Naya Diganta

আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ

২০০৯ সালের ঘটনা। ভারতের দার্জিলিং থেকে উত্তরবঙ্গের স্থলবন্দর হয়ে ফিরছিলাম ঢাকায়। জনৈক সরকারি কর্তার নিমন্ত্রণে নাটোরে এক রাতের জন্য যাত্রাবিরতি করলাম। খবর পেয়ে পূর্বপরিচিত আরেক কর্তা, যিনি উপজেলা নির্বাহী প্রধান হিসেবে সেখানে কর্মরত ছিলেন, হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। আমি তার মহাব্যস্ততার কারণ জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি অত্যন্ত পুলকিতচিত্তে মুখে রাজ্যের বিরক্তি আর অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন, ‘স্যার আর পারছি না, স্থানীয় এমপি মহোদয় পুলাপান মানুষ। রাজনীতি বোঝেন না। তাকে সারাক্ষণ বুদ্ধি-পরামর্শ দেয়া ছাড়াও স্থানীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ এবং নেতাকর্মীদের সব আবদার মোকাবেলা করে তাদের এমপি সাহেবের পক্ষে রাখার জন্য দিন-রাত নির্ঘুম কাটাতে হয়।’ আমি ইউএনওর কথার উত্তরে মুচকি হেসে বললাম, আপনি তো নিজে জীবনে রাজনীতি করেননি। তো এখন কিভাবে রাজনীতির তাত্ত্বিক গুরু হলেন এবং একজন সংসদ সদস্যের অলিখিত অভিভাবকে পরিণত হলেন।

আমার কথার খোঁচা সম্ভবত ভদ্রলোক বুঝতে পারলেন। তাই কথা না বাড়িয়ে কাষ্ঠহাসি দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করলেন। আজকের নিবন্ধে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ লিখতে গিয়ে কেন আমার ২০০৯ সালের উল্লিখিত ঘটনা মনে পড়ল তা বলার আগে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ঘটনাপঞ্জি বর্ণনা করা আবশ্যক। ২৮ সেপ্টেম্বর বুধবার যখন আমি আজকের নিবন্ধটি লিখছি তখন বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে দেশ-বিদেশে যে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে তার কিছু নমুনা নিচে পেশ করছি।

জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান, ব্রিটেনের প্রয়াত রানীর শেষকৃত্যে অংশগ্রহণ ও আরো বহুবিধ কর্মজনিত কারণে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, যিনি দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদেও আসীন রয়েছেন বটে, প্রায় পৌনে দুই শ’ সফরসঙ্গী নিয়ে বাংলাদেশ বিমানের বিরাট একটি বিমান ভাড়া করে ১৮ দিনের লম্বা সফরে দেশ ত্যাগ করেছেন। তার অনুপস্থিতিতে দেশের সীমান্তে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অনবরত গোলাগুলি করে রীতিমতো যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করে চলেছে। তার সোনার ছেলের দল এবং স্বর্ণালি কন্যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইডেন কলেজে আওয়ামী লীগের ভাবমর্যাদার দফারফার জন্য নজিরবিহীন কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, যা দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়ে প্রচারিত হচ্ছে এবং আওয়ামী ক্ষমতা চরিত্র ও প্রকৃতির একটি নবরূপ উন্মোচিত হওয়ার পাশাপাশি নয়া ভাবমর্যাদা সৃষ্টি হচ্ছে।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা মিসেস হাসিনা ওয়াজেদ যখন লন্ডন আমেরিকার পাঁচতারকা হোটেলগুলোতে ব্যয়বহুল সভা সমিতির আয়োজন করে সেসব দেশের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানাচ্ছেন এবং বলছেন আওয়ামী সরকারের ব্যবসাবান্ধব পরিবেশে যদি কেউ বিনিয়োগ করে তবে নিশ্চিতভাবে তাদের অনেক লাভ হবে। তার এই বক্তব্যের সমান্তরালে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত একটি সভাতে খোলামেলাভাবে বলেন যে, বিনিয়োগ চাইলে সুশাসন নিশ্চিত করুন এবং তার সেই বক্তব্য সরকার সমর্থক পত্রিকাগুলো প্রথম পৃষ্ঠায় বিশাল আকারে ছাপিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী গণতন্ত্র ও সুশাসনের গুরুত্ব প্রমাণের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনের কী গুরুত্ব বা এখানে বক্তৃতা দিলে কী উপকার হয় তা গত ৭৫ বছরের ইতিহাসে বিশ্ববাসী বুঝতে পারেনি। এ কারণে ইদানীংকালে কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যান না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা প্রতিনিধি পাঠিয়ে থাকেন। এবারের অধিবেশনে নরেন্দ্র মোদি যাননি। জার্মানির চ্যান্সেলর গিয়েছিলেন মাত্র দশ ঘণ্টার জন্য। তিনি সাধারণ বাণিজ্যিক ফ্লাইটে সম্পূর্ণ একাকী গিয়েছিলেন এবং তার ব্যাগটি বহন করার কোনো সাহায্যকারী ছিল না। এমতাবস্থায় মিসেস হাসিনা ওয়াজেদের জাতিসঙ্ঘ যাত্রা নিয়ে বিবেকসম্পন্ন লোকজনেরা সমালোচনা না করে পারছেন না। অধিকন্তু দেশের সীমান্তে যখন যুদ্ধাবস্থা যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র সচিবসহ ২০১৮ সালের সেই নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃতকারী বঙ্গবন্ধুকন্যা কিভাবে ১৮ দিন দেশের বাইরে থাকতে পারেন এবং তার এই দীর্ঘ প্রবাসযাত্রার সাথে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কতটা নির্ভর করছে তা আজ বলার চেষ্টা করব।

