ্রহণ করাকালীন অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ব্যক্ত করতে হয় যে, তারা সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করবেন এবং ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সবার প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করবেন। প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিম কোর্টের অপরাপর বিচারককে সংবিধানের পাশাপাশি আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের বিষয় ব্যক্ত করতে হয়।

প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত শপথের অধীন ও শপথবিহীন ব্যক্তিদের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো দেশের মানুষের সেবা প্রদানে সদাসর্বদা সচেষ্ট থাকা। কিন্তু বাস্তবে কি তারা তাদের ওপর অর্পিত সংবিধান নির্দেশিত দায়িত্ব একাগ্রতা, আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও সততার সাথে পালন করছেন? এ বিষয়ে দেশের যেকোনো সাধারণ মানুষজনকে জিজ্ঞাসা করা হলে যে জবাব পাওয়া যায় তা হলো তারা প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রেই দক্ষিণা বা উপরি প্রদান ব্যতিরেকে সেবা পান না। সা¤প্রতিক সময়ে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের মধ্যে সবার বেতন-ভাতা এবং বিশেষের সুযোগ-সুবিধা যে হারে বৃদ্ধি করা হয়েছে তাতে কোনো ধরনের অবৈধ উপার্জন ব্যতিরেকেই সুন্দর ও সচ্ছলভাবে জীবনযাপন সম্ভব; কিন্তু দুর্নীতি বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালসহ দেশের বিভিন্ন গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে জানা যায় বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধার বৃদ্ধি দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের বিষয়ে প্রায়ই দেশের জনমানুষকে বলতে শোনা যায় তাদের একটি বড় অংশের কাছে নিজ সেবাই মুখ্য হওয়ায় সাধারণ জনমানুষের সেবা তাদের কাছে নিছক গৌণ। আর এ কারণেই দেখা যায় তাদের চলাচলের সময় নিজ যানবাহনে নিরাপত্তা রক্ষীর অতিরিক্ত সামনে-পিছনে নিরাপত্তা প্রহরীর এক বা একাধিক গাড়ি। বর্তমানে আমাদের দেশসহ বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সঙ্কটের কারণে বিভিন্ন দেশে যখন সাশ্রয়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে আমাদের দেশের তথাকথিত সুবিধাভোগী পদধারীদের ক্ষেত্রে তা এখনো পালিত হচ্ছে না।

বাংলাদেশে ক্ষমতাবান পদধারীরা তাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থার উদ্ভাবন করেছে। তাদের জন্য বিমানবন্দরে রয়েছে ভিআইপি লাউঞ্জ। তারা বিদেশে যাওয়া ও বিদেশ হতে আসার সময় তাদের একাধিক ঘনিষ্ঠজন কোনো ধরনের অর্থ প্রদান ব্যতিরেকেই ভিআইপি লাউঞ্জের সুবিধা গ্রহণ করেন। অথচ অন্যান্য দেশে এ ধরনের ভিআইপি লাউঞ্জের পরিচালনা বেসরকারি সংস্থার ওপর ন্যস্ত এবং অর্থ প্রদান ব্যতিরেকে কারো পক্ষে ভিআইপি লাউঞ্জের সুবিধা গ্রহণের সুযোগ নেই। আমাদের দেশের সাধারণ যাত্রী যাদের মধ্যে অন্যতম হলো প্রবাসে কর্মরত শ্রমিক, তাদের ঘনিষ্ঠজন তাদের বিদেশ যাওয়া ও বিদেশ হতে আসার সময় এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে প্রবেশ করতে চাইলে জনপ্রতি ৩০০ টাকা হারে ফি দিতে হয়। প্রবাসে কর্মরত এ শ্রমিকদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার কারণেই আজ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ এবং আমদানি ব্যয় মিটানো অনেকটা সহজতর। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ হলে বিমানবন্দরে সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তথাকথিত ভিআইপিদের তুলনায় প্রবাসে কর্মরত শ্রমিকদের অগ্রাধিকার দেয়া হতো; কিন্তু আমাদের দেশে সুশাসন ও আইনের শাসনের অনুপস্থিতিতে এবং সংবিধান ও আইনের বিধানাবলির অবজ্ঞায় ও উপেক্ষায় প্রবাসে কর্মরত শ্রমিকরা নিগৃহীত; অপর দিকে তথাকথিত ভিআইপিরা বাড়তি সুবিধা ও সম্মান পাচ্ছেন সমাদৃত হচ্ছেন। রাজধানী ঢাকা শহরে চলাচলের ক্ষেত্রে দেখা যায় নগর পরিবহনের নামে ফিটনেসবিহীন যেসব লক্কড়ঝক্কড় বাস চলাচল করে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের রাজধানী শহরে এমন ধরনের বাসের উপস্থিতি চোখে পড়ে না। আমাদের দেশে সরকারের পদস্থ ব্যক্তি এবং ধনাঢ্যরা শহরে চলাচলরত সাধারণ বাসে যাতায়াত করেন না। আর তাই সাধারণ বাসে যাতায়াত বা চলাচলে কী ধরনের দুর্ভোগ তা তারা অনুধাবনে অক্ষম। এ কারণেই দীর্ঘ দিনযাবৎ এ সমস্যাটির লাঘব না হয়ে উত্তরোত্তর আরো কঠিন হচ্ছে। পৃথিবীর উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহে সাধারণ মানুষজনসহ সমাজের সব শ্রেণী পেশার মানুষের যাতায়াত বা চলাচলের জন্য সাশ্রয়ী বাহন যেমন পাতাল বা উড়াল রেল এবং আধুনিক ও মানসম্মত বাসের ব্যবস্থা রয়েছে। এগুলোতে চলাচল বা যাতায়াত সবার জন্যই এক দিকে যেমন নিরাপদ ও আরামদায়ক অপর দিকে স্বল্প সময়ে ও স্বল্প ব্যয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াতে সহায়ক। আমাদের রাজধানী ঢাকায় উত্তরা থেকে কমলাপুর অবধি উড়াল রেল এবং এয়ারপোর্ট থেকে গাজীপুর অবধি বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। আশা করা যায় আগামী এক বছরের মধ্যে প্রকল্প দু’টির কার্যক্রম জনসাধারণের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের আদলে এ প্রকল্প দু’টি বাস্তবায়নের কার্যক্রম গ্রহণ করা হলেও এর সুফল নির্ভর করছে দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও কাক্সিক্ষতমানের সেবার ওপর। এ প্রকল্প সফল হলে এতে দ্বৈত ব্যবস্থার অবসানে সবার জন্য স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল নির্বিঘ্ন হবে যা অনুরূপ প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সরকারকে উৎসাহ জোগাবে।

