Naya Diganta

উত্তরাখণ্ডের মাদরাসায় কেন সমীক্ষা চালাচ্ছে বিজেপি সরকার

উত্তরাখণ্ড মাদরাসা বোর্ডের সদর দফতর

ভারতের উত্তর প্রদেশের পরে এবার প্রতিবেশী রাজ্য উত্তরাখণ্ডেও মাদরাসাগুলোতে সমীক্ষা চালানোর নির্দেশ দিয়েছে ওই রাজ্যের বিজেপি সরকার। সাড়ে চার মাস আগে ওই নির্দেশ জারি করা হলেও এখনো সমীক্ষা শুরু হয়নি।

দেরাদুনের ক্লেমেন্ট টাউন সেনাছাউনীর চওড়া রাস্তার শেষে হঠাৎই সরু গলির মধ্যে ঢুকে পড়েছিলাম। চিন্তা হচ্ছিল অত সরু গলি দিয়ে গাড়ি ঢুকবে তো!

গাড়ি ঢুকেই গিয়েছিল, আর আমি হাজির হয়েছিলাম মাদরাসা আবুল কালাম আজাদের দরজায়। তবে বাইরে লাগানো ইংরেজি হরফে লেখা বোর্ডে কোথাও এটিকে মাদরাসা বলা হয়নি।

রাজ্য সরকারের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত একটা ইংরেজি মাধ্যম স্কুল লেখা ছিল ওই বোর্ডে।

উত্তরাখণ্ড মাদরাসা বোর্ডের ডেপুটি রেজিস্টার আমাকে বলেছিলেন যে এটা বাকি সব মাদরাসার কাছে একটা উদাহরণস্বরূপ।

সেই আদর্শ মাদরাসাটাই দেখতে আমি সেখানে গিয়েছিলাম।

মাদরাসা পরিচালকদের কোনো আপত্তি ছিল না সমীক্ষায়
ঘটনাচক্রে, উত্তরাখণ্ড সরকার রাজ্যের মাদরাসাগুলোতে যে সমীক্ষা চালাচ্ছে, তা নিয়ে কিন্তু মাদরাসা পরিচালকদের কোনো আপত্তি ছিল না। তারা তো এটাকে স্বাগতই জানিয়েছিল।

কিন্তু উত্তর প্রদেশের মতোই উত্তরাখণ্ডের মাদরাসাগুলোতে সমীক্ষা করা নিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপ বেড়ে গেছে।

বিজেপির সাবেক মুখপাত্র শাদাব শামস সম্প্রতি উত্তরাখণ্ড ওয়াকফ বোর্ডের সভাপতি হওয়ার পরে তিনিই এই সমীক্ষার কথা বলেছিলেন।

পরে মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামিও মাদরাসা-সমীক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।

এসবেরও আগে, প্রায় সাড়ে চার মাস আগেই উত্তরাখণ্ডের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী এই সমীক্ষার লিখিত আদেশ দিয়েছিলেন।

মাদরাসা সার্টিফিকেটের স্বীকৃতির সমস্যা
উত্তরাখণ্ডে মাদরাসা বোর্ড তৈরি হয়েছিল ২০১২ সালে। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন হরিশ রাওয়াত বোর্ডকে সরকারি স্বীকৃতি দেন।

২০১৬ সালে ওই মাদরাসা বোর্ড রাজ্যে ৪১৯টি মাদরাসাকে স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু চারটি মাদরাসা পরে বোর্ডের স্বীকৃতি ফিরিয়ে দিয়ে বিদ্যালয় শিক্ষা বোর্ডের অধীনে চলে যায়।

ওই চারটি মাদরাসার মধ্যে একটা ছিল মৌলানা রিসালুদ্দিন হাক্কানির মাদরাসাও। বিদ্যালয় শিক্ষা বোর্ডের স্বীকৃতি নিয়ে তারা এখন দেরাদুনেই আজাদ এডুকেশন অ্যাকাডেমি নামে একটা স্কুল চালাচ্ছে।

