Naya Diganta

দরকার তওবার রাজনীতি

দরকার তওবার রাজনীতি

উপমহাদেশের প্রখ্যাত বুজুর্গ ও আলেমে দ্বীন হজরত মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ: সব মত ও পথের রাজনৈতিক নেতাদের লক্ষ করে বলেছিলেন, ‘আসুন, মন থেকে সব ধরনের কলুষতা মুছে তওবা করে দেশ মাতৃকার উন্নয়নে রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করি।’ তিনি দেশবাসীকে কুরআনের আয়াত উল্লেখ করে এ আহ্বান জানান। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল স্বাধীনতার ঠিক পরই শাসকগোষ্ঠী তা বেমালুম ভুলে গিয়ে জনগণের ওপর যে কর্তৃত্ববাদী শাসন চালু করেছিল এবং এই কর্তৃত্ববাদী শাসন চাপিয়ে দিতে গিয়ে জনগণের ওপর যে অন্যায় আচরণ করা হয়েছে, তার থেকে মুক্তির পথ হলো তওবা। তওবা করার মাধ্যমে অতীতের ভুল-ত্রুটির ক্ষমা মার্জনা চেয়ে জনগণের কল্যাণে রাষ্ট্র পরিচালনা করার উদ্দেশ্যই হলো তওবার রাজনীতি। তওবার রাজনীতি কথাটি কেমন শুনালেও তওবা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো (সূরা নূর-আয়াত : ৩১)’। আল্লাহ পবিত্র কালাম শরিফে আরো বলেন, ‘হে ঈমানদারেরা, তোমরা আল্লাহর কাছে খাঁটি তওবা করো, আশা করা যায়, তোমাদের রব তোমাদের পাপগুলো মোচন করবেন এবং তোমাদের এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশে ঝরনাসমূহ প্রবহমান।’ (সূরা-৬৬ তাহরিম, আয়াত : ৮)।

হাফেজ্জী হুজুরকে তওবার রাজনীতির প্রবর্তক বলা হয়। মূলত হাফেজ্জী হুজুর ভোট ও রাজনীতিতে ‘তওবা’র কথাটি বলতে শুরু করেছেন ’৮১-এর নির্বাচনী প্রচারণার সময়কাল থেকে। তিনি বলেছেন, অযোগ্য, মানুষের হক নষ্টকারী, ইসলামী হুকুমত কায়েম করতে চায় না- এমন শ্রেণীর লোকজনকে এতদিন নির্বাচিত করে আমরা যে ভুল করেছি, সেজন্য ইসলামী হুকুমতের পক্ষের প্রতীকে ভোট দিয়ে আমাদের তওবা করা দরকার। এটি শুধু ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের জন্যই নয়, বরং একটি কল্যাণ রাষ্ট্র কায়েমের জন্য অঙ্গীকার থাকা উচিত। অঙ্গীকার করে তা পালন করতে না পারলে শাসকের উচিত জনগণের ওপর নিপীড়নমূলক শাসন চাপিয়ে না দিয়ে ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়া। কিন্তু আমরা শুরু থেকেই দেখছি রাষ্ট্র, তার গতিপথ হারাতে শুরু করেছে। আমরা ভূখণ্ডের সার্বভৌমত্ব পেয়েছি কিন্তু জনগণের সার্বভৌমত্ব পাইনি। অথচ মূল চেতনা ছিল ভূখণ্ডের সার্বভৌমত্ব অর্জনের মাধ্যমে নাগরিক সার্বভৌমত্ব ফিরিয়ে দেয়া যেখানে নাগরিকের অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠিত হবে বিনা বাধায়। কিন্তু আমাদের শাসকগোষ্ঠী শুরু থেকেই নাগরিক অধিকারগুলো কেড়ে নেয়ার জন্য খড়গহস্তে প্রস্তুত। যে গণতন্ত্র আমরা ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলে পাইনি সেই গণতন্ত্র আমরা স্বাধীন বাংলাদেশেও পাচ্ছি না। এর মূল কারণ হচ্ছে শাসকের একনায়কতান্ত্রিক সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক সার্বভৌমত্ব হরণ করা হচ্ছে।