আলোচনার শুরুতেই ২০০৯ সালের যে ঘটনাটি বর্ণনা করলাম সেটি দিয়ে সারা বাংলায় আওয়ামী লীগের আমলাতান্ত্রিক নির্ভরতার যে অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল তা আজ এমন উচ্চতায় পৌঁছে গেছে যা কিনা হিমালয়-আল্পসের উচ্চতাকেও অতিক্রম করে ফেলেছে। ফলে আওয়ামী লীগের কোনো কিছুই আজ আওয়ামীলীগের হাতে নেই। ২০০৯ সালে একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যেভাবে একজন সংসদ সদস্যকে পোলাপান মনে করেছিলেন এবং নিজেকে সেই পোলাপানের অভিভাবকরূপে অভিজ্ঞান করেছিলেন তা ২০২২ সালে এসে এমনভাবে বিবর্তিত হয়েছে যার ফলে আমলারা এখন কেবল নিজেদের অভিভাবক নয় বরং অনেক রাজনৈতিক পদ-পদবির জনক বা স্রষ্টারূপে ধ্যানজ্ঞান করেন। অন্য দিকে তারা যেসব রাজনৈতিক লোকের ওপর দয়াপরবশ হয়ে তাদের ক্ষমতায় বসান সেসব রাজনৈতিক হতভাগ্যদের এখন আর পোলাপান বলে মনে করা হয় না, তাদের অবোধ শিশু বা ওহভধহঃ হিসেবে আদর-যত্ন, তোয়াজ-তদবির এবং সম্ভাষণ করা হয়।

উল্লিখিত রাষ্ট্রীয় রসায়ন, রাজনৈতিক বিবর্তন এবং সমাজ-সংসারের স্থান কাল-পাত্রের প্রভাবে গাঙ্গেয় বদ্বীপের বিস্তীর্ণ এলাকায় সব কিছুর বিধিবদ্ধ আকর্ষণ বিকর্ষণে পরিণত হয়ে গেছে। সব বন্ধন হয় ছিন্ন গেছে অথবা আগলা হয়ে পড়েছে। ফলে ক্ষমতাধর এবং অবৈধ অর্থের মালিকরা চাঁদের দেশের মানুষে পরিণত হয়ে গেছে। চাঁদে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি খুব কম থাকার কারণে সেখানে চলাফেলা করতে গিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করা অসম্ভব। ফলে কেউ যদি ছোট্ট একটি লাফ মারে তবে অনায়াসে ২০-৩০ ফুট উপরে উঠে যেতে পারে। আবার অত উপর থেকে যদি পড়ে যায় তবে পতনকালে তার হাত-পা-মাথা অর্থাৎ শরীরের ওপর কোনো ভারসাম্য থাকবে না। কাজেই চাঁদের দেশের মানুষের মতো ভারসাম্যহীন হয়ে রাস্তার ভ্রাম্যমাণ পতিতারা অনায়াসে দেশের বড় বড় পাঁচতারকা হোটেলের প্রেসিডেন্টের স্যুট ভাড়া করে রথী মহারথীদের রতিকর্মের বাজার বসাতে পারে।

চাঁদের দেশের ভারসাম্যহীন পরিবেশের আদলে আমাদের সমাজে যেকোনো পিয়ন কোটিপতি হয়ে বড় কর্তার গালে চড় বসিয়ে কর্তার স্ত্রীর সাথে সখ্য গড়ে তুলতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পরিবর্তে চা-ছমুচা-সিংগারা নিয়ে গর্ব হতে পারে অথবা মারামারী অশ্লীলতা অবিচার ব্যভিচারের সূতিকাগার হয়ে যেতে পারে। চকিদার চোর হয়ে কেবল চুরিচামারি নয় গৃহের মালিকও হয়ে যেতে পারে। বিদ্যাহীনেরা বিদ্যার শিক্ষক, নীতিভ্রষ্টরা ন্যায়নীতির প্রশিক্ষক এবং শক্তিহীনেরা শক্তির আধাররূপে সমাজ কর্তৃক পূজিত হতে পারে। আইন অঙ্গুলি হেলনে বদলে যেতে পারে এবং বিচারপ্রার্থী ও বিচারক বিচারের পরিণতি সম্পর্কে কোনো কিছু নাও জানতে পারেন। অন্যায়কারীর সাহস বৃদ্ধি এবং সৎ মানুষের আতঙ্ক চান্দের দেশের ভারসাম্যহীন পরিবেশে অহরহ ঘটতে পারে।

