Naya Diganta

সংসার এক শিক্ষালয়

সংসার এক শিক্ষালয়

ছোট্ট এ জীবনে শেখার শেষ নেই। জীবন চলার পথে শেখার দৃষ্টি রাখলে প্রতিনিয়তই শেখা যায়। এ জন্য প্রথমেই দূর করতে হবে ইগোর তাড়নাকে। ফরাসি কবি নিয়েৎশে বলেছিলেন, ‘আমি জীবনে যত উপরে যাই, যত কিছুই করি,একটি কুকুর সবসময়ই আমার পিছু পিছু আমাকে তাড়া করে। আর সে কুকুরটি হলো আমার ইগো।’ মানুষ ইগো সংবরণ করতে পারলে যে কিছু শিখতে পারে তার প্রত্যহ প্রমাণ মেলে আমাদের সংসার শিক্ষালয় থেকে।
এ শেখার ক্ষেত্র আমাদের চার পাশ- আমাদের প্রকৃতি- সমাজের ছোট-বড়, অগ্রজ-অনুজ সব কিছু। আমি আজো শিখছি, প্রত্যহ শিখছি, সবখান থেকে শিখছি। জীবনটাই যেন শেখার জন্য। এই শেখার জীবনে নিজকে শিক্ষক ভাবার আগে শিক্ষার্থী ভেবে পুলকিত হই। কারণ শিক্ষকের একটি দায়ভার রয়েছে; কিন্তু শিক্ষার্থী এ থেকে মুক্ত। সে শুধু আহরণকারী। আহরণ করে করে ইচ্ছেমতো সে তার পকেট ভারী করতে পারে। সংসার আমাদের সেই শিক্ষালয়। যেখান থেকে শুধু আহরণ করা যায়। এর জন্য চাই শুধু দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারতা। এই যেমন সেদিন বড় বৌমা এসে দেখল আমার ছাদবাগানের করুণ দশা! টবের মাটিগুলো শক্ত হয়ে আছে। চুপচাপ স্বল্পভাষী বৌমা আমার ঘর থেকে দুটো কাঁটাচামচ এনে ধীরে ধীরে মাটিগুলো নিড়িয়ে দিলো। যেখানে আমি ভাবছিলাম একটি নিড়ানি কিনতে হবে বোধ হয় সেখানে এত সহজ সমাধান! তারপর আরো কী করল; সাইনেক্সের খালি বোতলে হলুদের গুঁড়া গোলানো পানি ভরে সব গাছে ¯েপ্র্র করে দিলো অনায়াসে। এবারো আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আসলে আমি কি কাজ জানি না? আমাকে কেন সবই শিখতে হয়? যা দেখি তা-ই যেন নতুন! আমি কেন আগে পারলাম না! আসলে এ সবই আমার ইগোজনিত চিন্তা। অবশ্য এসবে আমার শেখার অন্তরায় ঘটেনি। আমিও কি শেখাতে পারি না কিছু? কেউ কি আমার কাছ থেকেও শেখেনি? এ আত্মবিশ্বাসই আমার শেখার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। বাড়িয়ে দেয় আমার দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারতা।
বোনেরা বলে, ‘সেজ আমাদের মধ্যে কাজকর্মে সবচেয়ে পটু। ভাই ভাবীরা আদর করে বলেন, চটপটি! আসলে ওসব উপাখ্যানের মূলমন্ত্র হলো সবার ভিন্ন ভিন্ন কলাকৌশলগুলো ধারণ করে আমি আমার নিজের মতো আরেকটি নতুন কিছু করে ফেলি যা একেবারেই অভিনব-নতুনত্বের দাবিদার হয়ে ওঠে। অবশেষে সেটিই অন্যদের শেখাতে আমি হয়ে উঠি শিক্ষক। এই যেমন বাড়তি পোলাওটুকু ফেলে দেবো? মোটেই না। পাস্তা বা ম্যাকরনি সেদ্ধ করে নুডুলস রান্নার মতোই সবজি বা কলিজা বা চিঙড়ি , ডিম দিয়ে পোলাও মিশিয়ে ভেজে সুন্দর একটু ডেকোরেশন করে পরিবেশন করে দিলাম- আর খেতাব পেয়ে গেলাম দারুণ রাঁধুনী! কাপড় কাটতে গিয়ে ভুল করে ফেলেছি- একটু ভিন্নরকম করে মিটিয়ে দিলাম পোশাকটি। হয়ে উঠল নতুন ডিজাইনে নব আধুনিকতম কিছু একটা। আবার একসময় সেটিই দেখি মার্কেটে বেশ কদর। আমার যা ভুলের ফসল- মার্কেটে তা উদ্ভাবনী ফল!
তরকারিতে ঝাল লবণ বেশি হয়ে গেল? হাতের কাছে থাকা একমুঠো শাক ধুয়ে তরকারির পাশে দিয়ে দিন, তা না থাকলে একটু আটার মণ্ড করে ঝোলের মধ্যে ছেড়ে দিন- ব্যাস কমে গেল ঝামেলা। হলুদ বেশি পড়ে গেছে? ঢেলে দিন তরকারিতে আরো এক ফোঁটা রান্নার তেল। বাহ স্বাদেগন্ধে বেড়ে গেল মুখরোচক রান্না। একবার পেঁপে কাটতে দেখেছিলাম আমার এক ছোট্ট ছাত্রীকে। বীচিভরা কাঁচা পেঁপেটি বুক চিরে ছোট চামচ দিয়ে কুড়িয়ে সব পরিষ্কার করে ফেলল মুহূর্তে। ওর অজান্তে আমি শিখে নিলাম বিরক্তিকর পেঁপের বীচি ফেলার ঝামেলা।


