Naya Diganta

আলোচনায় অন্ধকার

আলোচনায় অন্ধকার

বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ এলাকা অন্ধকারে থাকার ঘটনা নিয়ে গতকাল ছিল সারা দেশে আলোচনা। দেশে চাহিদার চেয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা দ্বিগুণ করা হয়েছে। আরো নতুন বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনের পথে রয়েছে। বাড়তি উৎপাদন ক্ষমতা কাজে লাগাতে না পেরে বসিয়ে রেখে বছরে ১৫ হাজার কোটি থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ জনগণের পকেট থেকে দেয়া হচ্ছে।

কিন্তু উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের ঘরে পৌঁছানোর জন্য সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের যে আধুনিকায়ন দরকার, তা করা হচ্ছে না। এমনকি সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণও হচ্ছে না। এর ফলে বারবার বিদ্যুতের বিপর্যয় ঘটছে। গত ২০১৪ সালের ১ নভেম্বর ভারত থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুৎ লাইনের বিপর্যয়ে সারা দেশ অন্ধকারে ডুবেছিল। ওই সময় ৩৬ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় দেশের বিভিন্ন এলাকায়। এর মধ্যে আরো কয়েকবার জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয় ঘটে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার এরই পুনরাবৃত্তি ঘটে। জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়ের ফলে দেশের ৬০ ভাগ এলাকায় ৬ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। দুর্বিষহ সময় পার করে এসব এলাকার মানুষ। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন দ্রুত আধুনিকায়ন তথা ডিজিটালাইজেশন করতে হবে। কথাগুলো বলছিলেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিশ্লেষকরা।

পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক বিডি রহমত উল্লাহ গতকাল বুধবার নয়া দিগন্তকে বলেন, গত ১০-১২ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যতটা আগ্রহ বা উৎসাহ দেখানো হয়েছে; সঞ্চালন ও সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নয়ন ততটাই নিরুৎসাহিত ছিল। শুধু নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। চাহিদার দ্বিগুণের বেশি উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে জনসাধারণের হাজার হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও সরবরাহ লাইন ঠিকমতো মেরামতও করা হয়নি। সঞ্চালন ও সরবরাহে এ গাফিলতিতে বারবার জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয় হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের একটাই পথ, দ্রুত বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও সরবরাহ লাইনের উন্নতি এবং সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৪ সালে ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর গঠিত তদন্ত কমিটি বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও পরিবহন ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য ৩২টি সুপারিশ করে। এর মধ্যে ২২টি ছিল স্বল্পমেয়াদি এবং বাকি ১০টি দীর্ঘমেয়াদি। দীর্ঘ আট বছরেও এসব সুপারিশের বেশির ভাগই বাস্তবায়ন হয়নি বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

ওই বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনায় তৎকালীন বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আহমেদ কায়কাউসের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। একটি সুপারিশ ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোকে চার ভাগে ভাগ করে সময়ভিত্তিক অর্থাৎ ৬ ঘণ্টা করে ফ্রিকোয়েন্সি বা বিদ্যুৎ তরঙ্গ নিয়ন্ত্রণ। অপর একটি সুপারিশে বলা হয়েছিল খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে চাহিদার থেকে বিদ্যুতের উৎপাদন কমে যাওয়ায় গ্রিড বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে। এ জন্য আন্ডার ফ্রিকোয়েন্সি রিলে সেটিংয়ের মাধ্যমে ৩৩ কেভি এবং ১৩২ কেভি ফিডারের নির্দিষ্ট ও যৌক্তিক পরিমাণ লোড স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কিন্তু এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় বারবার বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

সাবেক বিদ্যুৎ সচিব মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেছেন, জাতীয় গ্রিডের কাজ হলো বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা। ৫০ হার্টজে (কম্পাঙ্কের একক) এটি করা হয়ে থাকে। লক্ষ্য ৫০ হার্টজ হলেও কিছুটা লিওয়ে (অতি সামান্য বিচ্যুতি) থাকে (৪৮ থেকে ৫২ হার্টজ পর্যন্ত), ভারসাম্যে ব্যতিক্রম হলে উৎপাদন বাড়িয়ে বা চাহিদা কমিয়ে এটি রক্ষা করা হয়। উল্লিখিত ব্যান্ডের সীমা অতিক্রম করলেই গ্রিড বিপর্যয় ঘটতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, সাইক্লোন সিডরের ফলে আকস্মিকভাবে একসাথে দক্ষিণাঞ্চলের অনেক বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে যায়। দ্রুত উৎপাদন কমাতে না পারায় ভারসাম্য বিঘ্নিত হয় ও বিদ্যুৎ গ্রিড বিপর্যয় ঘটে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ক্ষতির আশঙ্কায় বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।

চাহিদা ছাড়াও হঠাৎ করে উৎপাদন বা সরবরাহ ব্যাপকভাবে কমলেও গ্রিড বিপর্যয় ঘটতে পারে। একবার ভারত থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ হঠাৎ করে ব্যাহত হওয়ায় গ্রিড বিপর্যয় হয়েছিল বলে সে সময় অনেকে দাবি করেছিলেন।

