Naya Diganta

গোড়ায় গলদ

লেখক : জয়নুল আবেদীন

১৬৪ ধারার জবানবন্দী ফৌজদারি মামলায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ধারার অধীনে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে তার নিজের অপরাধের লিখিত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়ে থাকেন।

ফৌজদারি মামলার গুরুত্বপূর্ণ অংশটি গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে যখন এর পেছনে ভয় ও প্রলোভন কাজ করে। আমার আইন পেশার শুরুতে ১৬৪ ধারার যে জবানবন্দীটি সামনে এসেছিল সেখানে কাজ করেছিল প্রলোভন। সহজ-সরল, গোঁয়ার ও মূর্খ ছেলে কাদের প্রলোভনে পড়ে খুনসহ ডাকাতির ঘটনা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছিল? যিনি প্রলোভন দিয়েছিলেন তিনি তদন্তকারী কর্মকর্তা। বিজ্ঞ বিচারক বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন বলেই নির্ঘাত ফাঁসি থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন আসামি কাদির যা গত ২৫ সেপ্টেম্বর ‘এক ঢিলে ছয় পাখি’ শিরোনামে দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ‘এক ঢিলে ছয় পাখি’ লেখার সময়ই নজরে আসে পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার কর্তৃক ১৬৪ ধারা জবানবন্দী প্রত্যাহারের আবেদন। বাবুল আক্তার কাদিরের মতো সহজ-সরল ও মূর্খ নয়। খবরে প্রকাশ, ‘মাঠপর্যায়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছেন তার স্ত্রীকে। এই ঘটনার ডালপালা মেলতে মেলতে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অনেক পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী। বাধ্য হয়ে তারা মনোরোগ চিকিৎসকের চিকিৎসাও নিয়েছেন। ‘আমাকেও কি এভাবে মেরে ফেলবা’ পুলিশ কর্মকর্তা স্বামীকে এরকম প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছেন অনেক স্ত্রী।’

প্রত্যাহারের আবেদনে প্রকাশ, গত ৮ সেপ্টেম্বর হেফাজতে নিয়ে নিষ্ঠুর নির্যাতনের অভিযোগে পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদারসহ ছয় পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আবেদনে আরো বলা হয়েছে, ২০২১ সালের ১৩ মে সকাল পৌনে ১০টা থেকে ১৭ মে সকাল ১০টা পর্যন্ত মামলার বাদি বাবুল আক্তারকে পিবিআই মেট্রো ও জেলা কার্যালয়ের রুমে আটকে রাখা হয়। এ সময় তাকে হাতকড়া পরিয়ে চোখ বেঁধে নির্যাতন করা হয়। স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতুকে হত্যার কথা স্বীকার করাতে বনজ কুমারের নির্দেশে আসামিদের নিষ্ঠুর নির্যাতন করা হয়। বাবুল আক্তারের করা তিনটি দরখাস্তই ২৫ সেপ্টেম্বর রোববার চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ ড. জেবুন্নেছা বেগমের আদালত খারিজ করে দিয়েছেন। বাবুল আক্তারের মতো একজন চৌকশ পুলিশ অফিসারের স্বীকারোক্তি আদায় নিঃসন্দেহে পুলিশের কৃতিত্ব।

এর আগে নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডার মামলায় ২৫ জন আসামি গ্রেফতার হওয়ার এক মাস পরেও, ‘বিস্তর গাফলতি, ঢিলেমি ও ফাঁক রেখে চলছে নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের তদন্ত।’ পত্র-পত্রিকায় এরকম সংবাদ প্রকাশের পর, পুলিশের কৃতিত্ব ও ব্যর্থতা নিয়ে গত ২ জুন ২০১৪ ‘একজন চন্দন কুমার সরকার’ শিরোনামে দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায় একটি আর্টিক্যাল প্রকাশিত হয়। আর্টিক্যালে গল্পচ্ছলে বলেছিলাম, ‘প্রতিশ্রুতি নিয়ে মন্ত্রীর আগমন জনৈক এমপির এলাকায়। এমপি উষ্ণ অভ্যর্থনাসহ মালায় মালায় বরণ করেন মন্ত্রীকে। সবশেষে মন্ত্রীর বক্তব্যের পালা। প্রধান অতিথি হিসেবে মন্ত্রী মহোদয় বক্তব্য দিতে শুরু করে হঠাৎ হাত যায় গলায়। গলায় হাত যেতেই চমকে উঠে দেখেন, চেইন নেই। সিঙ্গাপুর থেকে আনা ২২ ক্যারেটের খাঁটি সোনার চেইন। বক্তব্য সংক্ষিপ্ত করে এমপিকে, ‘এ বেটা এমপির বাচ্চা এমপি, কুল্লে চোর-বাটপার নিয়ে চলিস, তোর এলাকায় সভা করতে এসে গলা থেকে স্বর্ণের চেইন খোয়া গেছে। হুড়াহুড়ি করে যারা আমার পায়ের ধুলা নিয়েছে, গলায় মালা দিয়েছে, তাদেরই একজন চেইন চোর। ধুলা নেয়ার ফাঁকে চেইনখানও নিয়ে গেছে। সাত দিনের মধ্যে চেইন উদ্ধার করে চোরের বিচার চাই। চেইনসহ বিচার না হওয়া পর্যন্ত তোর এলাকায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বন্ধ।’ বলেই মন্ত্রী হনহন করে সভা ত্যাগ করেন।

