Naya Diganta

যুক্তরাষ্ট্র অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায় বাংলাদেশে

সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্ট্যাডিজ আয়োজিত মিট দ্য অ্যাম্বাসেডর অনুষ্ঠানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস : নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশের আসন্ন সংসদ নির্বাচনের দিকে সবাই তাকিয়ে রয়েছে উল্লেখ করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র কখনোই বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ নেয় না। আমরা চাই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হোক, যেখানে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনভাবে তাদের নিজেদের সরকার নির্বাচন করতে পারবে। তিনি বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করা সবার দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন, সরকার, গণমাধ্যম, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দল- সবারই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যদি তাদের কেউ একজন নিজের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় কিংবা অন্যকে দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়, তাহলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।
গতকাল রাজধানীর একটি রেস্টুরেন্টে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘মিট দ্য অ্যাম্বাসেডর’ অনুষ্ঠানে পিটার হাস এসব কথা বলেন। সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, সাবেক রাষ্ট্রদূত, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা উপস্থিত ছিলেন।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বিক্ষোভ ও সমাবেশগুলোতে সংঘর্ষের ঘটনা আমাদেরকে এই সত্যটি মনে করিয়ে দেয়, সহিংস রাজনৈতিক পরিবেশে কোনোভাবেই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। বিক্ষোভকারী, রাজনৈতিক দলগুলো, সরকার এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা- প্রত্যেকের জন্য আইনের শাসনকে সম্মান করা এবং সহিংসতা, হয়রানি এবং ভয় দেখানো থেকে বিরত থাকা গুরুত্বপূর্ণ।


এক প্রশ্নের জবাবে পিটার হাস বলেন, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। র‌্যাবের অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহিতা ও সংস্কার নিশ্চিত করা না হলে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সম্ভাবনা নেই। এই নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য কাউকে শাস্তি দেয়া নয়, বরং র‌্যাবের আচরণে পরিবর্তন আনা।
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কূটনীতিকদের বৈঠককে সরকার শিষ্টাচারবহির্ভূত হিসাবে দেখছে- এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে রাষ্ট্রদূত বলেন, আমি কূটনৈতিক শিষ্টাচার সম্পর্কে যতটুকু অবহিত তা হলো, অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করা যায় না। আমি এটাও অবহিত যে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নির্বাচন করার বিষয়ে অনেক পরামর্শ ও সুপারিশ রয়েছে। আমি যখন নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করি, ওই পরামর্শের কথা বলি। আমি বলতে চাই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচনে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অর্জনে সহায়তা করতে চায়। নির্বাচন কমিশনের করণীয় বা সংবিধান সংশোধনী বিষয়ে আমাদের কোনো মন্তব্য নেই। আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ দেখতে চাই।
আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ত্রুটিপূর্ণ হলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি জানি না। সাধারণভাবে পেশাদার কূটনীতিকরা ‘হতে পারে’ এমন কোনো বিষয়ে মন্তব্য করেন না। বাংলাদেশের জনগণই নির্বাচনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। এক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত বলেন, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে (আইপিএস) বাংলাদেশের যোগ দেয়া বা না দেয়াটা কোনো বিষয় নয়। এটা (যুক্তরাষ্ট্রের) একটি নীতি। এই নীতি বাংলাদেশ কীভাবে নেয়, সেটাই দেখার বিষয়। (চীনের) বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) যোগ দেয়াটা বাংলাদেশের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশ কোন জোটে যোগ দেবে, সেটা তার নিজস্ব বিষয়।
যুক্তরাষ্ট্র ভারতের চোখ দিয়ে বাংলাদেশকে দেখে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, মোটেই না। এখানে আমার কাজ বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক উন্নয়ন করা।
সার্ককে (দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা) কার্যকর করতে যুক্তরাষ্ট্র ভূমিকা রাখতে পারে কি না- প্রশ্ন করা হলে রাষ্ট্রদূত বলেন, আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানো যুক্তরাষ্ট্রের নীতি। এ অঞ্চলের নিরাপত্তা ও উন্নয়নে আঞ্চলিক কানেকটিভিটিকে আমরা প্রাধান্য দিয়ে থাকি।
বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আলোচনা অব্যাহত রাখবে উল্লেখ করে পিটার হাস বলেন, আমরা স্বীকার করি এখানে শ্রম পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। অক্টোবরে এটি নিয়ে আমরা আরো বিস্তারিত আলোচনা করবো।


মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, গত বছর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে ও সবার সমৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি অবাধ, স্বাধীন, শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ব্যাপারে তার ভিশন বা দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের সামরিক সহযোগিতা তার সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দুই দেশের সামরিক বাহিনী প্রতিরক্ষামূলক প্রস্তুতিকে শক্তিশালী করতে, মানবিক বিপর্যয় মোকাবেলায় সক্ষমতা বাড়াতে এবং অংশীদারিত্ব জোরদার করতে নিয়মিতভাবে একসাথে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা আমাদের নিরাপত্তা সম্পর্ক আরো বাড়াতে চাই। এ লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সাথে দুটি মৌলিক প্রতিরক্ষা চুক্তি সই করতে চায়। একটি চুক্তি আমাদের সামরিক বাহিনীগুলোকে একে অপরকে লজিস্টিক সহায়তা, জ্বালানি সরবরাহ এবং সেবা প্রদানের সুযোগ করে দেবে। অন্য চুক্তিটির মাধ্যমে আমাদের সামরিক বাহিনীগুলো ইচ্ছা করলে একে অপরের সাথে গোপনীয় তথ্য বিনিময় করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে বিনিময়কৃত তথ্যের গোপনীয়তা বা সুরক্ষা উভয়পক্ষ রক্ষা করবে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক সুরক্ষায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ করেছে উল্লেখ করে পিটার হাস বলেন, রোহিঙ্গাদের গণহত্যা ও তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের পাঁচ বছর পার হয়েছে। এই সময়ে বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দেয়ার ক্ষেত্রে অসাধারণ উদারতা ও সহানুভূতি দেখিয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের ওপর যে আর্থিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে আমরা সে সম্পর্কে সচেতন। এই অসাধারণ আতিথেয়তার সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র গত সপ্তাহে আরো ১৭০ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা) সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে, যা রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং তাদেরকে আশ্রয়দাতা বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীর সহায়তায় ব্যবহার করা হবে। নতুন এই অনুদানের মাধ্যমে রোহিঙ্গা শরণার্থী সঙ্কটে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া মোট সহায়তার পরিমাণ ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারে (প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা) পৌঁছেছে।
রাষ্ট্রদূত বলেন, দুর্ভাগ্যবশত বার্মার পরিস্থিতি, বিশেষ করে সাম্প্রতিক ঘটনার পর অবস্থা এমন হয়েছে যে, রোহিঙ্গাদের এখন নিরাপদ, স্বেচ্ছা, মর্যাদাপূর্ণ কিংবা টেকসই প্রত্যাবাসনের সহায়ক পরিস্থিতি নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এমন পরিস্থিতি খুব শিগগির আসবে না। তাই আমরা শরণার্থীদের উন্নতমানের শিক্ষা, জীবিকার উন্নততর সুযোগ তৈরি এবং ক্যাম্পের মধ্যে আরো বেশি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার এবং আন্তর্জাতিক দাতা সম্প্রদায়ের সাথে কাজ করতে চাই।