উপরি উক্ত বর্ণনার সাথে আপনি যদি ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের বাংলাদেশের রাজনীতি এবং আওয়ামী লীগের হাল হকিকত সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করেন তবে দেখতে পাবেন যে, কোনো কিছুই আর আগের মতো নেই। আগে আওয়ামী লীগ যেরূপ চোখ বুজে পুলিশকে বিশ্বাস করত ঠিক সেখানে পুলিশ আতঙ্কে তারা দুই চোখের পাতা একত্র করতে পারছে না। ২০১৪ সাল এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী ঘটনাপঞ্জিতে তারা ত্রাণকর্তা হিসেবে পুলিশকে যেভাবে পেয়েছে তা অনাগত দিনে পাবে এমন বিশ্বাসে তারা কিছুতেই নিজেদের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। অন্য দিকে, ভোট চুরির অন্যসব দেশী-বিদেশী কারিগরদের আচরণও তাদের কাছে দুর্বোধ্য এবং ক্ষেত্রবিশেষে ভয়ঙ্কর বলে মনে হচ্ছে। কোনো কিছুতেই আর আগের মতো নির্ভরতার স্বাদ-গন্ধ ও আহ্লাদ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের ঘনত্ব হ্রাস পেয়েছে। পারস্পরিক যোগাযোগ ও সমঝোতায় দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। একধরনের শূন্যতা, অনিশ্চয়তা এবং অন্ধকারের হাতছানিতে তাদের অন্তরে হাহাকার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে তাদের দৈনন্দিন কর্মে এখন কোনো ধারাবাহিকতা নেই এবং স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মনোবলও নেই। সবাই অর্জিত অর্থের নিরাপদ সংরক্ষণ এবং পরিবার পরিজনের নিরাপত্তা নিয়ে দিনের একটা সময় খুবই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা নিয়ে চিন্তাভাবনা করে। ফলে পুরো আওয়ামী সমাজ সংসার ও রাজ্যে ত্রিমাত্রিক অভিনব রসায়ন সৃষ্টি হয়েছে।

প্রথমত, যারা দু’হাতে টাকা-পয়সা লুটপাট করেছে এবং ধরাকে সরা জ্ঞান করেছে তারা এখন দেশ কাল দল সব বাদ দিয়ে অর্জিত অর্থের মোহজনিত শোকে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আওয়ামী লীগ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছে। যারা পদ-পদবি ও ক্ষমতা ভোগ করেছে বিশেষত আমলা কামলা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা তারাও অবসরজনিত কারণে অথবা ক্ষমতার রাধা চক্রে পড়ে পদ-পদবি বঞ্চিত হয়ে আওয়ামীবিদ্বেষী হয়ে এক নব রূপ ধারণ করেছে।

দ্বিতীয়ত, বিকৃত বুদ্ধিজীবী, সুবিধাবাদী ও পোষ্য সুশীলরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একদল বলছে, ওরা পেয়েছে আমরা তো পাইনি। অন্য দল বলছে, কিছু পেয়েছি বটে তবে অপমানের পরিমাণটা বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং এভাবে তো এই সমাজে বাস করা যাবে না। সুতরাং আবহাওয়া পরিবর্তনের আগেই নিজেকে বদলানোর যে বুদ্ধি তা এখন সুবিধাবাদী বৃদ্ধিজীবীদের নিদারুণভাবে ভোল পাল্টাতে প্রভাবিত করছে।

তৃতীয়ত, যেসব বিদেশী রাষ্ট্র, দেশীয় প্রভাবশালী চক্র এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা অতীতে শর্তহীন সহযোগিতা করেছে তারা অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং কেউ কেউ কঠিন শর্তসাপেক্ষে নতুন সমঝোতা করতে চাচ্ছে, যা সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।

উল্লিখিত ত্রিমাত্রিক রসায়নের যোগফল বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল স্পষ্টতই দেখতে পাচ্ছে। ফলে অনাগত দিনের রাজনীতির পরিণতি তাদের জন্য এবং আওয়ামী লীগের জন্য কী ফলাফল ঘটাতে যাচ্ছে তা প্রকাশ্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে। ফলে আওয়ামী লীগের উদ্যম হ্রাস পাচ্ছে এবং তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষগুলোর উদ্যম জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলছে। নিত্যকার পত্রিকার পাতা বিভিন্ন রকম গরম গরম খবরে ভরে যাচ্ছে এবং রাজপথ এবার সত্যিকার রাজনীতির সূতিকাগারে পরিণত হতে যাচ্ছে। সুতরাং এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে তা বোধহয় আমার আর বলার দরকার হবে না- সম্মানিত পাঠক খুব সহজেই সার্বিক অবস্থা আন্দাজ করে নিতে পারবেন।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য