এমপি, এসপিসহ থানার কর্তাকে নিয়ে বসেন। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মন্ত্রীর চেইনসহ চোর ধরতে না পারলে সুযোগ-সুবিধাই শুধু বন্ধ হবে না, সবাইকে বান্দরবান পাঠানো হবে বলে হুমকি দেন এমপি সাহেব। শুরু হয় চিরুনি অভিযান। পাঁচ দিনের মাথায় এমপি, এসপিসহ এক গাড়ি চোর নিয়ে হাজির হন মন্ত্রীর বাসায়। এমপি হাতজোড় করে, ‘স্যার সাত দিন লাগেনি, পাঁচ দিনের মাথায় চোরসহ আপনার চেইন উদ্ধার হয়েছে। চোর ধরা পড়েছে ১৫ জন আর চেইন উদ্ধার হয়েছে ১০টি। এর মধ্যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে পাঁচজন। আপনার চেইনের আইনডেন্টিফিকেশন আমাদের জানা নেই। চেইনের আইডেন্টিটি জানা না থাকায় ১০টি চেইন-ই হাজির করলাম। এখান থেকে আপনার চেইনটি আপনি খুঁজে নিন। মন্ত্রী বিস্মিত হয়ে বলেন, ‘স্যরি, সেদিন আমি আমার চেইনটি ভুলবশত বাসায়ই ফেলে গিয়েছিলাম।’

পত্রিকায় প্রকাশিত গল্পটি সত্যে পরিণত হয়েছিল কয়েক বছর পরেই। গত ৪ জুলাই ২০২০ তারিখ থেকে নিখোঁজ ছিল জিসা মনি। দীর্ঘ এক মাস খোঁজাখুঁজির পর মেয়েকে না পেয়ে ৬ আগস্ট সদর মডেল থানায় অপহরণ মামলা করেন বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন। মামলার তদন্তভার পান নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শামীম আল মামুন। গ্রেফতার করা হয় আবদুল্লাহ, রকিব ও নৌকার মাঝি খলিলকে। মামলায় জিসা মনির বাবা জাহাঙ্গীর আলম উল্লেখ করেন আবদুল্লাহ তার মেয়েকে স্কুলে যাওয়া আসার পথে প্রেমের প্রস্তাব দিত। তাকে বিরক্ত করতে নিষেধ করা হলে সে আমার মেয়েকে অপহরণের হুমকি দেয়। ৪ জুলাই সন্ধ্যায় আবদুল্লা জিসা মনিকে ফোন দিয়ে তার কাছে যেতে বলে। এর পর থেকেই আমার মেয়ের কোনো খোঁজ নেই। ৯ আগস্ট ২০২০ মামলার আসামিরা নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মিল্টন হোসেন ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ হুমায়ূন কবিরের পৃথক আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। আসামিদের দেয়া জবানবন্দীতে জানা যায়, ৪ জুলাই বিকেলে রকিবের ইজিবাইকে ঘোরাঘুরি শেষে ওই কিশোরীকে শহরের পাঁচ নম্বর ঘাট এলাকায় নিয়ে যান আবদুল্লাহ। সন্ধ্যায় খলিল মাঝির নৌকা ভাড়া করে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে। পরে আবদুল্লাহ ওই নৌকাতেই জিসা মনিকে ধর্ষণ করে। ধর্ষণে অংশ নেয় নৌকার মাঝি খলিলও। এ সময় বাসায় বিষয়টি জানানোর কথা বললে জিসা মনিকে হত্যা করে মরদেহ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দেয়।’ ২৩ আগস্ট বন্দরের নবীগঞ্জ রেললাইন এলাকার একটি মোবাইল ফোনের দোকান থেকে জিসা তার মা রেখা আক্তারকে ফোন করে জানায়, ‘মা আমি মরি নাই; বেঁচে আছি এবং সুস্থ আছি।’