বিদ্যুৎ ফিরে আসার প্রক্রিয়া কী? তিনি নিজেই এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন- প্রথমেই করণীয় হলো বন্ধ হয়ে যাওয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু করা। সমস্যা হলো বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র চালু করতেও বিদ্যুৎ লাগে। এ পদ্ধতিকে বলা হয় ব্লাক স্টার্ট। গ্রিডের সাথে সংযুক্ত নয় এমন ছোট ছোট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো তখন চালু করে বন্ধ হয়ে যাওয়া বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন শুরু করার জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। একে একে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে ফিরে আসে এবং পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ পুনঃসরবরাহ করা হয়।

এ দিকে বিদ্যুৎ বিতরণ ও সঞ্চালন ব্যবস্থা অটোমেশনে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, অন্যথায় যেকোনো সময় বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটতে পারে। কিন্তু একই ঘটনা যদি মাঝে মাঝে ঘটে তাহলে বুঝতে হবে সিস্টেমে গলদ আছে। আর এটা চিহ্নিত করাও চ্যালেঞ্জের বিষয়। কারণ আমাদের পুরো বিষয়টি অটোমেটেড নয়, ম্যানুয়ালি অনেক কিছুই করতে হয়। এ কারণে বিদ্যুৎ বিপর্যয় এড়াতে বিদ্যুৎব্যবস্থার পুরো প্রক্রিয়াটিকে অটোমেশনে নিয়ে আসা জরুরি।

বিদ্যুৎ বিপর্যয় কেন হয়, আর এর সমাধানেরই বা উপায় কী এ বিষয়ে বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন সাধারণত বিদ্যুৎ তরঙ্গের (ফ্রিকোয়েন্সি) গরমিলের কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। বিদ্যুৎ যে তরঙ্গে প্রবাহিত হয় কোনো কারণে তাতে হেরফের হলে এমন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সাধারণত মিলি সেকেন্ডের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা ঘটে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে ৫০ মেগাহার্টজ তরঙ্গে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। কোনো কারণে এই তরঙ্গ যদি ৪৮-এ নেমে আসে বা ৫২-তে উঠে যায় তাহলেই বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটতে পারে। এর আগে ২০১৪ সালে যখন বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে তখন ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের সরবরাহ কয়েক মিলি সেকেন্ডের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এতে জাতীয় গ্রিড ট্রিপ করে। একবার গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয় দেখা দিলে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়। বড় বিপর্যয় ঠেকাতে কেন্দ্রগুলোতে সতর্কতামূলক প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হলে কারিগরি কারণে সেটি চালু হতে সময় লাগে। ফলে চাইলেই সাথে সাথে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায় না।

তদন্ত কমিটির কাজ শুরু : এ দিকে জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানে গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) নির্বাহী পরিচালক (পিঅ্যান্ডডি) ইয়াকুব ইলাহী চৌধুরীকে কমিটির প্রধান করা হয়েছে। কমিটিকে রিপোর্ট দিতে তিন দিনের সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। আর এ অনুযায়ী আগামীকাল শুক্রবারের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে হবে কমিটিকে। এরই অংশ হিসেবে তদন্ত কমিটির সদস্যরা ঘোড়াশাল, আশুগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তবে এখনো বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের সঠিক কোনো কারণ ওই কমিটি খুঁজে পায়নি বলে জানিয়েছেন কমিটির এক সদস্য। ওই সদস্য বলেন, মূল ঘটনাটি কোথায় ঘটেছে, এটি জানার জন্য আমরা কাজ করছি। এগুলো সব মিলি সেকেন্ডের মধ্যেই ঘটে। কোনটা আগে, কোনটা পরে আবার এটার কারণে ওটা হলো নাকি অন্য কারণে এটা হলো, এগুলোই আমরা খুঁজছি। এগুলো বিভিন্ন যান্ত্রিক ডেটা। যন্ত্রের মধ্যে সময় থাকে। কী ঘটেছিল, সেটা থাকে, বিভিন্ন গ্রাফ- এগুলো এনালাইসিস করতে হবে।

বিদ্যুৎ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমেই সারা দেশে বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা হয়ে থাকে। এখন পর্যন্ত আমরা যতটুকু শুনেছি, বিদ্যুৎ সরবরাহের কোনো একটি লাইন বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে অন্য লাইন ওভারলোড হয়ে সেটা ট্রিপ করেছে। এর ফলে পূর্বাঞ্চলের গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বল্পতা দেখা দেয়। যার কারণে এ ঘটনা ঘটতে পারে।

প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার বেলা ২টা ৫ মিনিটে বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয় হয়। দেশের অর্ধেকের বেশি এলাকায় ছয় থেকে আট ঘণ্টা টানা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। কোনো কোনো এলাকায় বিদ্যুৎ আসতে ১২ ঘণ্টার বেশি লেগে যায়।