নাগরিকের অধিকারের প্রশ্নে আমরা যদি গণতন্ত্রকে বিশ্লেষণ করি তাহলে গণতন্ত্রের মধ্যে চারটি মৌলিক আদর্শ খুঁজে পাই। সেগুলো হচ্ছে নাগরিকের সার্বভৌমত্ব, প্রতিনিধিত্ব, দায়বদ্ধতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। জনগণের সার্বভৌমত্বের অর্থ জনগণই সরকার প্রতিষ্ঠা করবে এবং সরকার জনগণের ইচ্ছার অধীন হবে। প্রতিনিধিত্ব হচ্ছে শাসকের প্রতি শাসিতের সম্মতি প্রদানের উপায়। দায়বদ্ধতা হচ্ছে জনগণের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের সম্পর্কের বিষয়। ক্ষমতাসীনরা কেবল যাদের সম্মতি ছাড়া ক্ষমতায় যেতে পারে না, তাদের কাছেই জবাবদিহিতে বাধ্য, আর কারো কাছে নয়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অর্থ হচ্ছে মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা, বাকস্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, সংঘ গঠন ও সমাবেশের স্বাধীনতা। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা এই ব্যাপারগুলোতে বারবার হোঁচট খেতে দেখেছি। জনগণের গণতান্ত্রিক সার্বভৌম কেড়ে নিতে গিয়ে জনগণের সাথে যে অন্যায় আচরণ করা হয়েছে তার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই প্রয়োজন তওবা করে জনগণের অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠিত করা।

স্বাধীনতার পরেই ১৯৭২ সালের সংবিধান রচনার সময়ই ধর্মকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রের জনগণকে দ্বিধাবিভক্ত করা হয়েছে। যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে, স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল স্পিরিট ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে এটা কি বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে? ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে যদি শুধু মুসলমানদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় তাহলে এই ভূমির জনগণ সেটি কোনো দিনও মুক্তিযুদ্ধের স্পিরিট হিসেবে গ্রহণ করতে পারবে না। বরং এই দেশের জনগণ সব সময়ই ধর্মভীরু।

ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ধর্ম পালনের ওপর বাধানিষেধ দিয়ে অন্য ধর্মের উৎসবকে সবার ওপর চাপিয়ে দেওয়া কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য বিষয় হতে পারে না। এটার মধ্যে ভিন্ন রাজনীতি লুক্কায়িত আছে যা পাশ্বর্বর্তী রাষ্ট্রের কায়েমি স্বার্থকে হাসিল করার জন্য একটি গোষ্ঠী ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটিকে সামনে নিয়ে এসেছে। এটা কোনো চেতনার মধ্যে পড়ে না। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সব নাগরিক হোক সে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান কিংবা অন্য যে ধর্মের ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে বা নিজ ধর্মীয় আচার পালনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকবে। ধর্ম পালনের এই স্বাধীনতাকে ধর্মনিরপেক্ষতা নাম দিয়ে মুসলমানদের হেয় করা হচ্ছে। এটা করতে গিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানের ওপর যে অন্যায়-অবিচার করা হয়েছে তার থেকে মুক্তির উপায় হলো, তওবা করে সব ধর্মের মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করা।

বাংলাদেশ সংবিধানের ১৪৮ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যেকোনো পদে নির্বাচিত বা নিযুক্ত ব্যক্তি কার্যভার গ্রহণের পূর্বে শপথগ্রহণ বা ঘোষণা করিবেন এবং অনুরূপ শপথপত্রে বা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরদান করিবেন। সংবিধানের আলোকে আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি শপথবাক্যে বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব; আমি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান করিব; এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন-অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব।’ কার্যত আমরা দেখতে পাই, মহামান্য রাষ্ট্রপতি সব জনগণের প্রতি সমান আচরণ না করে সরকারি দলের কার্যসিদ্ধিতে বেশি তৎপর। নিরপেক্ষতা তার আচরণেই নেই? মন্ত্রী পরিষদের সদস্যরাও যে শপথ নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেন, তার ছিটেফোঁটাও রক্ষা করেন না। শপথ ভঙ্গের পাপ খুবই ভয়ানক। কাজেই মহান পালন কর্তার কাছে সব ভুলের ক্ষমা চেয়ে, তওবা করে ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনা করা উচিত।