আমাদের দেশে উন্নত মানের বিশেষায়িত হাসপাতাল থাকলেও দেশের ক্ষমতাবান ও বিত্তবানরা নেহাত বাধ্য না হলে দেশের হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করেন না। এমনকি নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ক্ষেত্রেও দেখা যায় এরা ভারত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রের আমাদের দেশের মতো উন্নত মানের বিশেষায়িত হাসপাতালের মুখাপেক্ষী। আর জটিল রোগ বা অস্ত্রোপচারের সম্ভাবনা থাকলে দেশের হাসপাতালগুলোর ওপর তারা একেবারেই আস্থাহীন। ক্ষমতাবান ও বিত্তবানদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থা না থাকার কারণে তারা ও তাদের অনুসরণে চিকিৎসা প্রত্যাশীদের একটি বড় অংশ দেশে চিকিৎসা গ্রহণ না করে উল্লিখিত দেশগুলোর হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। তাদের এ নির্ভরশীলতার কারণে আমাদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বিপুল পরিমাণ অর্থ যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যতিরেকেই বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণে ব্যয় হচ্ছে। অথচ দেশের ক্ষমতাবান নীতিনির্ধারকরা যেকোনো ধরনের অসুস্থতায় দেশের চিকিৎসক ও হাসপাতালের ওপর নির্ভরশীল হয়ে দেশে চিকিৎসা গ্রহণ করলে তাদের অনুসরণে দেশের জনমানুষের যে অংশটি বিদেশে চিকিৎসা ও হাসপাতালের শরণাপন্ন হয় তা থেকে তারা বিমুখ হতেন। তবে এ বিষয়ে আমাদের দেশের চিকিৎসক ও সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনার সাথে যারা জড়িত তারা যদি কাক্সিক্ষতমানের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণে প্রতিবন্ধকতাগুলো অবসানে উদ্যোগী হন তা দেশের জন্য ইতিবাচক সুফল বয়ে আনবে। চিকিৎসাসেবা দেশের নাগরিকের মৌলিক অধিকার। চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি অপরাপর সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে দেশের সাধারণ জনমানুষের জন্য কাজ করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত রাষ্ট্রের কোষাগারের বেতনভোগী প্রতিটি ব্যক্তির কর্তব্য। সে কর্তব্য পালনে এদের যদিও অবিচল থাকার কথা কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের সাথে দেশের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায় শীর্ষ আমলাদের দু’জনের জন্য পৃথক সুইমিংপুলের সুবিধাসহ ৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে দু’টি পৃথক ভবন নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। আমলাদ্বয়কে তাদের এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন হতে নিবৃত্ত করা না গেলে এর পরিধি বিস্তৃত হবে এবং বিভিন্ন বাহিনী ও দফতর প্রধানদের পক্ষ হতে অনুরূপ বায়না দেশের নীতিনির্ধারকদের জন্য অস্বস্তির জন্ম দেবে। দ্বৈত ব্যবস্থার কারণে জনস্বার্থের পরিবর্তে দেশের নীতিনির্ধারকসহ ক্ষমতাবানরা নিজ স্বার্থের প্রতি অন্ধ থাকলে দেশের স্বার্থসহ সামগ্রিক জনমানুষের স্বার্থ যে বিঘ্নিত হবে অন্তত এ উপলব্ধি হতে দ্বৈত ব্যবস্থা অবসানে ক্ষমতাবানদের উদ্যোগী হওয়া প্রত্যাশিত নয় কি?

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
iktederahmed@yahoo.com