Naya Diganta

আরবি ভাষার কিংবদন্তিতুল্য এক গদ্যশিল্পী

লেখক : ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

মাওলানা নুর আলম খলিল আমিনি উপমহাদেশের অন্যতম বরেণ্য আরবি ভাষাবিদ। তিনি ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রধান, পাঠকনন্দিত আরবি মাসিক ‘আদ-দাঈ’র প্রধান সম্পাদক, রাষ্ট্রপতির পুরস্কারপ্রাপ্ত কথাশিল্পী। ২০২১ সালের ৩ মে তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর।

বিহারের সিতামুড়ি জেলায় ১৯৫২ সালে জন্ম নেয়া এ মনীষী প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পড়ালেখা নিজ জেলায় সম্পন্ন করে স্নাতক পর্যায়ে ভর্তি হন দিল্লির আমিনিয়া মাদরাসায়। ১৯৭০ সালে এ মাদরাসা থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এখানে তিনি ভারতের প্রখ্যাত আলেম ও স্বাধীনতা সংগ্রামী মাওলানা মুহাম্মদ মিয়া সাহেবের সান্নিধ্য লাভ করেন। নামের শেষে আমিনি দিল্লির আমিনিয়া মাদরাসার স্মৃতি বহন করে। অতঃপর বিশ্বখ্যাত মাদরাসা দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন ও কৃতিত্বের সাথে দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রিপ্রাপ্ত হন। দেওবন্দে খ্যাতনামা আরবি ভাষাতাত্ত্বিক ও অভিধান সঙ্কলক মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামান কিরানভির শিষ্যত্ব তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। দেওবন্দের শায়খে সানি মাওলানা আবদুল হক আজমির প্রিয় ছাত্র ছিলেন তিনি। পরে সৌদি আরবের কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে উচ্চতর গবেষণা করে ডিপ্লোমা লাভ করেন।

বাবার মৃত্যুর কারণে মাওলানা নুর আলম খলিল আমিনি কৈশোর বয়সে এতিম হয়ে যান। মায়েরও অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়। অল্পদিন পর সৎবাবাও ইন্তেকাল করেন। তিনি একেবারে অসহায় হয়ে পড়েন। অদম্য আগ্রহ, জ্ঞানঅনুসন্ধিৎসা, নিয়মানুবর্তিতা ও চ্যালেঞ্জ গ্রহণের মানসিকতা তাকে সফলতার শীর্ষে পৌঁছে দেয়। অর্থনৈতিক দৈন্যদশা তার উচ্চ শিক্ষায় বাদ সাধতে পারেনি। ছাত্রজীবনের একটি মুহূর্ত তিনি হেলাফেলা ও অবহেলায় নষ্ট করেননি।

মাওলানা নুর আলম খলিল আমিনি ১৯৭২ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ১০ বছর লক্ষৌ দারুল উলুম নদওয়াতুল ওলামায় শিক্ষকতা করেন। পরে প্রায় ৪০ বছর দারুল উলুম দেওবন্দে আরবি ভাষা ও সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে তিনি শায়খ মুহাম্মদ নজিব কাছেমিসহ সহস্রাধিক আরবি লেখক, সাংবাদিক ও গবেষক তৈরি করতে সক্ষম হন। শায়খ মুহাম্মদ নজিব কাছেমি ভারতের বিশিষ্ট ইসলামী স্কলার ও সম্বলে আন-নুর পাবলিক স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি দেওবন্দ থেকে দাওরায়ে হাদিস, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ, দিল্লি জামিয়া মিল্লিয়া থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। দরসে কুরআন, দরসে হাদিস, ইসলাহি মাযামিন ও মদিনার পথেসহ বহু গ্রন্থ রচনা করেন।

এছাড়াও মাওলানা খলিল আমিনি আরবি ও উর্দু ভাষায় বহু গ্রন্থ রচনা করেন। সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভি, শায়খ ইলিয়াছ কান্ধলভি, শায়খ মানযুর নুমানি ও শায়খ মুফতি ত্বাকি ওসমানি লিখিত গ্রন্থসহ বিদগ্ধ মনীষীদের মোট ২৫টি গ্রন্থ উর্দু থেকে আরবিতে ভাষান্তরিত করেন। আল-ফায়সাল, আল-জাযিরা, আদ-দাওয়াহ, আল-বাআছুল ইসলামী, তামিরে হায়াত, আল-ফোরকান এ তার ৫০০ গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এসব নিবন্ধে তিনি সমসাময়িক ঘটনাবলির বিশ্লেষণের পাশাপাশি মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের ওপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। ইহুদি চক্রান্তের মোকাবেলায় ফিলিস্তিনের ইন্তিফাদার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। পারস্পরিক বিভেদ ভুলে গিয়ে ইসলামী জাগরণের পথে একতাবদ্ধ হওয়ার জন্য মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানান। ভারতের বহুমাত্রিক সমাজ, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যকলায় মুসলমানদের অবদান ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পান। ২০১৭ সালে আরবি ভাষা ও সাহিত্যে অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার দেয়া হয়। যেসব গবেষক আরবি, ফারসি, ক্লাসিক্যাল উড়িয়া, ক্লাসিক্যাল কান্নাড়া, ক্লাসিক্যাল তেলেগু ও ক্লাসিক্যাল মালয়ালাম ভাষায় উল্লেখযোগ্য ও সৃষ্টিধর্মী অবদান রাখতে সক্ষম হন তাদের প্রতি বছর ভারতের স্বাধীনতা দিবসে এ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।