মৌলানা রিসালুদ্দিন বিবিসিকে বলছিলেন, সবথেকে বড় সমস্যা হলো মাদরাসা বোর্ডের কোনো সিলেবাস নেই। তাই মাদরাসা বোর্ডের দেয়া সার্টিফিকেটগুলো নিয়ে ২০১৫ সাল থেকে মামলা চলছে।

মাদরাসা বোর্ড বারে বারেই দাবি তুলছে যে পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত তাদের দেয়া সার্টিফিকেটগুলোকে বিদ্যালয় শিক্ষা বোর্ডের সমান স্বীকৃতি দেয়া হোক।

সংখ্যালঘুদের নিয়ে লাগাতার লিখে চলেছেন, এমন একজন সাংবাদিক শাহ নজর বলছেন, ‘উত্তর প্রদেশ, বিহার, রাজস্থান, মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে মাদরাসা থেকে পাস করা ছাত্রদের শিক্ষা বোর্ডের সমতুল্য স্বীকৃতি রয়েছে। কিন্তু উত্তরাখণ্ডে তা নেই। সেজন্য মাদরাসা থেকে পাস করা ছাত্ররা অন্য স্কুল বা কলেজে ভর্তি হতে পারে না।’

মৌলানা রিসালুদ্দিনও বলছেন, সবথেকে বড় সমস্যা এটাই। সেজন্যই তিনি তার নিজের মাদরাসাটাকে স্কুলে পরিবর্তন করে নিয়েছেন, যাতে ছাত্রদের ভবিষ্যৎ খারাপ না হয়ে যায়।

মাদরাসা ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হয়
মাদরাসা বোর্ডের ডেপুটি রেজিস্টার আব্দুল ইয়ামিন অবশ্য বলছেন, এটা একটা ভুল ধারণা।

‘মাদরাসা বোর্ডের সার্টিফিকেটের অস্থায়ী স্বীকৃতি তো সেই ২০১৫ সাল থেকেই আছে। কিন্তু মাদরাসা বোর্ডের কর্মকর্তাদের ভুলের জন্য এই কথাটা প্রচার পেয়ে গেছে যে মাদরাসা বোর্ডের সার্টিফিকেট বিদ্যালয় শিক্ষা বোর্ডের সমতুল্য নয়। এর ফল ভুগতে হচ্ছে হাজার হাজার ছাত্রকে,’ জানাচ্ছিলেন আব্দুল ইয়ামিন।

তিনি বলেন, ‘এর বিপরীতে মাদরাসায় পড়া ছাত্রদের অন্য স্কুলে বা আলিম সার্টিফিকেট পাওয়ার পর কলেজে ভর্তি হতে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। মাদরাসাগুলোতে তো এনসিইআরটি’র সিলেবাসই পড়ানো হয়। একটাই ফারাক যে এগুলো হিন্দি বা ইংরেজির বদলে উর্দুতে লেখা হয়। সিলেবাসের বাইরে শুধু ধর্মশিক্ষা আর উর্দু পড়ানো হয়।’

তিনি আরো জানিয়েছেন, কিছুদিন আগেই মাদরাসা থেকে পাস করা বেশ কয়েকজন ছাত্র কুমায়ূন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে।

সমীক্ষা নিয়ে রাজনীতি
উত্তরাখণ্ড ওয়াকফ বোর্ডের দায়িত্ব নেয়ার পরে রাজ্য বিজেপির মুসলিম নেতা শাদাব শামস দলীয় এজেন্ডা অনুযায়ী কাজ করতে শুরু করে দেন। রুড়কির বিখ্যাত দরগা পিরান কালিয়ারকে নেশা করার জায়গা আর সেখানে দেহব্যবসা চলে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে তিনি নিজের বয়ান বদলে ফেলে বলেন, তিনি দরগার কথা বলেননি, ওই বিধানসভা এলাকা আর গ্রামটির কথা উল্লেখ করেছিলেন।