আজকে রাষ্ট্রের শাসকগণ জনগণের কাছে দায় স্বীকার করেন না। ভুলের জন্য ক্ষমাও চান না। বরং নিজেদেরকে এতটাই উঁচু আসনে সমাসীন করেন, যেখানে জনগণের পৌঁছাবার ক্ষমতা নেই। তাদের কথা, আচরণে এবং ক্ষমতার দাম্ভিকতায় মনে হয় তারাই রাষ্ট্র। যেমনটা ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই বলেছিলেন, ‘আমিই রাষ্ট্র’। ষোড়শ লুই বলেছিলেন, ‘যে ব্যক্তি নিজেকে জয় করতে পারে, তার সামনে আর সামান্যই কিছু টিকতে পারে।’ অবশ্য তিনি তার অন্তিম শয়ানে বলেছিলেন, ‘আমি চলে যাচ্ছি কিন্তু রাষ্ট্র সর্বদাই টিকে থাকবে।’ আমাদের মন্ত্রী, এমপি, আমলা এবং নির্বাচন কমিশনের ব্যক্তিগণও দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিবেন কিন্তু তাদের কর্ম ইতিহাসে আলোচনার বিষয় হিসেবে টিকে থাকবে। সেখানে জনগণ তাদের কর্মের ইতিহাস পড়ে ব্যক্তির মূল্যায়ন করবে। এই চিরন্তন সত্যকে আড়াল করে আমাদের মন্ত্রী, এমপি, নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা এবং রাষ্ট্রের আমলারা লুইয়ের সপ্তদশ শতাব্দীর রাজকর্মচারীদের মতো জনগণের কথা বাদ দিয়ে এক ব্যক্তির আদেশ নির্দেশ পালনে ব্যতিব্যস্ত। মনে হচ্ছে, তারা লুইয়ের মনোবাঞ্ছা পূরণ করছেন।

এই দেশের জনগণ এই সরকারের অধীনে নির্বাচন চায় না। ইভিএমে (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) বিশ্বাস করে না। আওয়ামী লীগ ও তার সমমনা দু-একটা রাজনৈতিক দল ব্যতীত সব রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনের আয়োজিত সংলাপে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা এবং ইভিএম-এ ভোট না নেয়ার পক্ষে কথা বললেও সবকিছু বাদ দিয়ে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত দিয়ে দিলো, তারা ১৫০টি আসনে ইভিএম-এ ভোট নেবে। আওয়ামী লীগ বলেছে এটা করতে হবে, তাই তারাও সেটা করছে; যেমনটা লুই বলতেন, ‘এটা আইনসম্মত, কারণ এটাই আমার অভিপ্রায়।’ কোনো ব্যক্তি বা একজন ব্যক্তির অভিপ্রায় রক্ষা করতে গিয়ে তারা তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের জন্য যে শপথ নিয়েছিলেন তা বেমালুম ভুলে যাচ্ছেন। এটা একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অভিপ্রায় হতে পারে না।

রাষ্ট্রের জনগণ সুখে নেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জীবন চালনা তাদের জন্য কষ্টকর। সরকার প্রতিদিনই হয়তো কোনো জিনিসের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিদ্যুৎ, তেল, গ্যাসের দাম অসহনীয় মাত্রায় বাড়িয়ে দিয়ে জনগণকে রাজপথে নামতে বাধ্য করছে। রাষ্ট্রের রিজার্ভ দিন দিন কমে যাচ্ছে। দেশ শ্রীলঙ্কার পথে হাঁটছে, এই শঙ্কায় যখন দেশের জনগণ হাঁসফাঁস করছে ঠিক তখনই নির্বাচন কমিশন সরকারের খায়েশ পূরণ করতে গিয়ে ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকা দিয়ে ১৫০টি আসনে ইভিএমে নির্বাচন করার নিমিত্ত দুই লাখ ইভিএম কেনার জন্য অর্থ বরাদ্দ চেয়েছে? এটা কি জনগণের সাথে রসিকতা নয়?

আওয়ামী লীগ জনগণের সিদ্ধান্তকে ভয় পায়। তাই তারা কারচুপির পথ খুঁজছে। আর এই কারচুপির জন্য ‘ইভিএম’ হলো তাদের জন্য নিরাপদ যন্ত্র। আসলে ভোটের রাজনীতিতে নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ দলটি এখন ক্ষমতা হারানোর ভয়ে শঙ্কিত। তাই তাদের আমরণ ক্ষমতায় টিকে থাকার বাসনাকে জীবিত রাখতে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করছে। আর রাষ্ট্রের কর্মচারীরাও সুবিধাভোগী হয়ে ‘রাজার ইচ্ছা’ পূরণ করছেন। সংবিধান আর শপথ তাদের কাছে খুবই তুচ্ছ। তারা কাজে-কর্মে প্রমাণ করছে, তারা জনগণের জন্য নয়; সরকারের জন্য, একটি বিশেষ দলের জন্য। আজকে রাষ্ট্রের এই পঙ্কিল অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তওবার বিকল্প নেই। তওবা করে পূতপবিত্র হয়ে জনগণের সেবক হয়ে দেশের কল্যাণে কাজ করার শপথ নেয়া খুবই জরুরি।
harun_980@yahoo.com