মাওলানা নুর আলম খলিল আমিনি লিখিত গ্রন্থাবলির মধ্যে রয়েছে-
ফালাস্তিন ফিইন্তিজারি সালাহুদ্দিন, আদ দাওয়াতুল ইসলামিয়া বয়ান আল-আমস ওয়া আল ইয়াউম, আল মুসলিমুনা ফিল হিন্দ, মুজতামাউনা আল মাছারাহ ওয়া আত-তরিক ইলাল ইসলাম, মাতা তাকুনু আল-কিতাবাত ওয়া আল মুয়াছারাহ, তাআল্লামু আল আরাবিয়া ফা ইন্নাহা মিন দিনিকুম, হারফে শিরিন, পাসে মার্গ জিন্দাহ, রাফতাগানে না-রাফতাহ, উয়হ কুহে কান কি বাত, মিফতাহুল আরবিয়া, মওজুদাহ ছালিবি-ছাইহুনি জঙ, কেয়া ইসলাম পছ পা হু রহা হে, Educational condition of India before and after the British colonialism, Indian scholars and the propaganda against Shaikh Muhammad ibn Abdul Wahab and Shaikhul Islam Hussain Ahmad Madani.

মাওলানা খলিল আমিনির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে আসাম ও ক্যালিকট বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’টি পিএইচডি ডিগ্রির অভিসন্দর্ভ রচিত হয়। ২০১৩ সালে গবেষক আবুল কালাম আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শায়খ আমিনি ও তার গ্রন্থাবলির ওপর থিসিস রচনা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। থিসিসের শিরোনাম ছিল- Socio-Political aspects in the writings of Noor Alam Khalil Amini with special reference to Falastin Fi Intizari Salahuddin গবেষণাকর্মের সুপারভাইজার ছিলেন প্রফেসর ড. আশফাক আহমদ। ‘Contribution of writer Noor Alam Khalil Amini in Arabic Literature’-শীর্ষক বিষয়ে ক্যালিকট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. কে মুহাম্মদ বশিরের তত্ত্বাবধানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন ২০১৯ সালে কর্নাটকের আরবি গবেষক মুহাম্মদ সাজিদ খান।

বিংশ শতাব্দীতে ভারত আরবি ভাষা ও সাহিত্যের যে কয়েকজন অনুকরণীয় শিক্ষকের জন্ম দিয়েছে তাদের মধ্যে মাওলানা আমিনি ছিলেন অন্যতম। দারুল উলুম দেওবন্দে তার দীর্ঘ শিক্ষকতা চলাকালীন তিনি শুধু তার ছাত্রদের কেবল কিভাবে পারঙ্গমতার সাথে আরবি ভাষা বলতে ও লিখতে হয় তা শেখাননি; বরং তিনি তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন কিভাবে একজন ভালো মানুষ হিসেবে সমাজে আদর্শ জীবন যাপন করতে হয়। তিনি তাদের এমনভাবে শিক্ষিত করেছেন, তারা যেখানেই যান না কেন, দারুল উলুম দেওবন্দের জন্য গৌরব ও খ্যাতি বৃদ্ধির কারণ হয়ে ওঠে। তিনি সবসময় তার ছাত্রদের উৎসাহ দিতেন এবং তাদের সাফল্যের শিখরে আরোহণের স্বপ্ন দেখাতেন। যখনই তার কাছে প্রকাশ ও প্রচারের সুযোগ এসেছিল, তিনি সর্বদা তার ছাত্রদের তাদের দক্ষতা প্রমাণ করার জন্য এগিয়ে যেতেন।