কচু শাকের ডগা রান্না খেতে কে না পছন্দ করে! কিন্তু ধুতে গেলে হাত চুলকানোর ভয় কার না জাগে? এরও সমাধান পেয়ে গেলাম আরেকজনের কাছ থেকে। হাতে পলিথিন বেঁধে ঝাঁঝরে ফেলে ঝটপট ধুয়ে নিলো কচুগুলো- বেঁচে গেল চুলকানির কষ্ট থেকে। রসুন ছিলা সাংঘাতিক কষ্টকর। নখের বারোটা বাজবে! নাহ কিছুই না। আপনি শুধু আস্ত রসুনটি ধুয়ে বড় একটি চামচ বা ছুরির পিঠ দিয়ে চাপ দিন- মচমচ করে সব ক’টি কোয়া পৃথক হয়ে যাবে। আলতোভাবে ওপরের উঠে আসা খোসাগুলো ছাড়িয়ে আরেকবার দিন চাপ, থেঁতলে যাবে। রান্নার জন্য যথেষ্ট মানে প্রস্তুত হয়ে যাবে রসুন। আর আদা? ওকে তো ডিপে রেখে দেবেন। প্রয়োজন মতো বের করে পানিতে ভিজিয়ে সহজেই ছাড়িয়ে নিন খোসা, তারপর সেই চাপ বা দিন ছেঁচা। ডাল বলকে পড়ে যাবে না যদি তাতে এক ফোঁটা তেল দিয়ে সেদ্ধ বসিয়ে দিন। প্রতিবেশী ভাবীকে দেখলাম রান্নায় বসানো তরকারির ঢাকনাটা খুলে ঢাকনার পানিটা কড়াইয়ের ওপর ঝরিয়ে নিয়ে তবেই তরকারি নেড়ে দিলেন- মসলাযুক্ত পানি আর আশপাশ নষ্ট করার সুযোগ পেলো না। কী বুদ্ধি!
অনেক সময় নদীর মাছে ভিন্ন একটি গন্ধ থাকায় অনেকেই খেতে রুচি পায় না। এটিও শিখেছি আমি বাড়ির রান্না সহকারীর কাছ থেকে। প্রথমে মাছগুলো লবণ ও লেবুর রস অথবা সাদা শিরকা দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিলাম। রান্না করে নামানোর আগে মিশিয়ে দিলাম খানিকটা চিনিমিশ্রিত লেবুর রস। হয়ে গেল মজাদার এক রেসিপি। আর এভাবেই আমি হয়ে উঠি সেরাদের সেরা। পেছনের মূলমন্ত্র কিন্তু শেখা ও শেখানো। অর্থাৎ আমরা সবাই কমবেশি শিক্ষার্থী ও শিক্ষক আর আমাদের শিক্ষালয় এই জগৎসংসার। তাই তো প্রাজ্ঞজনরা বলেছেন, ‘যত বেশি তুমি জানবে নিজের অজ্ঞতাকে তত বেশি আবিষ্কার করতে পারবে।’
রান্নার এসব কৌশল এখন অহরহই দেখা যায় বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলে; কিন্তু যখন তা ছিল না- আমাদের মা, খালা, ফুফুদের আমলে! তারা কিভাবে শিখেছিলেন? ওই যে প্রসারিত দৃষ্টি। সেটিই ছিল তাদের ভরসা। আমারও তাই-ই। শিখতে শিখতেই একসময় নিজের অজান্তেই অন্যকেও শেখানো হয়ে যায়, যাকে বলে শিক্ষক। এভাবেই আমরা একই সাথে শিক্ষক-শিক্ষার্থী দুটোই হয়ে যাই। আর তা যেন জীবনেরই দাবি। কেননা, পৃথিবীর মহামানব হজরত মুহাম্মদ সা: বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি।’