এরপরেই তিনি বলেন, উত্তর প্রদেশের মতোই উত্তরাখণ্ডেও মাদরাসাগুলোতে সমীক্ষা চালানো দরকার। পরের দিনই মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামিও সেই কথায় সায় দেন।

মুখ্যমন্ত্রী এ-ও বলেন যে অনেকের কাছ থেকে তিনি মাদরাসাগুলোর ব্যাপারে অভিযোগ পেয়েছেন। সেজন্যই বাস্তব পরিস্থিতিটা জানার জন্যই মাদরাসা সমীক্ষা করাতে চান তিনি।

কিন্তু সেই সমীক্ষার সরকারি নির্দেশ অনেক আগে, এপ্রিল মাসেই দিয়েছিলেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী চন্দন রামদাস।

ছাত্রদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই সমীক্ষা?
চন্দন রামদাস বিবিসিকে জানিয়েছেন, ‘মাদরাসা থেকে পাস করা ছাত্রদের সার্টিফিকেটের কোনো স্বীকৃতি না থাকায় ছাত্রদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেজন্যই মাদরাসায় সমীক্ষা করার আদেশ দেয়া হয়েছে। মাদরাসাগুলোকে বলা হয়েছে যে হয় তারা বিদ্যালয় শিক্ষা বোর্ডের স্বীকৃতি নিক, অথবা ছাত্রদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখতে অন্য কোনো উপায় অবলম্বন করুক।’

তিনি এ-ও বলেন যে সমীক্ষা শুধু সেই ১৯২ মাদরাসাতেই চালানো হবে, যারা রাজ্য বা কেন্দ্র সরকারের সহায়তা পায়।

মন্ত্রীর আদেশ দেয়ার সাড়ে চার মাস পরেও সমীক্ষা শুরু হয়নি।

কর্মকর্তারা বলছেন, মন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী সমীক্ষার কাজ খুব তাড়াতাড়ি শুরু হবে।

আধুনিক মাদরাসা
ফিরে যাই সেই মৌলানা আবুল কালাম আজাদ মাদরাসায়।

মাদরাসাটির ভাইস প্রিন্সিপাল বিলকিস জাহাঁ উত্তরাখণ্ড মাদরাসা শিক্ষক সমিতির মিডিয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেত্রী।

তিনি বলছিলেন, সার্টিফিকেটের স্বীকৃতির সমস্যার জন্য তারা ২০১৭ সালে ওপেন স্কুল থেকে দশম আর দ্বাদশ শ্রেণীর স্বীকৃতি নিয়ে নিয়েছেন।

আর যেহেতু এখন ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানো হয়, সাথে উত্তরাখণ্ড শিক্ষা বোর্ডের সিলেবাস মেনে চলা হয়, তাই ছাত্রদের পরে অন্য কোথাও ভর্তি হতে কোনো সমস্যা হয় না বলে জানালেন তিনি।

তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাঁচজন ছাত্রী উত্তরাখণ্ডে শীর্ষস্থান অধিকার করেছে। খুব তাড়াতাড়ি তারা স্মার্ট ক্লাসরুমও চালু করতে চলেছেন।

‘এটা মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা। কাছাকাছি পাঁচটা স্কুল আছে। কিন্তু যাদের মনে হয়, ছেলে-মেয়েকে ধর্মশিক্ষা দেয়াবেন, তারাই মাদরাসায় পাঠান সন্তানদের,’ বলছিলেন বিলকিস জাহাঁ।

তিনি বলেন, ‘মাদরাসাকে মাদরাসা বলতে কারো লজ্জা পাওয়ার কিছু তো নেই। আসলে মাদরাসার যে পুরনো ভাবমূর্তিটা মানুষের মনে রয়েছে, সেটার বদল দরকার।’

ঘটনাচক্রে এই মাদরাসায় যে হিন্দু শিক্ষক বিজ্ঞান পড়ান, তিনি এখান থেকেই আলিম পাস করেছেন, যাতে তিনি মাদরাসার পরিবেশটা আরো ভালো করে অনুধাবন করতে পারেন।

সূত্র : বিবিসি