১৬৪ ধারার জবানবন্দীর ত্রুটি নিয়ে বিবিসি বাংলা ঢাকা ১৯ জুলাই ২০১৬ প্রকাশিত আরো একটি খবর, ‘২০ বছর পর জেল থেকে মুক্তি পেলেন শতবর্ষী নারী। বাংলাদেশের একটি হত্যা মামলায় ২০ বছরের মতো কারাভোগ করার পর আদালতে পুরাপুরি নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে জেল থেকে ছাড়া পেলেন শতবর্ষী এক নারী। পরিবারের বেশ ক’জনের সাথে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছিলেন চাঁদপুরের অহিদুন্নেসা। খবরে প্রকাশ, ‘আজই তিনি ছাড়া পেয়েছেন কাশিমপুর জেল থেকে। ছেলেসহ পরিবারের কয়েকজন সদস্য তাকে গ্রহণ করেন। কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, ছাড়া পাওয়ার সময় যারা তার মুক্তির জন্য ভূমিকা রেখেছেন অহিদুন্নেসা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুব্রত কুমার বালা বলেন, ‘কারাগারের ভেতরেই মারা যেতে হয় কি না, এ রকম একটা বিষয় তার মাথায় সবসময় কাজ করত।’ অহিদুন্নেসা যখন কারাগারে যান তখন তার বয়স আশির কোঠায়। তার ছাড়া পাওয়ার গল্প যেন সিনেমাকেও হার মানায়। মি বালা জানান, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা জুন মাসের শেষের দিকে গিয়েছিলেন কাশিমপুর কারাগার পরিদর্শনে। সেখানে অহিদুন্নেসা তার নজরে আসে।

তবে গল্পের শুরু সেই ১৯৯৭ সালে যখন জমিজমা নিয়ে কোন্দলকে ঘিরে চাঁদপুরের মতলবে ঘটেছিল এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। একই পরিবারের সাতজনকে হত্যা করা হয়েছিল। সেই হত্যাকাণ্ডের দায়ে বাড়ির শরিক অহিদুন্নেসার স্বামীসহ দু’জনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল। আরো কয়েকজন আত্মীয়ের সাথে অহিদুন্নেসার যাবজ্জীবন হয়। কিন্তু সেই কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে আবেদন করতে না পারায় তার যাবজ্জীবন বহাল থাকে। সেই আপিলেরই সুযোগ তিনি পেলেন প্রধান বিচারপতি কারাগার পরিদর্শনের পর। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, একটি শুনানির পর তাকে নির্দোষ ঘোষণা করে মুক্তি দিয়েছে আদালত। তিনি বলেন, ‘হাইকোর্ট ডিভিশন, আপিল বিভাগ, সেশনস কোর্ট এই তিনটি রায়ই পর্যালোচনা করে সর্বোচ্চ আদালত এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, যে স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল, আসলে সেই স্বীকারোক্তিতে তিনি ওই হত্যায় নিজকে জড়িত করেননি।’

জিসা মনির মতো অনুরূপ ঘটনায়, ‘চট্টগ্রামের মৃত দীলিপও জীবিত ফিরে এসেছেন। সেখানেও ১৬৪ ধারা জবানবন্দীতে দীলিপকে হত্যার কথা স্বীকার করেছিল আসামিরা। শিশু হত্যার আসামি মাজেদার জবানবন্দীও উচ্চ আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল। নারায়ণগঞ্জের কিশোরীসহ তিন ঘটনায়ই পুলিশের হুমকি, নির্যাতনের কারণেই ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে বাধ্য হয়েছিল আসামিরা। নারায়ণগঞ্জে মৃত স্কুলছাত্রীর জীবিত ফিরে আসার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে শুনানিতে ১৩ জানুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি এম এনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো: মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন। আদালত বলেন, ‘জবানবন্দীতে আসামিরা যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা সত্য নয়। ভিকটিমকে মেরে নদীতে ফেলে দেয়ার যে জবানবন্দী দেয়া হয়েছে তাতে আসামিদের স্বার্থ কী? এ দেশের মানুষ ক্ষুদিরামের ফাঁসি দেখতে চেয়েছিল। এজন্য কি সবাই ফাঁসিতে যেতে চায়? এ বিষয়ে আমাদের একটি সিদ্ধান্তে আসতে হবে। হাইকোর্ট বলেন, ‘আমরা বিচারপতি, আমরা এই মাটির সন্তান। আমরা সব কথা কোর্টে বলতে পারি না।