তার ইসলামিক, অ্যাকাডেমিক ও চিন্তাশীল লেখাগুলো সুব্যক্ত এবং বাগ্মিতাপূর্ণ আরবি ভাষায় আদ-দাঈ-এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। তবুও আরব লেখকদের মানসম্পন্ন ও চিন্তাশীল প্রবন্ধ সংগ্রহ করা এবং আদ-দাঈ-এর চমৎকার প্রকাশনা তার আশ্চর্যজনক উৎসাহ অনুসারে ম্যাগাজিনটি তার সাফল্যের শিখরে পৌঁছতে সময় নেয়নি। শুধু ভারতীয় উপমহাদেশের পণ্ডিতরাই নয়, আরব পণ্ডিত, কবি ও পত্র-পত্রিকার সাংবাদিকরাও খোলা মন নিয়ে পত্রিকাটিকে স্বাগত জানিয়েছেন। এভাবে, ম্যাগাজিনটি দারুল উলুম দেওবন্দের মুখপত্র হিসেবে, দেওবন্দি চিন্তাধারা (যা আহলুস-সুন্নাহ ওয়া-আল-জামায়াতের পথকে কঠোরভাবে অনুসরণ করে) প্রবর্তন ও আরব বিশ্বে প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম উপস্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাওলানা নুর আলম খলিল আমিনি মুসলিম ও আরব বিশ্বের নেতাদের গৃহীত পদক্ষেপের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলোও তুলে ধরতেন তার লেখায়। যেকোনো গুরুতর বিষয়ে ভারত সরকারের অবস্থান ও সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তার মতামত প্রকাশ করতে তিনি কখনোই দ্বিধা করেননি। তার নিবন্ধ ৫-৬ পৃষ্ঠা ও কখনো কখনো তার চেয়েও বেশি পৃষ্ঠা নিয়ে গঠিত হয়।

শায়খ আমিনি ‘ইলা-রহমাতিল্লাহ’ কলামের জন্য শতাধিক প্রবন্ধও লিখেছেন। এই কলামের অধীনে তিনি বিখ্যাত পণ্ডিত, চিন্তাবিদ, প্রচারক, কবি, পত্রলেখক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে লিখেছেন যারা কাছে অতীতে ভারতীয় উপমহাদেশের পাশাপাশি আরব বিশ্ব থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। এসব প্রবন্ধে তিনি মৃত ব্যক্তির জীবন, তার সেবা ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ কাজ ইত্যাদির বিবরণ লিখতেন। তার অন্যান্য প্রবন্ধের মতো এই কলামের প্রবন্ধেও ছিল বৈচিত্র্য পদ্ধতির পাশাপাশি অভিব্যক্তির স্বতন্ত্রতা ও নিজস্বতা। ২০১০ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রায় তিন শতাধিক ব্যক্তির ওপর নিবন্ধ লিখেছেন।

বিভিন্ন শিরোনামে লিখিত কলামের জন্য লেখা কিছু নিবন্ধ লেখক ও তার কিছু ছাত্র দিয়ে উর্দু ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল এবং সেগুলো বিভিন্ন উর্দু পত্রিকা ও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। পাঠকরা সেগুলো খুব পছন্দ করেন। তারা ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, এই উর্দু নিবন্ধগুলো একটি বই আকারে সঙ্কলিত হোক। পাঠকদের অনুভ‚তির কথা বিবেচনা করে লেখক ২০১০ সালের মে মাসে ৯৩২ পৃষ্ঠায় ৩৭টি প্রবন্ধের সঙ্কলন ‘পাসে মার্গ জিন্দাহ’ প্রকাশ করেন। একই সিরিজের ২৪টি প্রবন্ধের আরেকটি সঙ্কলন ‘রাফতাগানে না-রাফতাহ’ প্রকাশিত হয়েছে।

সাহিত্যিকরা সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে সমাজে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা বিস্তারে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেন। সাহিত্যের মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে আরো তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, কারণ এটি পাঠকদের হৃদয়ে আরো ভালোভাবে কাজ করে। এ বিষয়ে আরবি লেখার ফোকাস ও অবদান আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করার দাবি রাখে। প্রকৃতপক্ষে, আমিনি এমন একজন প্রধান ব্যক্তিত্ব যিনি আরবি সাহিত্যের উপাদান ও উদ্দেশ্যগুলোকে মধ্যযুগীয় শব্দ এবং মহাকাব্যের সাথে উপভোগ করার রীতি থেকে সরে এসে ভিন্ন আঙ্গিকে প্রকাশের প্রয়াস পেয়েছেন।

আরবি সাহিত্যের প্রসারে আমিনি তার সাহিত্যসাধনাকে কিভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন তা তার লেখা পড়লেই উপলব্ধি করা যায়। তার লেখা সামাজিক মূল্যবোধের সাথে মন ও মননকে সতেজ করে। তার সাহিত্যকর্ম যুগযুগ ধরে তাওহিদবাদী মানুষকে শেকড় সন্ধানে প্রাণিত করবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
drkhalid09gmail.com