এখানে শুনানির সময় সাংবাদিকরাও থাকেন। ফাঁসি হবে জেনেও আসামিরা কি স্বেচ্ছায় জবানবন্দী দিয়েছেন? জবানবন্দীতে আসামিরা যদি মেয়েটিকে হত্যা করার কথা বলে, তাহলে কি শখ করে বলেছেন? এটা দুর্ভাগ্যজনক। অভাগা তো এ দেশের জনগণ।’ অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে আদালত বলেন, ‘ভারতে কোনো আসামিকে রিমান্ডে নেয়া হলে সেখানে আইনজীবী রাখার সুযোগ আছে। সে জন্য তারা সিআরপিসি সংশোধন করেছে। আমাদের তো কোর্ট থেকে আইন সংশোধনের কথা বললে নানান প্রতিক্রিয়া হয়’ (আমার সংবাদ, জানুয়ারি ২৩, ২০২১)।

শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দেয়া মরা মেয়েটি ৫১ দিন পর জীবিত ফিরে আসার ঘটনায় পুলিশের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে একটি জোকস শোনা যেত। জোকসটি এরকম,‘ ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়া ও ভারতবর্ষ এই চার দেশের পুলিশের ইনভেস্টিগেশন প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতার বিষয়, একটি কুকুরকে গভীর জঙ্গলে ছেড়ে দেয়া হবে। কোন দেশের পুলিশ কত দ্রুত কুকুরটি খুঁজে বের করতে পারে। কুকুরকে ছেড়ে দেয়া হলো। ইউরোপ দুই দিনে, আমেরিকা তিন দিনে ও রাশিয়া চার দিনে কুকুরটি খুঁজে বের করল। এবার ভারতবর্ষের পালা। এক দিন, দু’দিন করে চার দিন পার হয়ে যায়। কুকুর খুঁজে বের করা দূরের কথা, পুলিশকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তিন দেশের পুলিশ খুঁজতে বের হলো ভারতবর্ষের পুলিশকে। খুঁজতে খুঁজতে পাওয়া গেল। সপ্তাহ খানেক যাবত একটি ভেড়াকে গাছের সাথে বেঁধে পিটাচ্ছে আর বলছে, ‘স্বীকার কর তুইই সেই কুকুর! তুইই সেই কুকুর!’ তিন দেশের পুলিশ এর কারণ জানতে চাওয়ার উত্তরে, ‘আরে রাখেন আপনাদের ইনভেস্টিগেশন, যতক্ষণে জঙ্গল খুঁজে একটি কুকুর বের করব ততক্ষণে দেশের অর্ধেক ভেড়া পিটিয়ে কুকুর বানাতে পারব।’

ভারতবর্ষের পুলিশকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এই বাহিনীর গোড়ায় গলদ। অর্থাৎ, প্রকৌশলী ভালো হলেই ইমারত ভালো হবে না, যদি নির্মাণসামগ্রী ভালো না হয়। কারা কী উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষের পুলিশ বাহিনী তৈরি করেছিলেন জানা দরকার। ভারত স্বাধীন হওয়ার প্রথম মহাবিদ্রোহ ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব যা ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা উত্তর ও মধ্য ভারতে। এই বিপ্লব ১৮৫৮ সালের গণঅভ্যুত্থান নামেও পরিচিত। এই অভ্যুত্থান নেড়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ ভিত। ভারতবর্ষকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ১৮৬১ সালে The commission of the Police Act (ct V of 1861) ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হয়। এই আইনের অধীনে ভারতের প্রতিটি প্রদেশে একটি করে পুলিশ বাহিনী গঠিত হয়। এই বাহিনীর দ্বারা বিদ্রোহ দমনসহ বহু নিরপরাধ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছিল। সেই ধারাবাহিকতায় আমাদের পুলিশ দমন-পীড়ন যত ভালো পারে, শাসন-নিয়ন্ত্রণ তত ভালো পারে না। এই বিষয়ে দুই দশক আগেই পুলিশের আইজিপি নূর মোহাম্মদ স্বীকার করে গেছেন, ‘পুলিশ সম্পর্কে সবার একটা নেতিবাচক ধারণা আছে। এ ধারণা দীর্ঘদিনের কর্মকাণ্ডের ফলে তৈরি হয়েছে। ১৮৬১ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পরপর পুলিশ বাহিনী সৃষ্টি করা হয়। পুলিশকে তখন সৃষ্টি করা হয়েছিল জনগণকে শাসন-শোষণের জন্য। এরপর ব্রিটিশ গেল, পাকিস্তান গেল এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির ৩৬ বছর পরও পুলিশের চরিত্রের পরিবর্তন ঘটেনি।’

লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
E-mail : adv.zainulabedin@gmail.com